দেশ জুড়ে দেশপ্রেম, উরিতে নাভিশ্বাস

সেনা অফিসারের কড়া গলায় নির্দেশে সঙ্গের দুই জওয়ান কিছুটা দূরত্ব রেখে দু’দিকে সরে দাঁড়ালেন। তিন জন কাছাকাছি এসে গেলে ‘টার্গেট’ বড় হয়ে যায়। সহজ হয়ে যায় লক্ষ্যভেদ করা। গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় বুলেটপ্রুফ হেলমেট। তবু সাবধানের মার নেই। 

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

উরি শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:০৩
Share:

ঘরের জানলা ভেঙে ঢুকে পড়া পাক মর্টার হাতে ফতিমা বিবি।

“ওই যে কাঁটাতারের ও-পারে পাকিস্তানি সেনার চৌকি দেখতে পাচ্ছেন, ওরা কিন্তু প্রতিটা মুভমেন্ট নজর রাখছে। খোলা জায়গায় একদম দাঁড়ানো চলবে না। যে কোনও সময় গুলি ছুড়তে পারে।”

Advertisement

সেনা অফিসারের কড়া গলায় নির্দেশে সঙ্গের দুই জওয়ান কিছুটা দূরত্ব রেখে দু’দিকে সরে দাঁড়ালেন। তিন জন কাছাকাছি এসে গেলে ‘টার্গেট’ বড় হয়ে যায়। সহজ হয়ে যায় লক্ষ্যভেদ করা। গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, মাথায় বুলেটপ্রুফ হেলমেট। তবু সাবধানের মার নেই।

উরি। উত্তর কাশ্মীরের বারামুলা সেক্টর। সামনে পীরপঞ্জল রেঞ্জ। পাহাড়ের গায়ে সাপের মতো কাঁটাতারের বেড়া। ওটাই এলওসি ওরফে নিয়ন্ত্রণরেখা। ও-পারে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর। উঁচুতে পাক সেনার চৌকি। ভারতীয় সেনার চৌকি নীচে। উচ্চতার ‘অ্যাডভান্টেজ’ পাক সেনার।

Advertisement

৫ অগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হওয়ার পর থেকেই নিয়ন্ত্রণরেখা উত্তপ্ত। সুযোগ পেলেই পাক সেনা গোলা, গুলি, মর্টার ছুড়ছে। তার কোনওটা ভারতীয় সেনাচৌকির মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পিছনে পাহাড়ের ঢালে কমলকোট গ্রামে গিয়ে পড়ছে। ৩৭০ রদের পর থেকে দেশ জুড়ে দেশপ্রেমের ডঙ্কা। দিল্লিতে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের মুখে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখলের আস্ফালন। এ দিকে নাভিশ্বাস উঠেছে নিয়ন্ত্রণরেখায় গ্রামের মানুষের।

৬ অগস্ট আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙেছিল ফতিমা বিবির। এক ফালি জমিতে ভুট্টোর চাষ। এক জোড়া আখরোটের গাছ। সকাল সাতটা নাগাদ আগাছা সাফ করছিলেন। ছেলে-মেয়েও হাত লাগিয়েছিল। ফতিমার স্বামী মুবারক কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। এমন সময় শোওয়ার ঘরে প্রচণ্ড আওয়াজ। জানলা ফুঁড়ে পাক-সেনার মর্টার ঢুকে পড়েছে। ১০০ দিন পরেও ফতিমার আতঙ্ক কাটেনি। “ঘুমের মধ্যে মর্টার এসে পড়লে ছেলে-মেয়ে দুটো প্রাণে বাঁচত?” ঘরও মেরামত হয়নি এখনও। ফতিমার গলায় ক্ষোভ, “পয়সা কোথায়? এ বার তো আখরোটও বেচতে পারিনি। সরকারি অফিসে গিয়ে আর্জি দিয়েছি। কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।”

তিন দিক পাহাড়ে ঘেরা উরি টাউনে সেনার ১২ ব্রিগেডের হেডকোয়ার্টার। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে আসা চার জন পাক জঙ্গি এই ছাউনিতেই হামলা চালিয়েছিল। মারা যান ১৮ জন সেনা। তার জবাব দিতেই নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’। উরিতে এখন তিন বছর আগের তুলনায় তিন গুণ সেনা মোতায়েন হয়েছে। অনুপ্রবেশ রুখতে নিয়ন্ত্রণ রেখায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। এক সেনা অফিসার বললেন, “এত দিন মোটামুটি ঠান্ডাই চলছিল। কিন্তু ৫ অগস্টের পর থেকেই উরির এলওসি আবার ‘হট’ হয়ে উঠেছে। সিজ ফায়ার ভায়োলেশন, গুলি বিনিময়টাই রুটিন।”

গাড়ির রাস্তা থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা পাহাড়ি সরু পথ ধরে পায়ে হেঁটে সেনার নানক চৌকি। এই রাস্তা ধরেই জওয়ানদের খাবারদাবার, গোলাবারুদ ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যান কুলিরা। ৪ অক্টোবর কুলিদের উপরে পাকিস্তানের গোলা এসে পড়ে। ইশতিয়াক হুসেন প্রাণ হারান। পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা কোম্পানি কমান্ডার সাবধান করেন, “জলদি হাঁটুন। গতি কমলেই বিপদ। ওদের মর্টারের পাল্লা ৫ কিলোমিটারেরও বেশি।”

নানক চৌকি থেকে পাকদণ্ডি ধরে ঘণ্টাখানেক নামলে বাতার গ্রাম। মহম্মদ সাদিকের বাড়ির ছাদ ফুঁড়ে পাকিস্তানের মর্টার ঢুকে ঘরের দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছে। পাহাড়ের ঢালে সেলিনা বেগমের জমিতে পোঁতা গাছের ডালে লাল কাপড়ের বিপদ নিশান। সামনে বালির বস্তায় ঘেরা পাক কামানের জোড়া গোলা। এক একটার ওজন সাড়ে ৯ কেজি। সেলিনা কথা বুলেটের মতো বেঁধে, “গোলাগুলো ফাটলে আজ আমার দেখা পেতেন না।’’

ফেরার পথে পাকদণ্ডি বেয়ে উপরে উঠতে হাঁফ ধরে যায়। ১৫ কেজির বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের ওজন তখন ৫০ কেজি মনে হচ্ছে। ঘামে ভেজা মাথায় চেপে বসেছে ভারী হেলমেট। কিন্তু শ্বাস নেওয়ার জন্য এক মিনিটও দাঁড়ানোর উপায় নেই। খাদের ও-পাশের পাহাড় থেকে পাকিস্তানি চৌকির অদৃশ্য চোখ বাইনোকুলারে নজর রাখছে। সঙ্গী সেনা জওয়ান সাহায্যের হাত বাড়ান—“নিয়ন্ত্রণরেখায় এটাই জীবন। শহরে বসে সবটা বোঝা যায় না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন