হিন্দু মহাসভার নেতার ছেলে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে

সোমনাথবাবু সিপিএমের প্রথম সারির নেতা ও সাংসদ। পেশাগত ভাবে আইনজীবী। সিপিএম রাজনীতিতে তিনি জ্যোতি বসুর ‘লোক’। গত নব্বইয়ের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব যখন জ্যোতিবাবুর কাছে এল এবং সিপিএম তা ফিরিয়ে দিল, সোমনাথবাবু দলের মধ্যে সেই সংখ্যালঘু নেতাদের অন্যতম, যিনি মনে করেছিলেন দিল্লির ডাক গ্রহণ করা উচিত ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।

রাজা বসন্ত রায় রোডের বৈঠকখানায় ঝোলানো তাঁর ছবি। শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙায় দাঁড়িয়ে তিনি। একা।

Advertisement

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবন অনেকটা ওই রকমই। দলের মানুষ। কিন্তু তার মধ্যেও একা। শেষ দিকে আবার দলও নেই। কেউ না মানলেও যিনি ডাক দিয়ে গিয়েছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে স্পিকার পদে কেউ বসলে তাঁর দলীয় সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়া উচিত।

সোমনাথবাবু সিপিএমের প্রথম সারির নেতা ও সাংসদ। পেশাগত ভাবে আইনজীবী। সিপিএম রাজনীতিতে তিনি জ্যোতি বসুর ‘লোক’। গত নব্বইয়ের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব যখন জ্যোতিবাবুর কাছে এল এবং সিপিএম তা ফিরিয়ে দিল, সোমনাথবাবু দলের মধ্যে সেই সংখ্যালঘু নেতাদের অন্যতম, যিনি মনে করেছিলেন দিল্লির ডাক গ্রহণ করা উচিত ছিল।

Advertisement

তবে এই সব পরিচয়ই ছাপিয়ে গেল চতুর্দশ লোকসভায় (২০০৪-২০০৯) তাঁর পাঁচ বছরের স্পিকার-অধ্যায়। লোকসভার ‘প্রো টেম’ স্পিকার থেকে স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার নজির এ দেশের মাত্র দু’জনের: গণেশ বাসুদেব মবলঙ্কর এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ইউপিএ সরকার থেকে সিপিএম সমর্থন তুলে নেওয়ার সময়ে তিনি স্পিকার পদকে দলের ঊর্ধ্বে রাখায় দল থেকে সোমনাথবাবুর বহিষ্কার দেশের রাজনীতিতে বেনজির বিতর্ক রেখে গিয়েছে। সোমনাথবাবু নিজেও ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই তাঁর বহিষ্কৃত হওয়ার দিনটিকে ‘সব চেয়ে দুঃখের’ বলেছেন।

জন্ম ১৯২৯ সালের ২৫ জুলাই তেজপুরে। পড়াশোনা মিত্র ইনস্টিটিউশন, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেমব্রিজের জিসাস কলেজে আইন নিয়ে উচ্চশিক্ষা। লন্ডনের মিডল টেম্পল বার-এ ডাক পেয়েছিলেন আইনজীবী হিসেবে। রাজনীতিতে আসার আগে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন। পারিবারিক পরিচয়ের নিরিখে দেখলে তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিতে আসার কথাই নয়! বাবা নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দুঁদে ব্যারিস্টার। তিনি অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা! আবার স্বাধীনতার পরে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার সময়ে আইনি লড়াইয়ে বাম নেতাদের সহায় তিনিই। স্নেহাংশু আচার্যের মাধ্যমে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর যোগাযোগ। ছেলে সোমনাথ সেই সম্পর্ক ধরে রাখেন জ্যোতিবাবুর শেষ দিন পর্যন্ত।

বাবার ছেড়ে-যাওয়া বর্ধমান লোকসভা আসনে ১৯৭১ সালে সিপিএম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রথম উদয় সোমনাথের। প্রথমেই জয়। ১৯৭৭ থেকে যাদবপুর কেন্দ্রের সাংসদ। জয়যাত্রা প্রথম ধাক্কা খেল ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর, ১৯৮৪ সালের পরাজয়ে। যাদবপুরে ইন্দ্রপতন ঘটিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে সে বার উদয় হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে নতুন নক্ষত্রের!

সিপিএম অবশ্য সোমনাথবাবুর মতো দক্ষ সাংসদকে বেশি দিন সংসদের বাইরে রাখেনি। বোলপুরে উপনির্বাচনে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে হারিয়ে ১৯৮৫-তেই আবার তিনি লোকসভায়। ছিলেন ২০০৯-এ অবসর নেওয়া পর্যন্ত। এই পর্বে দীর্ঘ সময় সিপিএমের সংসদীয় নেতা তিনি। পান সেরা সাংসদের পুরস্কার। জ্যোতিবাবুর সরকার যখন রাজ্যে নতুন শিল্পনীতি নিচ্ছে, সে সময়ে সোমনাথবাবুকে ভার দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের শিল্পোন্নয়ন নিগমের। বিনিয়োগ তো বাস্তবে আসে না, শুধু সমঝোতাপত্র (মউ) সই হয়— এই অভিযোগে তাঁকে ‘মউদাদা’ নামে কটাক্ষ করত বিরোধীরা! যদিও হলদিয়া পেট্রোকেম বাস্তবায়িত হওয়ার পিছনে তাঁর জরুরি ভূমিকা ছিল। বলা হয়, বোলপুরে এখন যে নগরায়নের জোয়ার, স্থানীয় সাংসদ থাকাকালীন শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ মারফত তার সূচনা করিয়েছিলেন সোমনাথবাবুই। শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির উপরে থাবা বসানোর প্রতিবাদে পথে নামেন মহাশ্বেতা দেবীর মতো বিদ্বজ্জনেরা। সোমনাথবাবু দমেননি।

দলের সঙ্গে সংঘাতেও তিনি অদম্য। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইউপিএ জমানায় লোকসভার স্পিকারের দায়িত্ব নিয়ে কমিটি থেকে সরে দাঁড়ান। গণতন্ত্রে জনতার প্রতি দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়ে সংসদের দুই কক্ষের কাজকর্ম সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় তাঁর আমলেই। কিন্তু গোলযোগের সূত্রপাত হয়, যখন ২০০৮-এ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো ইউপিএ-১ থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার চিঠিতে সিপিএম দলীয় সাংসদ-তালিকায় তাঁর নাম থাকে। সোমনাথবাবু প্রশ্ন তোলেন, স্পিকারের আসনে থেকে তিনি আর কোনও পক্ষের নন। তাঁর নাম কেন ওই তালিকায়? আপত্তি মানেননি প্রকাশ কারাটরা। দলই তাঁকে প্রথমে সাংসদ করে তার পরে স্পিকার পদে মনোনয়ন দিয়েছে, এই বলে তাঁকে পদত্যাগে রাজি করানোর চেষ্টা হয়। কয়েক দিনের টানাপড়েনে সোমনাথবাবু অনড় থাকেন। শেষে সংসদে বামেদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের উপরে ভোটের দিন স্পিকার হিসেবে তিনিই যখন লোকসভা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন, সে দিনই পাকা হয়ে যায় তাঁর পার্টি-জীবনে দাঁড়ি টানার চিত্রনাট্য। দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে সোমনাথবাবুকে পত্রপাঠ বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়।

পরে নিজের বই কিপিং দ্য ফেথ: মেমোয়ার্স অব আ পার্লামেন্টেরিয়ান-এ নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা এবং তৎকালীন সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্বের সমালোচনা করে গিয়েছেন সোমনাথবাবু। দলে ফেরার জন্য কোনও আবেদনে রাজি হননি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের টালমাটাল পর্বে যে নেতাকে মুখ করে বিকল্প মন্ত্রিসভা গড়া যায় কি না, সেই চর্চাও শুরু হয়েছিল সিপিএমের অন্দরে, তাঁকেই একটা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের দায়ে ছেঁটে ফেলা হল? দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছিলেন, ‘‘উনি সংবিধান মেনে কাজ করে থাকতে পারেন। কিন্তু দলীয় সদস্যের কাছে দলের গঠনতন্ত্রই চূড়ান্ত।’’

স্পিকার থাকাকালীন সোমনাথবাবুর সঙ্গে বিবাদ বেধেছিল সাংসদ মমতারও। কিন্তু সাংবিধানিক কর্তব্যকে কখনও ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে আসেননি সোমনাথবাবু। তাই মমতার সঙ্গে সম্পর্কও পরবর্তী কালে সহজ হয়ে আসে। ব্যক্তিগত স্তরে বিমানবাবুরাও যোগাযোগ রেখেছেন সোমনাথ ও তাঁর স্ত্রী রেণু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁদের বড় মেয়ে অনুরাধার অকাল প্রয়াণের সময়ে কন্যাশোকে পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু প্রবল অভিমানে পুরনো দলকে ‘পাপক্ষালন’-এর সুযোগ সোমনাথবাবু দিতে চাননি। ভালবাসার দলের কাছে এটাই কি প্রাপ্য ছিল— এই প্রশ্ন রেখেই বিদায় নিলেন তিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement