দেবাশিস মজুমদার লিখিত ‘আত্মশিল্পীর ভিটেমাটি’ (২৪-১০) সম্পর্কে কিছু কথা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই দেখেছে মন্বন্তর, মৃত্যু, অত্যাচার। স্বাধীনতার হাত ধরে এল দেশভাগ গণহত্যা আর বেকারত্ব। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ছিল একমুখী, তবে একাধিক পন্থার লড়াই। নরমপন্থী কংগ্রেস যেমন ছিল, তেমনই ছিল বামপন্থার ভূমিকা, তৈরি হল ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক-শিল্পী সঙ্ঘ। তার পর উত্থান হল আইপিটিএ-র। সেখান থেকে বহুরূপী নাট্য সংস্থা। বহুরূপী-তে ছিলেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তৃপ্তি মিত্র। তখন তাঁরা সমাজ ও সুস্থ রুচি গড়ার ‘কারিগরের ব্রত’ নিয়ে নেমেছেন। সুস্থ চিন্তা গড়ে তুলবে পরিশীলিত মনুষ্যত্ব। এর জন্য প্রয়োজন আত্ম-অনুশীলন।
তেমনই এক ব্রতচারিণী তৃপ্তি মিত্র। সর্বত্রই তিনি অদ্বিতীয়া। বস্তুত সুচিত্রা সেন, সুচিত্রা মিত্র থেকে তৃপ্তি মিত্র— কারও লক্ষ্য ছিল না অর্থোপার্জন। বরং তাঁদের আকাঙ্ক্ষাই ছিল তাঁদের নিজেদের সৃজনশৈলীর মাধ্যমে দর্শক শ্রোতার মানসলোকে বিশিষ্ট স্থান অর্জন৷ এই শিল্পমনস্কতার জন্য তাঁদের কম মূল্য দিতে হয়নি। সাংসারিক কারণে অধিক উপার্জনের জন্য তৃপ্তি মিত্রকে যেমন ব্যবসায়িক মঞ্চেও অভিনয় করতে হয়েছে একান্ত বাধ্য হয়ে, তেমনই তাঁর ডাক আসে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার। কে এ আব্বাস পরিচালিত ধরতি কে লাল ছবিতে তাঁর অভিনয় যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনই তাঁর অভিনীত নানা বাংলা ছবির মধ্যে ঋত্বিক ঘটকের ছবি যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-তে তাঁর অভিনয়, যা আজও দর্শকের স্মৃতিতে অমলিন। কখনও রুচির সঙ্গে আপস করেননি। এটাই ছিল তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়। শেষের দিকে মারণরোগে যখন কাতর, তখনও কারও সঙ্গে দেখা হলেই হেসে কথা বলতেন। শাঁওলী মিত্র জানতে চেয়েছিলেন, “মা, এত কষ্টের মধ্যে তোমার হাসি আসে কী ভাবে?” তৃপ্তি হেসেই জানিয়েছিলেন, “আমাদের যে এটাই আগে শিখতে হয়, মা।”
তনুজ প্রামাণিক, হাওড়া
আশারেখা
শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের ‘একটু হলেও কম একা’ শীর্ষক প্ৰবন্ধটি (২৩-১০) পড়ে মাথায় যেন উঁকি দিতে শুরু করল প্রাচীন বাংলার কৌম সমাজের জীবনধারার কথা। এই প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের একটা লেখায় পাওয়া যাচ্ছে, “মৌর্য কালের আগে প্রাচীন বাংলার জনপদেরা সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করিত, তাহাদের সমাজ ছিল, রাজা ছিল, রাষ্ট্রও ছিল। তাহারও আগে যখন রাজা ছিল না, কৌমসমাজ ছিল, ইতিহাসের সেই ঊষাকালে সেই সমাজের একটা শাসনপদ্ধতি ছিল। আজও তাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া লোপ পাইয়া যায় নাই। বাংলায় বিভিন্ন জেলায় সমাজের নিম্নতম স্তরে, অথবা পার্বত্য আরণ্য কোমদের মধ্যে, যেমন সাঁওতাল, গারো, রাজবংশী ইত্যাদির মধ্যে, তাহাদের পঞ্চায়েতী প্রথায়, তাহাদের দলপতি নির্বাচনে, সামাজিক দন্ডবিধানে, নানা আচারানুষ্ঠানে, ভূমি ও শিকার স্থানের বিলি বন্দোবস্তে, উত্তরাধিকার-শাসনে এখনও সেই কৌম শাসনযন্ত্র ও পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলার বাহিরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেও এই ধরনের বিচিত্র কৌম শাসনযন্ত্র ও পদ্ধতি আজও দেখিতে পাওয়া যায়, যদিও উন্নত অর্থনৈতিক সমাজ-পদ্ধতির ক্রমবর্ধমান চাপে আজ তা দ্রুত বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে।”
পুরনো আবাসন বা পাড়া-সংস্কৃতির মধ্যেও যে মানুষে-মানুষে জোটবদ্ধতা এখনও কিছুটা বিদ্যমান, সেই বিষয় উত্থাপন করাটা মনে হয় খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আজও সেখানে মানুষকে একত্র দেখা যায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা বিপদে-আপদে। আগে পূর্ব কলকাতার যে পাড়াতে আমরা থাকতাম, সেখানে ঘরে ঘরে বা বাড়িতে বাড়িতে ঝগড়া-বিবাদ যেমন দেখেছি, তেমন ভাব-ভালবাসার প্রমাণও প্রচুর পেয়েছি। আমার এখনও মনে আছে, তিন দশকেরও বেশি সময় আগে আমার ব্যাঙ্কে চাকরি পাওয়ার সংবাদটা বাড়িতে পৌঁছনোর সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। বাড়ি থেকে একটু দূরে রাস্তায় ফুটবল খেলছিলাম। আমাদের বাড়িরই সমবয়সি এক বন্ধু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হাসিভরা মুখে সেই সময়েই চাকরির খবরটা আমাকে দিতে আসে, নিজে তখনও কোনও চাকরি না পেয়েও। তবে হ্যাঁ, সব জায়গাতেই পারস্পরিক এই মেলামেশার পরিমাণ আগের থেকে নিশ্চয়ই অনেকটা কমে গিয়েছে। মানুষের জীবনধারার পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের মানসিকতাতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন, যার ফলে একই আবাসনে বা পাড়ায় থেকেও বাবা-মায়েদের থেকে তাঁদের কিশোর-কিশোরী ছেলেমেয়েরা মেলামেশা কিংবা অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়ে এখন অনেকটাই যে আলাদা— সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও বলব, এখনও এই পারস্পরিকতার যেটুকু বেঁচে আছে, সেটাই বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। আজকের স্বার্থকেন্দ্রিক জীবনযাপনে সকলের জন্য সকলকে পাওয়া হয়তো সম্ভব না-ও হতে পারে, কিন্তু, অনেকেই যদি অনেকের জন্য থাকতে পারেন, তা-ই বা মন্দ কী?
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
বন্ধন আজও
শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের ‘একটু হলেও কম একা’ প্রবন্ধটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা এবং দক্ষিণ কলকাতার ইতিহাস বড় কম কিছু নয়। উত্তর কলকাতা বরাবরই বনেদিয়ানাতে ভরপুর ছিল। মধ্য কলকাতা খানিকটা সাজানো-গোছানো বাগানের মতো। আর দক্ষিণ কলকাতার অনেকটা অংশই ছিল ও-পার বাংলার উদ্বাস্তু মানুষের দখলে। উদ্বাস্তু মানুষকেন্দ্রিক বিভিন্ন কলোনি গড়ে উঠেছিল। সেই কলোনিগুলোতে ছিল অপরিকল্পিত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, অলিগলি, পুকুর, জলাভূমি ইত্যাদি। এই সব কলোনির বাসিন্দারা ছিলেন মুখ্যত ও-পার বাংলার। তবে দীর্ঘ দিন একই জায়গায় বসবাস করতে করতে তাঁদের মধ্যে একটা ভ্রাতৃত্ব ও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিকতার ছাপ লেগেছে, মানুষের চাহিদা বেড়েছে, শহর দ্রুতবেগে ছুটছে। কিছু দরিদ্র উদ্বাস্তু মানুষ তাঁদের জায়গা-জমি বিক্রি করে চলে গিয়েছেন। সেখানে গড়ে উঠছে গেস্ট হাউস, ফ্ল্যাটবাড়ি, দোকান ইত্যাদি। তবুও এখনও এই সব কলোনির মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন, প্রতিবেশীসুলভ আচরণ রয়েছে, তা শহরের অন্যান্য অংশের থেকে অনেক, অনেক বেশি। তাঁরা আত্মকেন্দ্রিক নন। তাঁরা অনেকেই অনেকের জন্য। তাঁরা একা নন।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
দায়ী রাজনীতি
সুজিত মাঝির ‘কার ভাবাবেগ কার আঘাত’ (২৯-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটি একটি বিশেষ জনজাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল।
প্রেমের রূপকল্পে আমরা অনায়াসে তাজমহলকে উল্লেখ করেছি। তখন কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ভেদ বুঝিনি। কোনার্ক সূর্যমন্দিরের গায়ে খোদাই করা মূর্তিকে যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, তাতে কিন্তু শিল্পের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়ে যায়নি। অথচ ওরই মধ্যে যখন রাজনীতি প্রবেশ করেছে, তখনই আমরা পরস্পর সংঘাতে জড়িয়েছি। বিদ্বেষের এই বীজ নাকি ইংরেজরা বুনে দিয়েছিল। তা হলে এত বছর পরেও সেই বীজ কেন আমরা উপড়ে ফেলতে পারিনি?
পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ হাজার অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। অথচ বিভিন্ন ভাবে সমাজের নানা প্রান্তের ঘৃণ্য চরিত্রকে অসুর রূপে দেখানো হচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, আর সচেতনতার অভাব। অসুর বিশেষ এক জনজাতি গোষ্ঠীর দেবতা, এ কথা ক’জন বাঙালি জানেন? বরং তাঁকে দেখা হয় দেবতার ঠিক বিপরীত চরিত্রে।
মানুষ পটলচেরা চোখেই বেশি সম্মানিত বোধ করে। মৃগনয়না হতেও আপত্তি নেই। অথচ পশুরাজ সিংহের মতো চোখ! সে তো কল্পনার অতীত। তবে পেশিশক্তি আর গর্জনে সিংহের মতো পুরুষ মর্যাদার বাহক। প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকে হরেক রকম বস্তু। সব কিছুর মধ্যে নিহিত শক্তিকে ব্যবহার করার অদম্য ইচ্ছা মানুষের মজ্জাগত। কিন্তু সেই সৃজনশীলতার তুলিতেই রাজনীতি আর ধর্মের রং মিশিয়ে দেওয়ার খেলা চলছে। বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগণা
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে