ভারতে চারটি শ্রম বিধি বলবৎ হল ২১ নভেম্বর। যদিও প্রধান শ্রমিক সংগঠনগুলি আইন রদ করার দাবিতে ফের সর্বভারতীয় ধর্মঘট ডেকেছে, কিন্তু বাস্তব এটাই যে কৃষক আন্দোলন যে ধরনের সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে তিনটি কৃষি আইন পাশ হওয়ার পরেও রদ করাতে পেরেছিল, শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে সেই শক্তির প্রাবল্য দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু, অধিকাংশ রাজ্য নতুন শ্রম বিধি কার্যকর করার নিয়ম তৈরি করে ফেলেছে, যার মধ্যে অনেক ক’টিই বিরোধী-শাসিত রাজ্য। অতএব ভারতের প্রায় পঞ্চাশ কোটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা এখন নিয়ন্ত্রিত হবে নয়া শ্রম আইন দিয়ে, এই মুহূর্তে তাতে সংশয় করা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য এখনও নিয়ম তৈরি করেনি, এবং আগাগোড়াই শ্রম বিধির বিরোধিতা করেছে। অতএব এখন পশ্চিমবঙ্গে শ্রম-সম্পর্কিত বিরোধের নিষ্পত্তি কী ভাবে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সাধারণত যৌথ তালিকায় কোনও বিষয় থাকলে, এবং সে বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের নিয়মাবলিতে বিরোধ ঘটলে, কেন্দ্রের নিয়মাবলিই প্রাধান্য পায়। অতএব নিয়মাবলি তৈরি না করে রাজ্যের কতটুকু লাভ হল, সে প্রশ্ন উঠবে। উপরন্তু, আদালতে কোনও সংশয়ের নিষ্পত্তি কত জটিল ও সময়সাপেক্ষ, অজানা নয়। তা সত্ত্বেও তৃণমূল সরকার চিরাচরিত ভাবে ‘বর্জনের মাধ্যমে বিরোধিতা’-র পথটি নিয়েছে। তার মূল্য হয়তো চুকাতে হবে রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষকে। অপর দিকে, নরেন্দ্র মোদী সরকার যৌথ তালিকাভুক্ত একটি বিষয়ে এক তরফা ভাবে আইন তৈরি করল, যা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মর্যাদাকে লঙ্ঘন করেছে। শ্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চারটি আইন কার্যত বিরোধীহীন সংসদে, প্রায় বিনা আলোচনায় পাশ করিয়েছে কেন্দ্র। রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনার পর্বটি নিয়মরক্ষার মতো করেই সারা হয়েছে।
শ্রম বিধিগুলি নিয়ে নানা আপত্তি উঠেছে। যেমন, কর্মক্ষেত্রের সংজ্ঞা যে ভাবে স্থির করা হয়েছে, তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের দশ জন শ্রমিকের ন’জনই থেকে যাচ্ছেন ‘শ্রমিক’-এর সংজ্ঞার বাইরে। ভারতে রোজগেরে মানুষদের ৪৬ শতাংশ স্বনিযুক্ত কর্মী, ১৫ কোটি কৃষি মজুর, অন্তত পাঁচ কোটি গৃহশ্রমিক। দোকান, শোরুম প্রভৃতিতেও কাজ করেন বহু মানুষ। শ্রম বিধিতে এই কর্মীদের প্রতি সে ভাবে দৃষ্টিই দেওয়া হয়নি। এই সমালোচনার সারবত্তা গ্রহণ করেও বলতে হয়, শ্রম বিধিতে কিছু কিছু এমন বিষয়ও রয়েছে, যা কার্যকর হলে বহু কর্মী ও শ্রমিকের স্বার্থের কিছুটা সুরক্ষা হবে। যেমন, সব শ্রমিককে নিয়োগপত্র (অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার) দেওয়া আবশ্যক করা হয়েছে। যথাসময়ে বেতন দান, এবং সব ধরনের কাজে ন্যূনতম মজুরি আবশ্যক করা হয়েছে। গিগ কর্মী এবং প্ল্যাটফর্ম কর্মীদেরও প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিমা প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া আবশ্যক করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিযুক্ত কর্মীরা (ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়ি) বেতন, ছুটি, সামাজিক সুরক্ষা প্রভৃতি সব সুবিধা পাবেন স্থায়ী কর্মীদের মতো, সমান হারে। চুক্তি কর্মী, ঠিকাদারের মাধ্যমে নিযুক্ত কর্মীদেরও স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বাধ্য প্রাথমিক নিয়োগকারী।
এমন নয় যে এ সব সুবিধা এই প্রথম পাচ্ছেন শ্রমিকরা। ন্যূনতম মজুরি, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার এর আগের নানা শ্রম আইনেও উল্লিখিত ছিল। কিন্তু সেগুলি সহজেই উপেক্ষিত হয়েছে, কারণ রাজ্যে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটি দুর্বল। ঠিকা শ্রমিকের বিপন্নতা, চা কিংবা চটকলে শ্রমিকের বিপুল পিএফ বকেয়া থাকতে পারছে প্রশাসনিক শিথিলতার জন্যেই। নয়া আইন এ বিষয়ে নীরব। নিয়োগপত্র না দেওয়া, অস্থায়ী কর্মীকে প্রতারণা করা কতটা বিপজ্জনক, নিয়োগকর্তার মনে তার বোধ তৈরি করতে প্রয়োজন সক্রিয়, সতর্ক প্রশাসন। আইনের ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্ক চলুক, কিন্তু তার প্রয়োগে বাধাগুলির দিকেও নজর দেওয়া দরকার। শ্রমিকরা সুরক্ষা পাবেন কি না, তা নির্ভর করবে রাজ্যগুলির উপরেও।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে