কুবের উবাচ

কোনও মানুষকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়ে সাঁতার কাটতে বলা হলে যে-অবস্থা হয়, প্রসূনের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করতে বসে আমারও ঠিক সেই রকমই অনুভূতি হয়েছে। প্রসূন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। সংসার শুরু করেছেন। পরিবারের কিছু দায়িত্বও নিয়েছেন ইতিমধ্যেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৪ ০১:২৯
Share:

প্রসূন (২৯) • স্ত্রী (২৯) • বাবা (৬২) • মা (৫৩)

Advertisement

রাজ্য সরকারি কর্মী • পেনশন নেই • নিজেদের বাড়ি • দোতলা করতে চান • এখনও সন্তান হয়নি, তবে তার জন্য সঞ্চয়ে আগ্রহী
• পারিবারিক জমি রয়েছে • স্বপ্ন, সুরক্ষিত ও সচ্ছল ভবিষ্যত্‌ • ইচ্ছা, গাড়ি কেনা

Advertisement

শৈবাল বিশ্বাস

কোনও মানুষকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়ে সাঁতার কাটতে বলা হলে যে-অবস্থা হয়, প্রসূনের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করতে বসে আমারও ঠিক সেই রকমই অনুভূতি হয়েছে। প্রসূন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। সংসার শুরু করেছেন। পরিবারের কিছু দায়িত্বও নিয়েছেন ইতিমধ্যেই। এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই আছে। কিন্তু নিজের চিঠিতে তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, লগ্নির ক্ষেত্রে কোনও রকম ঝুঁকি নিতে তিনি আগ্রহী নন। যে কারণে তিনি শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে কোনও কিছু জানতেও চান না। আর ঠিক সেই কারণেই আমার ওই অসহায় অনুভূতি।

প্রসূন রাজ্য সরকারি কর্মী হলেও, তাঁর পেনশন নেই। বেতন বাড়ে মাত্র ৩% হারে। ফলে বুড়ো বয়সের ভাবনা তাঁকে এখন থেকেই ভাবতে হবে। পেনশনের ভরসায় নিশ্চিন্ত অবসর জীবন কাটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এখনও তাঁদের সন্তান হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে সন্তান এলে, তার জন্য যে সঞ্চয় করতে হবে, তা-ও তিনি জানেন। কিন্তু সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, সে সম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই। সব কিছু সত্ত্বেও এই অবস্থায় তিনি সুরক্ষিত প্রকল্পের দিকেই তাকিয়ে থাকতে আগ্রহী। যার রিটার্ন তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই কম।

কিন্তু যেহেতু প্রসূন শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে কিছুই জানতে চান না। তাই তাঁকে সে ভাবেই পরামর্শ দেব। কিন্তু এতে ভবিষ্যতে তাঁর কতটা লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।

লগ্নির খতিয়ান

প্রসূনের মাত্র দু’টি প্রকল্পে লগ্নি রয়েছে। অফিসের জিপিএফ এবং জীবনবিমা। সারা বছরে জীবনবিমার প্রিমিয়াম হিসেবে প্রায় ৪৩,১০০ টাকা জমা দেন তিনি। যার মোট বিমা মূল্য মাত্র ৬.৬৫ লক্ষ টাকা। তাঁর এ ভাবে লগ্নির ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে, কোনও ভাবনাচিন্তা না-করেই এই খাতে টাকা ঢেলেছেন। জীবনবিমার মূল লক্ষ্যই হল যতটা সম্ভব বেশি কভারেজের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা একেবারেই হয়নি। সাধারণ ভাবে দেখা যায়, যে-সব বিমা প্রকল্প একাধারে বিমা এবং লগ্নি হিসেবে প্রচলিত, সেগুলিতে টাকা রাখতে হয় অনেক বেশি। কিন্তু তুলনায় খুবই কম কভারেজ মেলে। আর রিটার্ন যা পাওয়া যায়, তা কখনওই মূল্যবৃদ্ধিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। এখন যদি প্রসূনের হঠাত্‌ করে কিছু হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁর পরিবার মাত্র ৬.৬৫ লক্ষ টাকা পাবে। সেই টাকা কোনও সুরক্ষিত (৯% সুদযুক্ত) প্রকল্পে লগ্নি করলে বছরে পাওয়া যাবে ৫৯,৮৫০ টাকা। অর্থাত্‌ মাসে প্রায় ৫,০০০ টাকা। এই টাকায় তাঁর সংসার চলবে কি না, ভেবে দেখতে হবে। সে জন্য আমার মতে—

প্রসূনের প্রথমেই উচিত বড় অঙ্কের একটা টার্ম পলিসি করিয়ে রাখা।

আপনার যে-ক’টি বিমা রয়েছে, সেগুলির প্রতিটিতেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর বোনাস ঘোষণা করা হয়। সে জন্য প্রথমে সংস্থা বা এজেন্টের থেকে গত কয়েক বছরের বোনাসের অঙ্ক জানতে চান। এর থেকে বুঝতে পারবেন, মেয়াদ শেষে প্রকল্পগুলি থেকে আপনি আসলে কত টাকা পেতে পারেন।

এ বার আপনি কোনও বিমা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। দেখে নিন আপনার লক্ষ্যপূরণে কোন বিমা সাহায্য করবে। সেই অনুসারে আপনি অন্য প্রকল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

পেনশন প্রকল্পে লগ্নি

প্রসূনের পেনশন নেই। যে কারণে তিনি এখনই কোনও পেনশন প্রকল্পে লগ্নি করতে চান। প্রথমেই বলব এ ভাবে কোনও বিমা প্রকল্পের মাধ্যমে পেনশন প্ল্যান কিনে লাভ হয় না। সাধারণত এই প্রকল্পগুলিতে সব মিলিয়ে খরচ অনেক বেশি পড়ে। যে কারণে আমার পরামর্শ—

আপাতত প্রসূনের হাতে মাসের শেষে প্রায় ২,৮০০ টাকা থাকে। সেখান থেকে ২,০০০ টাকার একটি রেকারিং করুন। আপনার ঋণ শোধ হয়ে গেলে রেকারিং-এর অঙ্ক বাড়াতে পারবেন।

এ ছাড়াও স্থায়ী আমানত, পিপিএফ, এনএসসি ইত্যাদি প্রকল্পে লগ্নির কথা ভাবুন। এই খাতে লগ্নি করলে অবসরের ঠিক আগে সেই সব টাকা অ্যান্যুইটি পাওয়া যায়, এমন কোনও প্রকল্পে রাখতে হবে।

প্রসূন না-চাইলেও, আমি বলব তিনি শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে পড়াশোনা করুন। এই বিষয়গুলি নিয়ে ভয় কেটে গেলে, বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে লগ্নির কথা ভেবে দেখতে পারবেন। কারণ, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিটার্ন দিতে পারে একমাত্র বিভিন্ন ইক্যুইটি ফান্ড অথবা সরাসরি শেয়ারে লগ্নিই। অন্য অনেক লগ্নিতেই কর- ছাড়ের মতো বিভিন্ন সুবিধা মেলে। কিন্তু মেয়াদ শেষে দেখা যায়, রিটার্ন প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম।

জমির দেওয়াল তৈরি

নিজেদের জমিতে দেওয়াল তুলতে চান প্রসূন। কিন্তু তাঁর হাতে এখন এমন কোনও নগদ টাকা নেই, যা দিয়ে তিনি এই কাজ করতে পারেন। ফলে আপাতত তা মুলতুবি থাক।

গাড়ি কেনা

তাঁর সমস্ত লগ্নিই অনেক বেশি মেয়াদের। যে-কারণে কোনও বাড়তি টাকা হাতে থাকছে না। ফলে গাড়ির ডাউনপেমেন্ট এখনই করতে পারবেন না। পাশাপাশি, মাসিক কিস্তি মেটানোর মতো টাকাও হাতে নেই। এমনকী বর্তমান ঋণ মিটলেও, আগে সেই টাকা অবসরের জন্য সঞ্চয় করতে হবে।

সন্তানের জন্য সঞ্চয়

প্রসূনের এখনও কোনও সন্তান নেই। কিন্তু তিনি সে জন্য সঞ্চয় করতে চান এখন থেকেই। তাঁর এই মানসিকতা প্রশংসা করার মতো। তবে লগ্নিতে কোনও ঝুঁকি নেব না এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলে শুধুমাত্র রেকারিং বা সুরক্ষিত লগ্নির ভরসায় কতটা লক্ষ্যপূরণ হবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। পাশাপাশি, আপাতত তাঁর হাতে এই লক্ষ্যে জমানোর মতো টাকা নেই। ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায়ও নেই।

স্বাস্থ্যবিমা

চিঠিতে প্রসূন জানাননি, তাঁর বা পরিবারের কোনও স্বাস্থ্যবিমা রয়েছে কি না। না-থাকলে অবিলম্বে তাঁকে একটি ফ্যামিলি ফ্লোটার বিমা করানোর কথা ভাবতে হবে।

মূল্যবৃদ্ধির থাবা

সব শেষে আমি দেখাতে চাই, মূল্যবৃদ্ধি কী ভাবে প্রসূনের জীবন যাপনে প্রভাব ফেলতে পারে

ঋণ ও লগ্নি বাদে এখন তাঁর সংসার খরচ ১০ হাজার টাকা। সন্তান জন্মানোর পর তা দাঁড়াবে ১৫ হাজারে। তাঁর অবসরের সময়ে (৩১ বছর পর) যদি মূল্যবৃদ্ধি ৭% থাকে, তা হলে সেই খরচ পৌঁছবে মাসে প্রায় ৯০,০০০ টাকায়। এ বার দেখি ৮% সুদের কোনও সুরক্ষিত প্রকল্পে কত টাকা রাখলে প্রতি মাসে ওই অর্থ পাওয়া যাবে।

৯০,০০০ X ১২ = ১০,৮০,০০০ টাকা/ বছরে

(১০,৮০,০০০ X ১০০) / = ১.৩৫ কোটি টাকা

অর্থাত্‌ ওই সময়ে তহবিল হতে হবে কমপক্ষে ১.৩৫ কোটি। প্রসূনের বর্তমান লগ্নির ধরণ দেখে বলতে পারি, এই টাকার ধারেকাছেও তিনি পৌঁছতে পারবেন না। যে কারণে তাঁকে বলব ফের সমস্ত পরিকল্পনা খতিয়ে দেখতে ও সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে।

(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement