Maoists

হাতে ড্রোন, বিদেশি অস্ত্র, ক্ষত সারিয়ে মাওবাদীরা বড় হামলায় তৈরি, বলছে গোয়েন্দা রিপোর্ট

গেরিলাদের জোরদার ধাক্কা দেওয়ার পরেও আত্মতুষ্ট হওয়ার মতো অবস্থায় নেই যৌথ বাহিনী।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ২০:৫৪
Share:

রাতের অন্ধকারে এ ভাবেই সিআরপিএফ ক্যাম্পের উপর উড়ে বেড়াচ্ছে মাওবাদীদের ড্রোন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

যৌথ বাহিনীর লাগাতার অভিযানে গত দু’বছরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সংগঠনের। বিষয়টি স্বীকার করে নিল মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশন। একই সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া হল, মাওবাদীদের খাসতালুক সুকমা-অবুঝমাড় এবং গড়চিরৌলিতেও কোণঠাসা তারা। শুধু দণ্ডকারণ্য এলাকাতেই বাহিনীর হাতে প্রাণ গিয়েছে সংগঠনের ৭৮ জন বিভিন্ন মাপের গেরিলার।

Advertisement

তবে, গেরিলাদের জোরদার ধাক্কা দেওয়ার পরেও আত্মতুষ্ট হওয়ার মতো অবস্থায় নেই যৌথ বাহিনী। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, মাওবাদী প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর সংগঠনের খোলনলচে বদল করে, নয়া কায়দায় প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তৈরি করছেন বাসবরাজ। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ) সপ্তাহে বড়সড় আঘাত হানতে পারে মাওবাদীরা। প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাওবাদীরা পিএলজিএ সপ্তাহ পালন করে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশন সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে একটি নথি বিলি করেছে। সেই নথিতে বলা হয়েছে, ২০১৮-র ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে যৌথ বাহিনীর হানায় ১২৮ জন গেরিলার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে জোনাল বা ডিভিশনাল কমিটির নেতৃস্থানীয় পাঁচ জন। সাংগঠনিক ওই নথিতে খুব কড়া ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে সংগঠনের এক শ্রেণির গেরিলা এবং কর্মীদের বেপরোয়া মনোভাবকে। বলা হয়েছে, ‘সংগঠনের এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ, গেরিলা পদ্ধতি সঠিক ভাবে অনুসরণ না করা এবং ভুল-ত্রুটি শুধরে না নেওয়া।’

Advertisement

ছত্তীসগঢ়ের এই বিস্তীর্ণ এলাকার যে কোনও জায়গাতেই হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আরও পড়ুন: শিবসেনার সঙ্গে জোট নিয়ে অনিশ্চয়তা! পওয়ারের মন্তব্যে বাড়ছে ধন্দ​

সেই সূত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত দু’বছরে সংগঠনের ক্ষতির পাশাপাশি লড়াই করার ক্ষমতাও কমেছে। নিজেদের বাহিনীর সীমিত ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে সংগঠনের বিভিন্ন মাপের নেতৃত্বকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘আগে আত্মরক্ষা এবং তার পর পাল্টা আঘাত।’ ওই নথিতেই উল্লেখ করা হয়েছে, গেরিলাদের মনোবল বাড়াতে যে কোনও হামলার সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই পরিকল্পনা করতে। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত দু’বছর বর্ষাকালে, অর্থাৎ জুন থেকে অগস্ট মাসের মধ্যে দলের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে।

ভুল-ত্রুটি শোধরানোর পাশাপাশি ওই নথিতে বলা হয়েছে, সংগঠন ছেড়ে যাওয়া কর্মীদের একটা বড় অংশ যৌথ বাহিনীর কাছে খবর দিচ্ছে। তাই সংগঠন ছেড়ে যাওয়া কর্মীদের উপর আঘাত করার স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই নথিতে। ছত্তীসগঢ়ে মোতায়েন সিআরপিএফের এক শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘যৌথ বাহিনীর চাপে মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের সংখ্যা বাড়ছে। তা রুখতেই এ বার সংগঠন ছেড়ে যাওয়া কর্মীদের মনে আতঙ্ক তৈরি করে আত্মসমর্পণ রুখতে চাইছেন মাওবাদী নেতৃত্ব।”

মাওবাদী সংগঠনের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের ওই নথিতে গেরিলাদের জন্য ‘কমব্যাট অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্কিল’ বাড়ানোর বিশেষ প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যৌথ বাহিনীর হাতে থাকা আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চার থেকে ছোড়া গ্রেনে়ড এবং রকেট প্রপেলড গ্রেনেডে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ওই আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে বলা হয়েছে গেরিলাদের। মাওবাদী ওই নথি থেকে স্পষ্ট, নিচু এবং মাঝারি মাপের নেতৃত্বের কাজেও খুশি নন শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই কারণে রীতিমতো কর্পোরেট কায়দায় ‘লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট’ প্রশিক্ষণও শুরু করা হয়েছে সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে। সঙ্গে নিচুতলা থেকে উঁচুতলা পর্যন্ত সমস্ত স্তরে স্নাইপার, বুবি ট্র্যাপ এবং দূরনিয়ন্ত্রিত ডিভাইস ব্যবহারের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

সুকমার গ্রামে টহল যৌথ বাহিনীর। —ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ, আহত জেনইউ-র বহু ছাত্র, বিপর্যস্ত দিল্লির মেট্রো পরিষেবা​

সুকমায় কর্মরত সিআরপিএফের ডিআইজি পদমর্যাদার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘মাওবাদী সংগঠনের প্রধান বাসবরাজ নিজে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে মিলিটারি কমিশনের প্রধান ছিলেন। ফলে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরই সামরিক দিক থেকে অনেক পরিবর্তন এনেছেন সংগঠনে, তা সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা থেকে স্পষ্ট।” ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘গত কয়েক সপ্তাহে একাধিক বার আমাদের বাহিনী টহলদারির সময় বা ক্যাম্পে থাকার সময় আকাশে ড্রোন দেখেছে। আমরা নিশ্চিত যে, এটা মাওবাদীদের কাজ। ড্রোন দিয়ে আমাদের উপর নজরদারি করছে।” পর পর এই নজরদারির ঘটনা ঘটার পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে যৌথ বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ড্রোন দেখামাত্রই গুলি করে নামাতে। তবে, এখনও একটিও ড্রোন গুলি করে নামাতে পারেনি যৌথ বাহিনী। গোয়েন্দাদের সূত্রে জানা গিয়েছে, মুম্বইয়ের একটি কোম্পানির কাছ থেকে মাওবাদীরা ওই ড্রোন কিনেছে।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এবং সিআরপিএফের শীর্ষকর্তাদের দাবি, বাসবরাজ দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢেলে সাজা হচ্ছে গেরিলাদের অস্ত্রাগারও। আগে মূলত নিরাপত্তা বাহিনীর ছিনতাই করা অস্ত্র এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই ভরা ছিল মাওবাদী গেরিলাদের অস্ত্রাগার। কিন্তু সুকমাতে পর পর দু’টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর জার্মানির তৈরি অত্যাধুনিক হেকলার-কোচ জি-৩ অটোম্যাটিক রাইফেল উদ্ধার করেছে সিআরপিএফ। ভারতের কোনও নিরাপত্তা বাহিনীই ওই অ্যাসল্ট রাইফেল ব্যবহার করে না। ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান এবং মায়ানমার সেনাবাহিনী ওই অস্ত্র ব্যবহার করে। এর পরেই গোয়েন্দাদের সন্দেহ হয়, এই প্রথম বিদেশ থেকে অস্ত্র চোরাপথে এনে অস্ত্রাগার ভরাচ্ছে মাওবাদীরা।

সেই অনুমান আরও জোরালো হয় এ বছরের গোড়ায় বিহারের পুর্ণিয়া জেলার বৈসি থানা এলাকায় পাঁচটি অটোম্যাটিক রাইফেল উদ্ধার হওয়ায়। অস্ত্রপাচারের সময়ে গ্রেফতার করা হয় মণিপুরের উখরুলের দুই বাসিন্দাকে। সেখান থেকে জানা যায়, এনএসসিএন (আইএম) গোষ্ঠীর নাগা জঙ্গিদের কাছ থেকে আসছিল ওই অস্ত্র। বিহারের অস্ত্রকারবারীদের হাত ঘুরে তা যাওয়ার কথা ছিল মাওবাদীদের হাতে। ওই ঘটনার তদন্ত করছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তদন্তকারীদের দাবি, মায়ানমার থেকে চোরাপথে ওই অস্ত্র পৌঁছচ্ছে মাওবাদীদের হাতে। ২০০৯ সালে মাওবাদী পলিটব্যুরো সদস্য কিষেণজি নাগা জঙ্গিদের থেকে অস্ত্র কেনার প্রাথমিক আলোচনা করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই ফের নাগা জঙ্গিদের সঙ্গে মাওবাদীরা যোগাযোগ করছে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের।

বস্তারের একটি যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প। —ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: যখন যেখানে দরকার যাব, কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই, শিলিগুড়িতে মন্তব্য রাজ্যপালের​

সাম্প্রতিক কয়েকটি সংঘর্ষের পর সিআরপিএফের আধিকারিকদেরও মনে হয়েছে, গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে মাওবাদীরা। এক সিআরপিএফ আধিকারিক বলেন, ‘‘আমাদের সন্দেহ, মাওবাদীদের হাতে আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চারও এসে গিয়েছে।” গ্রাউন্ড জিরোতে মাওবাদী বিরোধী বিভিন্ন অপারেশনে যুক্ত যৌথ বাহিনীর নিচুতলার আধিকারিকদের দাবি, ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এর ব্যবহারে ইদানীং প্রচলিত পদ্ধতি ছেড়ে দূরনিয়ন্ত্রিত (রিমোট) ব্যবহার বাড়িয়েছে মাওবাদীরা।

সেই সঙ্গে যৌথ বাহিনীর চিন্তা বাড়িয়েছে আরও একটি ঘটনা। এক সিআরপিএফ আধিকারিক বলেন, ‘‘সম্প্রতি একটা ঘটনা ঘটেছে, টহলদারির সময়ে হঠাৎ করে যৌথ বাহিনীর ৩৫টি ওয়্যারলেস সেট অকেজো হয়ে গিয়েছিল।’’ পরে জানা যায় ওই সেটগুলো ‘কিল’ করা হয়েছে। শত্রুর হাতে ওয়্যারলেস সেট পড়লে রিমোট পদ্ধতিতে যে কোনও সেটকে ‘কিল’ করতে পারে বাহিনী। কিন্তু ওই ঘটনার পর তদন্তে জানা যায়, যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে বন্ধ করা হয়নি রেডিও যোগাযোগ। এ ক্ষেত্রেও গোয়েন্দাদের সন্দেহ, মাওবাদীরা রেডিও যোগাযোগ অকেজো করার কোনও প্রযুক্তি হস্তগত করেছে।

সব মিলিয়ে তাই মাওবাদী কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের বার্তা ‘সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বড় আঘাত হানতে হবে’, আশঙ্কা তৈরি করেছে যৌথ বাহিনীর মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন