মানুষ কী নিয়ে আফসোস করে? মনস্তত্ত্বের আলোচনা বলে, কৃতকর্মের জন্য আফসোস করে যত জন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আফসোস করে জীবনে যে কাজগুলো করার কথা ভেবেও শেষ অবধি করা হয়ে ওঠেনি, সেগুলোর জন্য। অস্ট্রেলীয় লেখক ব্রনি ওয়্যার কাজ করতেন প্যালিয়েটিভ কেয়ার গিভার বা অন্তিম সময়ের সেবাকর্মী হিসাবে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছিলেন দ্য টপ ফাইভ রিগ্রেটস অব দ্য ডায়িং: আ লাইফ ট্রান্সফর্মড বাই দ্য ডিয়ারলি ডিপার্টিং (২০১১)। যখন মৃত্যু সমাগতপ্রায়, জীবনে নতুন করে আর কিছু করার সব সুযোগ শেষ, তখন মানুষ কী নিয়ে আফসোস করে, জানিয়েছেন ব্রনি। তাঁর অভিজ্ঞতা, সবচেয়ে বেশি মানুষ আফসোস করে নিজের ইচ্ছাগুলিকে চেপে রেখে সমাজের মতে জীবন কাটানোর জন্য— নিজের স্বপ্নকে ধাওয়া না করার জন্য। অন্য যে কারণগুলি ব্রনির তালিকায় এসেছে, সেগুলি হল: চাকরি বা ব্যবসার কাজে খুব বেশি সময় দেওয়া, ফলে পরিবার বা প্রিয় জনদের সঙ্গে যথেষ্ট সময় না কাটানো; সাহস করে নিজের অনুভূতির কথা প্রকাশ করতে না পারা; পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা; এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, নিজেকে সুখী হওয়ার অনুমতি না দেওয়া— অর্থাৎ, চেনা আলো-চেনা অন্ধকার ছেড়ে, পুরনো অভ্যাস ছেড়ে নতুন কিছুর খোঁজে যাওয়ার থেকে নিজেকে আটকানো। খেয়াল করে দেখার যে, এই তালিকায় পাঁচটি আফসোসই না-করার— কোনও কিছু করতে গিয়ে ভুল করে ফেলার আফসোস নয়।
না-করার আফসোসগুলোকে যদি কোনও একটি সুতোয় গাঁথতে হয়, তবে সেটা কী? সেই সুতোটি হল ভয়— অজানাকে ভয়। সমাজের প্রত্যাশাকে অবজ্ঞা করার ভয়, কাজে ‘যথেষ্ট মন’ না দিলে ক্ষতি হওয়ার ভয়, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে প্রত্যাখ্যাত অথবা অপমানিত হওয়ার ভয়, অচেনা পথে হাঁটার ভয়। এই ভয় বস্তুটি আধুনিক মানুষকে উপহার দিয়েছে বিবর্তন— যে সময় প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হত, প্রতিকূল পরিস্থিতিই জীবনের প্রাথমিকতম সত্য ছিল, তখন এই ভয় মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এই ভয় তাকে সতর্ক করত, অহেতুক ঝুঁকি এড়াতে শেখাত। পরিবেশ পাল্টে গিয়েছে, কিন্তু বিবর্তনের মন্ত্র মানুষকে ছাড়েনি। আচরণবাদী অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব বলে, মানুষ কোনও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভে যতখানি আনন্দিত হয়, সমপরিমাণ ক্ষতিতে দুঃখিত হয় তার চেয়ে অনেক বেশি— প্রায় দ্বিগুণ। বাঁধা গতে চলার সুবিধা হল, তাতে বড় মাপের ক্ষতি এড়িয়ে চলা যায়। অন্তত, মানুষ তেমনটাই ভাবে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আফসোস করার সময় হয়তো মনে হয়, ক্ষতি এড়িয়ে চলার তাড়নায় খুব বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে— প্রকৃত সুখ অধরাই থেকে গিয়েছে। ঝুঁকিবিমুখ চরিত্র সুখের স্বরূপ চিনতে পারেনি। মানুষ বড় মাপের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয় একমাত্র সব হারানোর প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনার মুখোমুখি হলেই— তখন সেই ক্ষতি এড়ানোর জন্য সব কিছু পণ করে। তবে, তা কোনও অর্থেই সুখের সন্ধান নয়।
প্রকৃত সুখের সন্ধানে যেতে হলে কি তবে অজানা বিপদকে বরণ করে নেওয়া ভিন্ন গতি নেই— এই প্রশ্নটিকে খানিক পাল্টে নিলে সুখসন্ধানের তুলনায় সহজতর পথের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। সম্পূর্ণ অজানা বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষমতা বেশির ভাগ মানুষেরই নেই, কিন্তু সেই অজানাকে যদি পাল্টে নেওয়া যায় জানা, পরিমাপযোগ্য ঝুঁকিতে? আর এক দিনও যে চাকরি করতে ইচ্ছা করছে না, সেটা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলেও অনেকেরই ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু, চাকরি ছাড়ার অজানা বিপদকে যদি বিভিন্ন গোত্রের, এবং সম্ভাবনার ঝুঁকিতে ভেঙে নেওয়া যায়? যেমন, নতুন মনপসন্দ উদ্যোগে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা, মোটের উপরে চালিয়ে নিতে পারার সম্ভাবনা, এবং নতুন উদ্যোগে দারুণ সফল হওয়ার সম্ভাবনার হিসাব যেমন দেখতে হবে, তেমনই বুঝে নিতে হবে নতুন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে অন্যত্র পা ফেলার সুযোগগুলোকেও। এ ভাবে ভাঙতে পারলে ঝুঁকিবিমুখ মনকেও লাভ-ক্ষতির সম্ভাব্য হিসাব বোঝাতে সুবিধা হয়। কারও কাছে মুখ ফুটে মনের কথা বলার আগে যদি শুধুই প্রত্যাখ্যান বা বিড়ম্বনার কথা না ভেবে হিসাব করে নেওয়া যায় স্বীকৃত হওয়ার সম্ভাবনাটিও, তা হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হতে পারে। জীবনের ছোট-বড় সিদ্ধান্তকে এ ভাবে ভেঙে দেখার অভ্যাস করার পরও কেউ সুখী হবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু, শেষ শয্যায় শুয়ে আফসোসের থেকে অন্তত বাঁচা যায়।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে