বিনায়কের সিদ্ধিলাভ, নোবেলে ফের সেরা বাঙালিই

নোবেলজয়ী অ-শ্বেতাঙ্গ অর্থনীতিবিদ হিসেবে অভিজিৎ তৃতীয়। সেই তিন জনের মধ্যে দু’জনই বাঙালি— বঙ্গবাসীর তা নিয়ে গর্ব হওয়াই তো স্বাভাবিক। 

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৪২
Share:

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

বাঙালি ফের বিশ্বজয়ী।

Advertisement

একুশ বছর পর আরও এক বার অর্থনীতির নোবেল এল কলকাতায়। ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেনের পর ২০১৯-এ সম্মানিত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। দুনিয়াব্যাপী দারিদ্র দূর করার জন্য পরীক্ষামূলক পথের স্বীকৃতি হিসেবেই এল পুরস্কার। তাঁর সঙ্গে পুরস্কার ভাগ করে নিলেন তাঁর স্ত্রী এবং একদা ছাত্রী এস্থার দুফলো, এবং হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমার। অভিজিৎ ও এস্থার হলেন ‘আবদুল লতিফ জামিলা পভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ (জে-প্যাল) নামক গবেষণাকেন্দ্রের যুগ্ম-প্রতিষ্ঠাতা। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে অভিজিৎ আর এস্থার ষষ্ঠ দম্পতি। নোবেলজয়ী অ-শ্বেতাঙ্গ অর্থনীতিবিদ হিসেবে অভিজিৎ তৃতীয়। সেই তিন জনের মধ্যে দু’জনই বাঙালি— বঙ্গবাসীর তা নিয়ে গর্ব হওয়াই তো স্বাভাবিক।

পুরস্কারের সংবাদে বিনয়ী অভিজিৎবাবু বললেন, ‘‘পুরস্কার প্রত্যাশা করিনি। আমার চেয়ে আরও যোগ্য অনেকে আছেন; আমার চেয়ে অভিজ্ঞ, অনেক বেশি দিন অর্থনীতির দুনিয়ায় থাকা মানুষও আছেন।’’ নবজাগরণের বাঙালি সত্তা তো এই উত্তরই দেয়, কারণ বিদ্যা বিনয় দান করে, এই বিশ্বাস বাঙালির মজ্জায়। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক সেই অর্থে বাঙালি। বৃহৎ বাঙালি।

Advertisement

১৯৬১-র ফেব্রুয়ারিতে মুম্বইয়ে জন্ম হলেও কলকাতার সঙ্গে অভিজিতের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতির প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক। যে প্রজন্মের বাঙালির বাংলা আর ইংরেজিতে সমান শিকড় ছিল, সেই প্রজন্মের মানুষ। মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মসূত্রে মহারাষ্ট্রের মানুষ, কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক। সাউথ পয়েন্টের ছাত্র অভিজিৎ অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে, তার পর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচ ডি করেছেন হার্ভার্ডে, আর এক নোবেলজয়ী এরিক ম্যাসকিনের তত্ত্বাবধানে। এমআইটির ‘ফোর্ড ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল প্রফেসর অব ইকনমিকস’ অভিজিৎ তাঁর শিকড়কে ভোলেননি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর হয়েছেন সাগ্রহে। ২০১২ সালে এবিপি আনন্দ তাঁকে ‘সেরা বাঙালি’ হিসেবে সম্মান জানিয়েছিল।

কলকাতার নোবেলজয়ীরা

• স্যর রোনাল্ড রস
১৯০২
চিকিৎসাশাস্ত্র
ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার ‌এবং মানবদেহে তার সংক্রমণ বিশ্লেষণের জন্য

• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯১৩
সাহিত্য
গীতাঞ্জলি রচনার জন্য

• স্যর চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন ১৯৩০
পদার্থবিদ্যা
আলোকরশ্মির বিকিরণ সংক্রান্ত ‘রামন এফেক্ট’ আবিষ্কারের জন্য

• মাদার টেরিজা
১৯৭৯
শান্তি
অনাথ ও দরিদ্রদের
সেবার জন্য

• অমর্ত্য সেন
১৯৯৮
অর্থনীতি
কল্যাণমূলক অর্থনীতি নিয়ে কাজের জন্য

• অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
২০১৯
অর্থনীতি
বিশ্বের দারিদ্র দূরীকরণে পরীক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য

আরও এক ভারতীয়

• কৈলাস সত্যার্থী
২০১৪, শান্তি
বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে
এবং শিক্ষার দাবিতে লড়াইয়ের জন্য

আরও এক বাঙালি

• মুহাম্মদ ইউনূস
২০০৬, শান্তি
বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক মারফত ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি নিয়ে কাজের জন্য

দক্ষিণ কলকাতার মহানির্বাণ রোডের বাড়িতে বেড়ে ওঠা অভিজিতের। তার পাশেই ছিল একটা বস্তি। সেখানেই প্রথম পরিচয় দারিদ্রের সঙ্গে। ছোটবেলায় কাছ থেকে দেখা দারিদ্র তাঁকে একটা কথা শিখিয়েছিল, প্রথাগত অর্থশাস্ত্র যে কথা খুব একটা বলে না— গরিবরাও একেবারেই আর পাঁচ জন মানুষের মতো। তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা, উদ্বেগ, যুক্তি মানা এবং না-মানা, কোনওটাই গরিব বলে অন্যদের চেয়ে আলাদা নয়। অন্যদের সঙ্গে গরিবদের ফারাক মূলত টাকা থাকা আর না-থাকায়।

এই কথাটা এমনি শুনতে যতখানি সহজ, অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ার অন্দরমহলের খোঁজ রাখলে বোঝা যায়, কথাটা আসলে ততখানি সহজ নয়। দারিদ্র নিয়ে চর্চা হয়েছে প্রচুর, কিন্তু সেই আলোচনায় দরিদ্র মানুষকে, শুধুমাত্র দারিদ্রের কারণেই, দেখা হয়েছে কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হিসেবে। তাঁরা হয় অলস, নয় প্রবল উদ্যমী; হয় মহৎ, নয় ছিঁচকে; হয় অসহায়, নয় দুনিয়া জিতে নেওয়ার ক্ষমতাধর। অর্থাৎ, গরিব মানুষ আর যা-ই হোক, সাধারণ লোক নয়। অভিজিৎ বলেছেন, গরিবের এই ছবিগুলো মাথায় রেখে যে সব তত্ত্ব সেরা বাঙালিই
তৈরি হয় দারিদ্র দূরীকরণের জন্য, তার কোনওটাতেই সাধারণ গরিব নরনারীর জন্য বিশেষ জায়গা নেই— তাদের আশা আর আশঙ্কা; সীমাবদ্ধতা আর উচ্চাভিলাষ; বিশ্বাস আর বিভ্রান্তিকে এই তত্ত্বগুলো জায়গা দেয় না। অভিজিৎরা দারিদ্রের চরিত্রসন্ধান করেছেন ব্যক্তি হিসেবে দরিদ্রদের বিভিন্নতার কথা মাথায় রেখে। খুঁজেছেন, কী ভাবে তাঁদের অভ্যন্তরীণ যুক্তিবোধই দারিদ্র থেকে উত্তরণের পথ করে দিতে পারে।
সেই খোঁজ অভিজিৎদের নিয়ে গিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। আর নিয়ে গিয়েছে একটা বিশ্বাসে যে কোনও একটা তত্ত্বের সাধ্য নেই দারিদ্রকে দূর করার। এমন কোনও ম্যাজিক বোতাম নেই, যা টিপলেই দারিদ্রের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। যেখানে যেমন সমস্যা, সেখানে তার জন্য মানানসই সমাধান খুঁজে বার করতে হবে— অভিজিৎ বিনায়কদের দর্শন এটাই। তার জন্য কোথাও হয়তো গরিব মানুষের কাছে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যটুকু পৌঁছে দিলেই যথেষ্ট হয়। কোথাও আবার তাঁদের সামান্য ঠেলে দিতে হয় নিজেদের জন্য ভাল জিনিসটা বেছে নেওয়ার জন্য। কোথায় কোন পদ্ধতি কাজ করবে, অভিজিৎরাও আগেভাগে সে কথা জানেন না। জানতে হয় পরীক্ষার মাধ্যমে। যেমন, সন্তানকে টিকা দিতে নিয়ে গেলে যদি আধ কেজি ডাল পাওয়া যায় বিনামূল্যে, তা হলে কি টিকাকরণের হার বাড়ে? দিল্লিতে গবেষণা চালিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলেন তাঁরা। সত্যিই বাড়ে।
কী ভাবে সেই পরীক্ষা করেন তাঁরা? সহজ করে বললে, তাঁরা বেছে নেন দুটো কার্যত একই রকম জনপদ বা জনগোষ্ঠী, যাদের বৈশিষ্ট্য এক, সমস্যাও এক। একটা জনগোষ্ঠীতে তাঁরা চালু করেন কিছু নতুন ব্যবস্থা, আর অন্যটা চলতে থাকে আগের মতোই। নির্দিষ্ট সময় পর তাঁরা পরিসংখ্যান বিচার করে দেখেন, যে সমস্যার সমাধান খুঁজছিলেন, সেটা পাওয়া গেল কি না। পাকা চাকরির বদলে চুক্তিতে শিক্ষক নিলে কি বাচ্চাদের শিক্ষার মানে উন্নতি ঘটে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য বেছে নিতে হয় একই রকম অনেকগুলো স্কুল। তার কয়েকটাকে আগের মতোই চলতে দিতে হয়, আর বাকিগুলোয় নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করতে হয়। দুই দলের স্কুলে ছাত্রদের শেখার মানের তুলনা করলেই বোঝা যায়, কোন পদ্ধতিটা বেশি কার্যকর। এটাই ‘র‌্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল’। চিকিৎসাশাস্ত্রে বহুলব্যবহৃত এই আরসিটি পদ্ধতিকে অর্থশাস্ত্রে নিয়ে আসার কৃতিত্ব অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের। অর্থশাস্ত্রের দুনিয়ায় এই পদ্ধতির প্রভাব এখন প্রশ্নাতীত, বলছেন দুনিয়াজোড়া অর্থনীতিবিদরা। অভিজিৎ বিনায়কও মানলেন, নোবেল পুরস্কার স্বীকৃতি দিল যে রোগ বুঝে চিকিৎসা করাই উন্নয়ন অর্থনীতির দস্তুর হওয়া ভাল।
অর্থশাস্ত্রেই অবশ্য থেমে থাকেন না অভিজিৎ। বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কণ্ঠস্থ। উপনিবেশ-উত্তর সময়ের ইতিহাস, ভাল জাতের ওয়াইন থেকে রবিশঙ্করের সেতার— ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে পারেন এমন অনেক বিষয় নিয়ে, যার সঙ্গে তাঁর পেশাদারি জীবনের সংস্রব নেই। একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে টানা বাংলায় কথা বলে যাওয়ার খেলায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তেমনই মুশকিল তাঁর মতো রান্নার হাতের খোঁজ পাওয়া। বিদেশের মাটিতে বাঙালি রান্না করতে তাঁর আগ্রহ প্রবল। আগ্রহ মানে কেবল উৎসাহ নয়, জ্ঞান এবং দক্ষতাও। যাকে ঠিক মনে করেছেন, ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে কথা বলতে দ্বিধা করেননি। নোট বাতিলের সুতীব্র সমালোচক ছিলেন অভিজিৎ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ দিন অবশ্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে করা টুইটে লিখেছেন, ‘দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে তাঁর (অভিজিৎ) অবদান উল্লেখযোগ্য’। আবার, গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের সঙ্গে নিজের নাম জুড়তেও দ্বিতীয় বার ভাবেননি অভিজিৎ। সনিয়া-রাহুলের টুইটে সে কথা ফিরে এল।

বৃহৎ বাঙালি এ রকমই হওয়ার কথা। মেধা আর মননের নিখুঁত মিশেল, তার সঙ্গে জীবনকে উদ্‌যাপন করার অপরিসীম স্পৃহা। তাই, এ বছরের নোবেল পুরস্কার বাঙালির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন