State News

জিয়াগঞ্জ কাণ্ডের কিনারা, ২৪ হাজার টাকার জন্য খুন, আততায়ী গ্রেফতার সাগরদিঘি থেকে

মুকেশ কুমার জানান, তদন্তে নেমে বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি থেকে একটি রক্তমাখা কাগজ উদ্ধার হয়। সেই কাগজে উৎপল বেহরার নাম পাওয়া যায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৯ ১১:৪৬
Share:

সপরিবার বন্ধুপ্রকাশ। —ফাইল চিত্র।

জিয়াগঞ্জে ভয়াবহ খুনের সাত দিন পর খুনিকে ধরিয়ে দিল রক্তমাখা একটি বিমার কাগজ! মুর্শিদাবাদের জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন, ধৃতের নাম উৎপল বেহরা। বছর কুড়ির ওই তরুণের বাড়ি মুর্শিদাবাদেরই সাগরদিঘি থানার সাহাপুর গ্রামে। ২৪ হাজার টাকার একটি বিমা নিয়ে গোলমালের জেরেই আক্রোশবশত ওই খুন করেছিল বলে জেরায় জানিয়েছে উৎপল। আদালতে হাজির করানোর পর ধৃতকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আপাতত ১৪ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।

Advertisement

গত ৮ অক্টোবর অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দুপুরে জিয়াগঞ্জের বাড়িতে খুন হন স্কুলশিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পাল। তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বিউটি ও পাঁচ বছরের ছেলে অঙ্গনকেও খুন করা হয়। তিন জনকেই হাঁসুয়া দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপানো হয়েছিল। তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথমে দিশাহীন হয়ে পড়ে। খুনের মোটিভ এবং খুনি কে, তা বুঝে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। তার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক নানা তরজাও শুরু হয়ে যায়। বন্ধুপ্রকাশের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের একাধিক লোকজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কিন্তু অজানা অনেক তথ্য উঠে এলেও খুনের সঙ্গে তেমন কোনও যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

এ দিন মুকেশ কুমার জানান, তদন্তে নেমে বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি থেকে একটি রক্তমাখা কাগজ উদ্ধার হয়। সেই কাগজে উৎপল বেহরার নাম পাওয়া যায়। সেই সূত্রেই তাকে গত কয়েক দিন ধরে জেরা করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের সময় বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। চাপের মুখে একটা সময়ে ভেঙে পড়ে সে। এর পরেই সোমবার রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। খুনের কথা স্বীকারও করে উৎপল।

Advertisement

আরও পড়ুন: বীরভূমের গরমও তাঁকে কাবু করতে পারেনি

তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, বন্ধুপ্রকাশ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন বিমা কোম্পানির সঙ্গেও কাজ করতেন তিনি। উৎপল বেহরারও একটি বিমা করান বন্ধুপ্রকাশ। আর সেই বিমা নিয়েই যত গন্ডগোল। মুকেশ কুমারের দাবি, উৎপল রাজমিস্ত্রির কাজে মাঝে মাঝে বাইরে গেলেও, মূলত বেকার ছিল। বন্ধুপ্রকাশ তাকে দিয়ে যে বিমাটি করিয়েছিলেন, তার বাৎসরিক প্রিমিয়াম ছিল ২৪ হাজার ১৬৭ টাকা। পুলিশি জেরায় উৎপল জানিয়েছে, বিমা করানোর পর প্রথম বারের টাকার রসিদ বন্ধুপ্রকাশ তাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন হয়ে গেলেও দ্বিতীয় প্রিমিয়ামের রসিদ আর দেননি। রসিদ চেয়ে বার বার তাগাদা দিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে পুলিশকে জানিয়েছে উৎপল। উল্টে তার সঙ্গে বন্ধুপ্রকাশ অভদ্র আচরণ ও গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ। মুকেশ কুমারের দাবি, এ সব মিলিয়ে উৎপলের সন্দেহ হয় বন্ধুপ্রকাশ আদৌ তার প্রিমিয়ামের টাকা জমা দেননি। তার পরেই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় উৎপল, জেরায় এমনটাই সে জানিয়েছে বলে পুলিশ সুপারের দাবি।

আরও পড়ুন:জিয়াগঞ্জ তদন্ত: নানান সন্দেহে ঘুরপাক খেতে খেতে কী ভাবে উৎপলকে ধরতে পারল পুলিশ

জেরার সময়ে পুলিশকে উত্পল জানিয়েছে, গত ৩ অক্টোবর বন্ধুপ্রকাশকে শেষ বার সে ফোন করে। উৎপল তখন পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় রাজমিস্ত্রির কাজে ছিল। এর পর ৮ অক্টোবর অর্থাৎ খুনের দিন সকালে জিয়াগঞ্জে যায়। সেখানেই তার বোনের বাড়ি। পুজোর জামাকাপড় বোনের বাড়িতে দেওয়ার পর দুপুরের দিকে যায় বন্ধুপ্রকাশের বাড়িতে। সঙ্গে ছিল হাঁসুয়া। পুলিশের কাছে সে জানিয়েছে, খুনের জন্য তৈরি হয়েই সে ওখানে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন: পাঁচ মিনিটে তিনজনকে কি একাই খুন করেছিল উৎপল? এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ

পূর্ব পরিচিত হওয়ায় উৎপলকে দেখে ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন বন্ধুপ্রকাশ নিজে। দরজা খুলে ভিতরে ঢোকার পরেই উৎপল তাঁর গলায় হাঁসুয়ার কোপ বসিয়ে দেয়। আচম্বিতে হাঁসুয়ার কোপে আহত হয়ে পাশের বিছানায় লুটিয়ে পড়েন বন্ধুপ্রকাশ। এর পর তাঁর উপর এলোপাথাড়ি হাঁসুয়ার কোপ মারে উৎপল। পাশের ঘরেই ছেলেকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন বন্ধুপ্রকাশের স্ত্রী বিউটি। উৎপল পাশের ঘরে ঢুকে তাঁদের দু’জনকেও কুপিয়ে খুন করে। মুকেশ কুমারের দাবি, উৎপলকে আগে থেকেই বিউটিরা চিনতেন। কারণ বন্ধুপ্রকাশের স্কুল যেখানে সেই সাহাপাড়াতেই উৎপলের বাড়ি। শুধু তাই নয়, বন্ধুপ্রকাশদের গ্রামের বাড়িও ওই সাহাপুরেই। কাজেই তাঁদের পক্ষে উৎপলকে চিনে ফেলাটা খুবই সহজ ছিল। মুকেশ কুমারের দাবি, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিন জনকে খুন করে পালিয়ে যায় উৎপল। খুনের সময়, দুপুর ১২টা ৬ থেকে ১১-র মধ্যে। কেন না, ১২টা ৬ পর্যন্ত বন্ধুপ্রকাশের স্ত্রী বিউটি পাল একটি ভিডিয়োকলে কথা বলেছেন। ওই ফোন শেষ হয় ১২টা ৬-এ, আর ১২টা ১১ মিনিটে দুধবিক্রেতা এসে কড়া নেড়ে সাড়া পাননি। সাড়া পাননি ফোনেও।

আরও পড়ুন: ঘণ্টা চারেক নিশ্চুপ থাকার পরে অভিনন্দন মোদীর, অভিজিৎ নোবেল পাওয়ায় শাঁখের করাতে বিজেপি?

মুকেশ কুমারের দাবি, খুনের দিন উৎপল একটা গোলগলা গেঞ্জি, তার উপর টি-শার্ট এবং একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের উপর ফুল প্যান্ট পরে বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি গিয়েছিল। খুনের পর সে সেখান থেকে বেরিয়ে রক্ত লাগা টি-শার্ট আর ফুলপ্যান্ট খুলে রাস্তাতেই ফেলে দেয়। এর পর সোজা চলে যায় সাহাপুরের বাড়িতে।

উৎপল গ্রেফতারের পর জিয়াগঞ্জে তার বোনের বাড়িতে স্থানীয় বাসিন্দারা জড়ো হন। তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। ওই বাড়িতে বসেই খুনের ছক কষা হয়েছিল বলে দাবি করেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার চেয়ারম্যান প্রসেনজিৎ ঘোষ। তিনি জানান, বন্ধুপ্রকাশ এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র খুনের পর এলাকায় বিজেপি একটি মিছিল করে। সেই মোমবাতি মিছিলে হেঁটেছিলেন উৎপলের ভগ্নিপতি পুলক সরকার। প্রসেনজিতের প্রশ্ন, যে বোনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুনি এত বড় একটা কাণ্ড ঘটাল, সেই ভগ্নিপতি খুনের ব্যাপারে কিছু জানতেন না? তিনি কী করেই বা রাজনৈতিক খুনের অভিযোগ তুলে বিজেপির মিছিলে হাঁটলেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন