রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রায় হেমন্ত গেয়েছিলেন ‘যখন পড়বে না মোর...’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মের ১০০ বছরে তাঁর গাওয়া অবিস্মরণীয় কয়েকটি গানের কথা-সুর-গায়ন-গল্পের অন্তরঙ্গ আলাপন। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য। আজ দ্বিতীয় পর্ব। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মের ১০০ বছরে তাঁর গাওয়া অবিস্মরণীয় কয়েকটি গানের কথা-সুর-গায়ন-গল্পের অন্তরঙ্গ আলাপন। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ডিজিটালের জন্য। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

Advertisement

অংশুমান ভৌমিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২০ ১৮:০১
Share:

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে (১৯৫০)

Advertisement

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,

Advertisement

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে –

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

যখন জমবে ধূলা তানপুরাটার তারগুলায়,

কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা,

ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,

শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় –

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,

কাটবে দিন কাটবে

কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে, আহা,

ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি –

চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি – আহা,

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

প্রয়াণের দেড় মাসের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৮৯-এর ১১ নভেম্বরে দেশ পত্রিকার মলাটে উঠে এসেছিলেন হেমন্ত। সেই প্রথমবার।তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ মলাট আঁকিয়েছিলেন বিমল দাসকে দিয়ে। পোর্ট্রেট। নিজের ঘরানায় এঁকেছিলেন বিমল। পিছনে টেনে আঁচড়ানো এক মাথা তেল চুকচুকে কালো চুল, বাহারি কালো ফ্রেমের চশমায় মোড়া এক জোড়া মায়াবি চোখ, ধবধবে সাদা জামা মিলে যেন মধ্যগগনের হেমন্ত ফিরে এসেছিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। তাঁর এই আয়ত মুখ ১৯৫০-এর দশকের।

ভবানীপুর পাড়ায় হেমন্তর ছেলেবেলার বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। ওই সংখ্যায় তাঁকে দিয়ে একটা মেদুর স্মৃতিকথা লিখিয়ে নিয়েছিলেন সাগরময়। তাতে তরুণ হেমন্তর প্রতিষ্ঠাপর্বের একটা ছবি আঁকা আছে। তার এক জায়গায় ছিল, ‘অল্প পরেই – আমাদের হয়তো আজও মনে আছে, রবীন্দ্রনাথের অনন্ত যাত্রাকালে হেমন্তর দরদী কণ্ঠর ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ শোকবিহ্বল মানুষের (মনে) কী গভীর অনুরণন তুলেছিল।’ এ গান কোথায় গেয়েছিলেন হেমন্ত? গেয়েছিলেন ১ নং গার্স্টিন প্লেসে আকাশবাণীর পুরনো বাড়ির রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে বসে। জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে নিমতলা ঘাট মহাশ্মশান অবধি সেই প্রবাদপ্রতিম শেষযাত্রার লাইভ কমেন্ট্রি সম্প্রচার হয়েছিল রেডিওতে। যে অনুষ্ঠানে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে ‘রবিহারা’ আবৃত্তি করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, সেই অনুষ্ঠানে হেমন্ত গেয়েছিলেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’।

এর ন’বছর বাদে ১৯৫০-এ, যখন বছরে একটা-দুটো নয়, অন্তত চারটে নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরোচ্ছে হেমন্তর, সেই সময় ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত। কলম্বিয়ার বাঘের ছাপ্পা লেবেল সেঁটে মুড়িমুড়কির মতো বিকিয়েছিল ‘বেঙ্গলি টেগোর সং’-এর সেই রেকর্ড, যার নম্বর ছিল জিই ৭৭০১। অবিশ্যি এটাই এ গানের প্রথম রেকর্ডিং নয়। সে কৃতিত্ব পাবেন অনিল বাগচী, হিন্দুস্থান রেকর্ডের লেবেলে। কিন্তু সে রেকর্ডিং কবে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। আর হেমন্তর এই রেকর্ডিং ৭০ বছর পেরিয়ে এমপিথ্রি, ইউটিউব যুগেও সমান জনপ্রিয় রয়ে গিয়েছে।

কলম্বিয়ার বাঘের ছাপ্পা লেবেল সেঁটে মুড়িমুড়কির মতো বিকিয়েছিল ‘বেঙ্গলি টেগোর সং’-এর সেই রেকর্ড, যার নম্বর ছিল জিই ৭৭০১। ছবি- সংগৃহীত

কী জাদু ছিল সেই রেকর্ডিংয়ে? কীর্তনাঙ্গের গানে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ততদিনে বুঝে গিয়েছেন হেমন্ত। নিজের গান নিজেই বাছছেন। এবারেও তাই করলেন। ঝিঁঝিট রাগে বাঁধা গান। গায়নের ধরনটা নিজেই তৈরি করলেন। স্বরলিপি থেকে একচুলও নড়লেন না। খোলের সঙ্গে সমানে বেজে চলল তবলা। সওয়া তিন মিনিটের মধ্যে গাইতে হবে বলে লয়টা একটু বেড়ে গেল এই যা! তাছাড়া প্রিলিউড ইন্টারলিউডের বিরতি নিলেন একেবারেই। সিঙ্গল টেকে গান শেষ! অথচ কী তরতরে! কী টলটলে যৌবন তার দাদরা দোলায়। বিষাদের যে ভাব এ গানে আছে, তাকে অন্তরঙ্গে নিতে পারলে লয় যে অন্তরায় হয় না, একই সঙ্গে বিরহেরও কিনারা ছুঁয়ে যাওয়া যায়, তার অকৃত্রিম উচ্চারণ এই মধুর গানে। ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’ গেয়ে ওঠেন হেমন্ত, কোমল তখন মধুর রসের ভিয়েনে এক আঁজলা শান্ত রসের মোচড় আসে। আরও খোলতাই হয় বৈরাগ্য।

আর একটা ব্যাপার ছিল। ‘ছোট পঙ্কজ’ থেকে ‘হেমন্ত’ হয়ে ওঠার পর্ব যেন শুরু হয়েছিল এই গান দিয়ে। আত্মজীবনী আনন্দধারা-তে হেমন্ত লিখেছেন,

‘এই সময় থেকেই আমি আমার গানের স্টাইলের সম্বন্ধে সচেতন হলাম। গোড়াতে আমি পঙ্কজদাকে অনুকরণ করে গান গাইতাম। সেই ছাপটাই আমাকে এতদিন এগিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আর তো পরের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো চলে না। নিজের পোশাক না হলে চিনবে কী করে লোক? তাই নিজস্ব একটা ভঙ্গীর দিকে নজর দিলাম। প্রথমে নজর দিলাম গানের উচ্চারণের দিকে। খুব স্পষ্ট হওয়া চাই, সেই সঙ্গে থাকা চাই মিষ্টত্ব। যা মানুষকে আকৃষ্ট করবে। এ সব আস্তে আস্তে রপ্ত করলাম। উচ্চারণের ব্যাপারে অবশ্য গোড়া থেকেই আমি খুব সজাগ। উচ্চারণটা যেমন সঠিক হওয়া উচিত, ঠিক সেই সঙ্গে দেখতে হবে স্বাভাবিকতা যেন হ্রাস না পায়। এই সব দিকে তখন খুব নজর দিতে লাগলাম। আর এই করতে করতে নিজের একটা স্টাইল এসে গেল। সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইল, হেমন্ত কণ্ঠের সূচনা হল তখন থেকে।’

এই মধুর সমাপতনে হেমন্তর শেষ যাত্রায় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল এ গান। বারে বারে। সমস্বরে। সেবার পুজোয় কোনও লারেলাপ্পা বাজেনি বাংলায় মণ্ডপে মণ্ডপে। বেজেছিল হেমন্তসঙ্গীত। তার অনেকটা জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। বিশেষ করে এই গানটা। সদ্যপ্রয়াণে সব বিষাদ যেন দমকা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল বাংলার আকাশে। যতই শোকার্ত হই, ‘চিরদিনের সেই আমি’র ওই অস্মিতাকে কিছুতেই ভুলতে দিতে চায়নি বাঙালি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন