ব্রাহ্মসমাজ এডুকেশন সোসাইটির আওতায় কলকাতায় সাতটি বড় কলেজ নিয়ে প্রায় একটি সাম্রাজ্য ছিল। দক্ষিণ কলকাতায় সিটি কলেজ যে দিন গঠিত হল, দৈবচক্রে সেই দিনটি থেকে আমি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, প্রথমে অধ্যাপনায়, পরে অধ্যক্ষতার কাজে। সেই সুবাদে জানি, বর্তমানে কলেজগুলি ঘিরে যে বিতর্ক চলছে তার মূল কথাটি হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার, তার নিজস্ব নীতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষমতা। ব্রাহ্মরা হিন্দু সমাজের একটি গোষ্ঠী, না কি আলাদা একটি ধর্মের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, এই বিতর্ক মূল সমস্যা ছিল না।
তখন আশির দশকের মাঝামাঝি, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাজগতে পুরোপুরি ‘অনিলায়ন’ ঘটে গিয়েছে, শাসক দল শিক্ষাজগৎ কুক্ষিগত করে ফেলেছে। কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে শিক্ষক নিযুক্ত করে কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকেই গ্রহণ করতে হবে। তিনি যোগ্য কি না, তা প্রশ্নাতীত না হলেও। সেই সময় দেখা গেল, সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজগুলির মতো খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর কিছু স্বাধীনতা আছে, কারণ তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সাউথ সিটি কলেজে কর্মরত আমরা শুনতে পেলাম, ব্রাহ্মসমাজ এডুকেশন সোসাইটি সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে, দাবি করেছে তারা একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংগঠন, অতএব স্বাধীন ভাবে কার্য পরিচালনার অধিকারী। যত দূর মনে পড়ে, আইনজীবী অশোক সেন মহাশয় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছু দিন পরে ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলিতে সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তিকালীন আদেশ পৌঁছল।
কলেজ সার্ভিস কমিশন ব্রাহ্ম কলেজগুলিতে তিন জন করে শিক্ষক পাঠাবে, তারা তার মধ্যে থেকে প্রার্থীকে নিয়োগ করতে পারবে। ঘটনাচক্রে সেই ১৯৮৩-৮৪’তে সাউথ সিটি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছি, অন্তর্বর্তী আদেশটি মনে হল অন্তত খানিক স্বস্তি দেবে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা হল ভিন্ন। প্রথমেই ইংরেজি সাহিত্যের জন্য তিন প্রার্থীর নাম কলেজে পৌঁছল, কাগজপত্র থেকে দেখা গেল এক জন অত্যন্ত উপযুক্ত। তাঁকে আমি চিঠি পাঠালাম, ইন্টারভিউয়ের দিন যেন অবশ্য আসেন। জবাবে একটি পোস্টকার্ড এল, ‘‘আমি পড়াশোনা শেষ করার পর রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছি, আমি সংসারে ফিরব না।’’ হতাশ হয়ে দ্বিতীয় নামটিতে নজর দিলাম, খুব ভাল নয় তবে কাজ চলবে। দ্বিতীয় প্রার্থীর সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করতে না পেরে তাঁর বাড়ির ঠিকানায় অফিসের এক কর্মীকে পাঠালাম। তিনি ফিরে এসে জানালেন, ভদ্রলোক ক’বছর আগে মারা গিয়েছেন। খবর শুনে সবাই স্তম্ভিত। অতএব ইন্টারভিউয়ের দিন তিন জন নয়, মাত্র এক জনই হাজির। তিনি বাংলা বা ইংরেজি কোনও ভাষাতেই কিছু বলতে পারেন না। সে সময় আমাদের স্টুডেন্টদের মান খুব উঁচু। বিশেষ করে যারা কমার্স পড়ে তারা বেশিরভাগ ফার্স্ট ক্লাস পায়, আজও অনেকে উচ্চপদে আসীন। এই স্টুডেন্টদের ক্লাস সামলানো ওই প্রার্থীর পক্ষে অসম্ভব।
কলেজ সার্ভিস কমিশনে দেখা করে অনুরোধ করলাম, তিন জনের প্যানেল তো পাইনি, আর একটি প্যানেল পাঠানো হোক। সার্ভিস কমিশনের অধিনায়িকা অত্যন্ত অপ্রসন্ন হয়ে জানালেন, তাঁদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। শিক্ষক ছাড়া পড়াশোনা কী করে চলবে? পার্ট-টাইম শিক্ষক নেওয়ার অধিকার কলেজ কর্তৃপক্ষের আছে। বিজ্ঞাপনের জবাবে পার্ট-টাইম কর্মপ্রার্থী যাঁরা এলেন তাঁরা ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত তরুণতরুণী। এত দিন কোথায় ছিলেন? তাঁরা জানালেন, কলেজ সার্ভিস কমিশনের তালিকার নীচের দিকে ছিলেন, মাঝে মাঝে দূরদূরান্তে প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁদের নাম পাঠানো হত, উপযুক্ত হলেও যোগ্য কাজ পেতেন না। যে সব পার্ট-টাইমার নিয়ে তখন কলেজ চালিয়েছি, তাঁদের কাছে কলেজ সত্যিই কৃতজ্ঞ।
পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল, কারণ খবরে দেখছি, ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত এখনও চলছে। যদিও মাঝে অনেক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বর্তমান শাসনকালে ব্রাহ্ম কলেজগুলির পরিচালন সমিতি ভেঙে দিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের তত্ত্বাবধানে চলছে। ব্রাহ্মরা স্বতন্ত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু, না কি হিন্দু সমাজের একটি প্রগতিশীল গোষ্ঠী, এই বিতর্ক এখন হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের বিচারের বিষয়। এই বিতর্কের আইনগত নিষ্পত্তি কী হবে জানা নেই। কিন্তু শিক্ষাজগতের মানুষেরা জানেন, মূল সমস্যা অনেক গভীরে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হওয়ার পন্থা হিসাবে এই সংঘাত শুরু হয়েছিল।
আক্ষেপ এই, কেন্দ্রে বা বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে রাজনীতিমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রথম এনডিএ সরকারের আমলে পার্লামেন্টে ছিলাম, দেখেছি তাদের শিক্ষাকে গৈরিকীকরণের, নিজেদের লোক বসিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা। বাম আমলে নিজের রাজ্যের দমবন্ধ করা অভিজ্ঞতা তো আছেই। তবে বিশেষ কোনও দলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাধারণ ভাবে দেখা গিয়েছে, যে কোনও দল যে কোনও জায়গায় যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের রঙে শিক্ষাকে রাঙিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছে এবং এই কাজ করতে গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি হস্তগত করা একান্ত জরুরি। দেশের নেতৃবৃন্দ মুখে অনেক কথা বলেন, যথা, ধর্ম আর রাজনীতি মিশিয়ো না, কিন্তু কার্যকালে সকল দলই কমবেশি সেটিই করে থাকে। শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে, এই ‘ক্লিশে’টি তেমনই মাঝে মাঝে শোনা যায়।
ব্রাহ্মসমাজভুক্ত কলেজগুলি নিয়ে নতুন করে বিতর্কের খবর দেখে মুক্ত শিক্ষাজগতের বিফল সন্ধানের কথা মনে পড়ল। একেবারে আদর্শ স্বাধীন শিক্ষাজগৎ সম্ভব না হলেও দলীয় শাসনমুক্ত শিক্ষাজগতের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
শুধু উচ্চশিক্ষার জগতে মুক্ত আলো-হাওয়া কেন, আজ জাতীয় জীবনেও খোলা হাওয়ার বড় প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসটির কথা অনেকের মনে পড়বে। প্রগতিশীল উদারপন্থী ব্রাহ্ম ও গোঁড়া নিষ্ঠাবান হিন্দুর সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে উপন্যাসে অনেক কথা আছে। সব কিছু ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনন্দময়ী নামে উজ্জ্বল এক চরিত্র। সিপাহি বিদ্রোহের মধ্যে যে দিন তিনি মাতৃহারা ম্লেচ্ছ ইউরোপীয় শিশুকে বুকে তুলে নিলেন, সে দিন থেকে তিনি সকল জাতপাতের ঊর্ধ্বে এক মুক্তমনা মাতৃমূর্তি। আজকের দিনে দেশের সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় পরিবেশে আনন্দময়ীর বড় প্রয়োজন।