Devabhasha Gallery

সাত শিল্পী-ভাস্করের ২৫ সিদ্ধিদাতা নানা রূপে

দেবভাষা-র গ্যালারিতে সম্প্রতি শেষ হল ‘সিদ্ধিদাতা’ প্রদর্শনীটি।

Advertisement

অতনু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ ০০:৪০
Share:

গজানন: প্রদর্শনীতে শিল্পী যোগেন চৌধুরীর অঙ্কিত ছবি

শিব-দুর্গার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে নিয়ে গোটা ভারতের অজস্র চিত্রকর-ভাস্করের আগ্রহ ও আপামর জনগণের উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। সে ব্যবসা, উৎসব, পুজো, শিল্পকলা... সব কিছুতেই। শুধুমাত্র চিত্রকলা-ভাস্কর্যের সংগ্রহে গজাননকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী শিল্পরসিকদের প্রথম থেকেই আগ্রহ তুঙ্গে। অতএব বেশ কিছু শিল্পীও উৎসাহিত হয়ে ফরমায়েশ, বরাত অনুযায়ী কাজ করেন। অনেকে সৃষ্টির আনন্দে, স্বতঃস্ফূর্ততায় বিচিত্র সব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সিদ্ধিদাতার অনবদ্য শৈল্পিক সুষমাকে উপলব্ধি করান।

Advertisement

দেবভাষা-র গ্যালারিতে সম্প্রতি শেষ হল ‘সিদ্ধিদাতা’ প্রদর্শনীটি। কাজগুলিতে প্রধানত রেখা-নির্ভরতার দিকটি উল্লেখযোগ্য। সে দিক থেকে ড্রয়িং বেশ উপভোগ্য। অলয় ঘোষালের কাজগুলি ছাড়া পেন্টিং কোয়ালিটি এসব ছোট কাজগুলিতে সেভাবে প্রকাশিত নয়। বর্ণকে প্রয়োজনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা স্বাভাবিক, শিল্পীর নিজস্ব স্টাইলের কাজে। আবার বর্ণ এখানে গূঢ়, উজ্জ্বলতম হয়েও আপাত-অদৃশ্যের মায়া তৈরি করেছে। ভলিউম, টোন, ফর্ম, লাইন— এগুলিই ছবি-ভাস্কর্যের অন্যতম গুণ, যা প্রায় প্রতিটি কাজ পর্যালোচনা করলে বেরিয়ে আসে। যদিও লাইন বা রেখার নির্দিষ্ট গতিই কাজগুলির গভীরতা, স্টাইল সেখানে তার অন্তরঙ্গ সহযোগী।

গণেশ হালুই সংবেদনশীল ও সংক্ষিপ্ত রেখার কাব্যময় রূপায়ণ করেছেন। গোটা সাদা পটের এক পাশে ও মধ্যবর্তী অংশে ব্রাশের কালো রেখা বর্তুল হয়ে থেমে গিয়েও থামছে না। সেই রেখার অন্য অংশ বঙ্কিম ও আপাত-আলঙ্কারিক ঢঙে নির্মাণ করছে শরীরের প্রধান অংশ শুঁড়টিকে। গোলাকৃতি মুখের দু’পাশে দু’টি চোখ। এই অতি সরলীকরণ ও সংক্ষিপ্ততর ভাবনার রূপান্তর সমগ্র সিদ্ধিদাতার অনন্যসাধারণ রূপক। বর্ণহীন রেখাই এখানে এক ও অদ্বিতীয়।

Advertisement

রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেখানির্ভর ড্রয়িং সম্পর্কে মানুষ অবহিত। এখানেও চারটি কাজে রেখাই প্রধান। চিকন ও অপেক্ষাকৃত রেখায় শিশু গজাননের আদুরে রূপকে প্রস্ফুটিত করেছেন। সে ক্ষেত্রে গণেশজননী ও সখীর আটপৌরে রূপের প্রকাশ খুবই স্নেহবৎসল। শিশু গণেশকে আগলে রাখার এই ধরনটি তাঁর অতিকাব্যিক ও ছন্দোময় রেখার প্রাবল্যে আরও মোহময়। বর্ণ বিচ্ছুরিত নয়, হঠাৎ এসে চকিতে অদৃশ্য হওয়া দ্যুতির মতো। আলঙ্কারিক সজ্জার সংক্ষিপ্তসার, রেখার টানটোন, লৌকিক সারল্য বড়ই লাবণ্যময়। মূষিকের ভঙ্গিও অসামান্য। যদিও অনেকের কাজেই মূষিক অদৃশ্য তাঁর রচনার প্রেক্ষিতে।

লালচে খয়েরি ক্রেয়নের বর্ণে সমবর্ণের আপাতগাঢ় রেখা ও কালো রেখার দু’টি ছোট ড্রয়িং করেছেন লালুপ্রসাদ সাউ। দক্ষিণী গণেশের রূপ যেন! যোগেন চৌধুরীর পঞ্চরূপের সিদ্ধিদাতাও রেখাপ্রধান। মোটা রেখার কম্পমান চলন ও দৃঢ় ভঙ্গির স্টাইল শুঁড় ও মুখের ক্ষেত্রে বিবর্তিত হয়ে আশ্চর্য অনুরণন ও ছন্দ তৈরি করছে। সামান্য ঘষামাজা বর্ণ, না দিলেই নয় এমন। জ্যামিতিক কাঠামোর কোমল রূপও পরিলক্ষিত। তাঁর সমগ্র রেখার মধ্যে হঠাৎ থামা ও না থেমে বেঁকে বা ঘুরে যাওয়া বিলম্বিত লয়ের মতো কখনও। আবার দ্রুততার সঙ্গে অকস্মাৎ দিক পরিবর্তন করে, আবয়বিক অন্য প্রত্যঙ্গের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশে যাওয়া— এই চমৎকারিত্ব তাঁর কাজগুলিকে দাঁড় করিয়ে রাখে। সেই সঙ্গে অন্যান্য অনুষঙ্গ যেমন ফুল, লতাপাতা, আসন, অলঙ্কার... সবেতেই দ্রুতবিবর্তিত স্টাইল লক্ষ করার মতো।

বিমল কুণ্ডুর বড় ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যটি জ্যামিতিক রূপারোপের অপূর্ব দৃষ্টান্ত। হেলান দেওয়া ভঙ্গির মতো মাটিতেই আধশোয়া গজানন। কাঁধ, পেট, বুক, শুঁড়, মাথা, হাত, পা... শিল্পী সমস্ত জায়গাতেই রূপকে উচ্চাবচ অবস্থায় জ্যামিতিক ফর্মেশনে গড়েছেন। তৈরি হয়েছে ত্রিমাত্রিক রেখার এক আশ্চর্য সমন্বয়। ছোট, প্রায় বর্তুলাকার অন্য ভাস্কর্যটি ডৌলপ্রধান ও আঁটসাঁট। তবে লাবণ্য পরিস্ফুট। তাঁর কিরিকিরি রেখায় করা ড্রয়িং দু’টিও অসামান্য। ফর্ম-ই এখানে অদৃশ্য রেখার পরিপূরক। দুঃসহ সময়ে গণেশও অসহায়, বাটি হাতে তিনি ভিক্ষা প্রার্থনাকারী। অন্যটির মুখ দেখলে হঠাৎ রামগরুড়ের ছানার কথা মনে হয়। বাঁ-কানটি অদ্ভুত ভাবে স্টাইলাইজ় করেছেন। অর্বুদ রেখার ঘূর্ণনে সৃষ্ট প্রতিমাকল্পে ভাস্কর্যগুণ উধাও হয়নি।

অলয় ঘোষাল মন্দিরগাত্রের মূর্তির মতো রূপ দিয়েছেন গণেশকে। লাইট-শেড সমন্বিত কাজগুলিতে ভলিউম প্রাধান্য পেয়েছে। মোটা বর্ণের ঘষামাজা ও রেখা-নির্ভরতায় কৃষ্ণেন্দু চাকীর কাজ অনেকটা সচিত্রকরণের মতো। নিঃসন্দেহে গণেশ নিয়ে এই প্রদর্শনীটি বেশ উপভোগ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন