Bhanu Banerjee

লর্ড ভানু ব্যাটিং ১০০...

কৌতুকের ছদ্মবেশে যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা শিল্পী। হাসির মোড়কে চিরকালীন বাঙালিয়ানার মায়াকাজল। কৌতুকের ছদ্মবেশে যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা শিল্পী। হাসির মোড়কে চিরকালীন বাঙালিয়ানার মায়াকাজল।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৫:১৩
Share:

‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’ সে-বার ঘোর বিপদে পড়েছেন। তিনি তখন পেশায় ‘জেনারেল কনসালট্যান্ট’। তাঁর ভাষায়, ‘‘লোকেরে সব বিষয়ে জ্ঞান দেই।’’ ফি ১২ টাকা (নিজে ন’টাকা, দালালের তিন)। বাড়ির বাইরে বিরাট সাইনবোর্ড ‘লর্ড ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’।

Advertisement

খামোখা লর্ড কেন লিখতে গেলেন? ‘এটা কী করলে? মামলায় পড়ব তো!’ ভানুকে সাবধান করতে এগিয়ে এলেন জনৈক হিতৈষী। ভানু তাঁকে জলের মতো সহজে লর্ড-রহস্য বুঝিয়ে দিলেন।

‘‘ব্যাপার হইল কী জানেন, দ্যাশে তো কিসু জমিজমা আমার আছিল, জমি থাকা মানেই ল্যান্ডলর্ড। দ্যাশ বিভাগের পর ল্যান্ড তো গ্যাল, পইড়া রইল লর্ড। লর্ডেরে রাখি কই! নামের গোড়ায় লাগাইয়া দিসি।’’

Advertisement

এই ‘কৌতুক নকশা’ তখন মুখে মুখে ঘুরছে। অনেকেই তা সত্যি বলেও বিশ্বাস করতেন। ভানুই পারতেন, হাসির মোড়কে ‘রিফিউজি বাঙাল’ বলে লাঞ্ছিত অজস্র ঘা-খাওয়া মানুষের কপালে লর্ড-টিকা পরিয়ে দিতে। দেশভাগের মতো একটা ইতিহাসের ট্র্যাজেডিকেও এ ভাবে গভীর মমতা কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতার আতসকাচে পাল্টে ফেলা যায়! ঠাট্টার ছুরিতে বঙ্গসমাজের চিরকেলে বনেদি শ্রেণি-চেতনাও তাতে ফুটিফাটা। তখন বাঙালির বিনোদন জগৎও ঘটি-বাঙালের তরজায় ভরপুর। উত্তমকুমার-শ্যামল মিত্তির সব মোহনবাগান। ‘ট্রেডমার্ক বাঙাল’ ভানুর চোখে ব্যাকরণসম্মত গালাগালিতে তুখোড় দুই ঘটি ব্যারিটোন স্বর কমল মিত্তির আর কালোদাও (অসিতবরণ)। হতেই পারে তাঁদের সঙ্গে তক্কাতক্কিতেও ভানুর তুণে এ সব রসিকতার তির মজুত হয়েছে।

ভাঁড়ামো করে হাসানোর সঙ্গে এই হাসির ফারাক আছে। তখন জলসা মানেই গানের ফাঁকে ফাঁকে কৌতুক নকশার অনিবার্য ঝিলিক। সিনেমার রোম্যান্টিক প্রেমের মধ্যেও খুচরো হাসি গুঁজে দেওয়া দস্তুর। টেলিভিশন-পরবর্তী যুগে ‘স্ট্যান্ডআপ কমেডি’র প্রতিযোগিতা বেড়েছে। কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে জলসার যুগে তা আরও স্বতঃস্ফূর্ত। মঞ্চে বা পর্দায় ছকে-বাঁধা ডায়ালগের বাইরে ‘রেডি উইট’ তখন অনেক তাবড় অভিনেতারও নেশা। এমনকি ছবি বিশ্বাসও এ ব্যাপারে তুখোড়। ভানু গুরুস্থানীয় মানতেন, কমেডিয়ান তুলসী লাহিড়ী, ইন্দু মুকুজ্জেদের (অভিনেতা শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের বাবা)। বিস্মৃত নবদ্বীপ হালদার, ঢাকাইয়া রঞ্জিত রায় থেকে পঞ্চাশের দশকে জুটি বাঁধা জহর রায়-অজিত চট্টোপাধ্যায়রাও সে যুগের ফসল। এক-এক ধরনের নিজস্ব শরীরী ভাষা বা বাচনভঙ্গি, মান্যগণ্যদের ভেংচি-কাটা শ্লেষ থেকে নির্ভেজাল আনন্দও এই পারফরম্যান্সের উপাদান। ভানু কিন্তু এখানেই আটকে থাকতে চাননি। তাঁর বিভিন্ন লেখালিখি, সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট, তিনি বরাবর আরও বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতার খোঁজ করেছেন, যা থেকে যাবে। ঢাকার ভানুর স্নেহশীল মাস্টারমশাই বিজ্ঞানী-অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছাত্রের এই মর্ম বুঝতে পেরেছিলেন।

আমার কাছে গোল্লা, ভানুর কাছে রস

ঢাকার জগন্নাথ কলেজে তরুণ ভানুর শিক্ষকদের লিস্টি দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হবেই! কবি জসীমউদ্দিন, মোহিতলাল মজুমদার, মহম্মদ শহিদুল্লা, রমেশচন্দ্র মজুমদার... ক্লাস কামাই করায় জসীমউদ্দিন বকাবকি করেন, ‘‘এমন চললে তোমায় পরীক্ষায় বসতে দেব না!’’ শুনে ঢাকা রেডিয়োর তরুণ আবৃত্তিকারের জবাব, ‘‘স্যর, তা হলে আমিও আপনার কবিতা রেডিয়োয় কমুনা!’’ আর হাঁটার ছন্দে ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে পদচারণার জন্য বিখ্যাত শহিদুল্লা স্যরের নাম ভানু দিয়েছিলেন ‘টাট্টু ঘোড়া’! কথাটা কানে যেতে তিনি হেসে জানতেও চান, তুমি কি সব সময়েই এমন রসিকতা করো!

ঢাকার বাতাসের রসবোধ ঢাকাই পোলা জীবনভর বহন করেছেন। যেমন কুট্টি গাড়োয়ানদের সান্নিধ্য তাঁর রসিকতা আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে। একেবারে শৈশবে বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সংস্পর্শে এসে ভানুর সত্যিকারের গোয়েন্দাগিরির গল্প এখন সুবিদিত। ঢাকার সদরঘাটে আট বছরের একটি ছেলে চুপটি করে ঘুরে কোন সাহেব বা পুলিশকর্তা কখন আসছেন, টাঙ্গায় চড়ে শহরের কোথায় যাচ্ছেন... খবর রাখত। পরে দীনেশদার সাইকেলের পিছনে বসে সব খবর দিতে হত। এ ভাবেই কত জনের কত ‘ম্যানারিজ়ম’ পাখি-পড়া হতে থাকে অজান্তে। ঢাকার বিখ্যাত কুট্টি গাড়োয়ানদেরও এই সময় থেকেই ভানু কাছ থেকে দেখেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ১৯৪৩-এ, তাঁর প্রথম কমিক স্কেচ কুট্টিদের নিয়ে। পরে পশ্চিমবঙ্গীয় দর্শকদের জন্য তাঁর রসিকতার বিষয়বস্তুও যুগের সঙ্গে পাল্টেছে।

ভানু বিএ ক্লাসের ছাত্র হলেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পদার্থবিদ্যার ক্লাসে লেকচার শুনতে যেতেন। তখন থেকেই আমৃত্যু দু’জনের সম্পর্ক। ঢাকায় থাকতেই ‘সত্যেনদা’র জন্মদিন পালনও করতেন ভানু। পরেও কলকাতায় দেখা হলে যশস্বী ছাত্রটির কাছে কলেজজীবনের সব কমিক স্কেচই শুনতে চাইতেন জগদ্বিখ্যাত মাস্টারমশাই। সত্যেন বসুর একেবারে শেষ জীবনের একটি ঘটনা। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে ভানু তখন সরকারি যাত্রা সম্মেলনের সভ্য হয়েছেন। কোনও একটা বড়সড় আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে। বসুশ্রী সিনেমা হলের আলোচনায় বসে ভানু তরুণ সংস্কৃতিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে সম্মেলন উদ্বোধনের প্রস্তাব দিলেন সত্যেন বসুকে দিয়ে।

সেই মতো জনৈক সরকারি আমলা সত্যেন বসুর হেদুয়ার ঈশ্বর মিল লেনের বাড়িতে পৌঁছেও যান। ফিরে এসে তাঁর বিবৃত অভিজ্ঞতা অনেকটা এই রকম— সত্যেনবাবু প্রথমে শুনেই বলেন ভানু থাকতে তিনি কেন উদ্বোধনে যাবেন! ওই সরকারি আধিকারিক বোঝান, ভানুবাবু নিজেই উদ্যোগটির শরিক। কিন্তু প্রবীণ বিজ্ঞানী যেতে রাজি হননি। তিনি আমলাপ্রবরকে রসগোল্লায় আপ্যায়ন করেন। তার পরে বলেন, ‘‘এই যা খাচ্ছ, আমার কাছে এই গোল্লাই পাবে, প্রকৃত রসটা ভানুর কাছে রয়েছে।’’

রসগোল্লার রসে অবশ্য বেমক্কা বিষমও লাগে। ভানুর রসিকতা খানিকটা সে-রকমও বটে।

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে পার্ট পাননি?

বসুশ্রীতে সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’র শোয়ের শেষে বেমক্কা প্রশ্ন করেছিলেন কোনও সাংবাদিক। শুনে ভানুর ঝটিতি জবাব, লেখাপড়া না-জানলে উনি (সত্যজিৎ রায়) তাঁর ছবিতে পার্ট দেন না। শুনে অপ্রস্তুত সত্যজিৎ রায় তখনই ‘না-না’ বলে ওঠেন। সবিনয় বলেন, আমি ওঁর খুবই গুণগ্রাহী। উপযুক্ত রোল থাকলে অবশ্যই ভানুবাবুকে নেব। পরেও ‘বিরল অভিনেতা’ ভানুর প্রশংসা করেন সত্যজিৎ। এবং সেই সঙ্গে আক্ষেপ, বাংলা ছবিতে ক্ষমতাবান জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতাদের দিয়ে সামান্য ভূমিকায় অভিনয় করিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ অনেক দিন থেকে চালু আছে। তুলসী চক্রবর্তীর ক্ষেত্রেও অনেকটা সময় এমন ঘটেছে।

মঞ্চে ‘নতুন ইহুদি’, সিনেমায় ‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ ভানুকে দেখার মুগ্ধতার কথাও সত্যজিৎ বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর ছবিতে শেষ পর্যন্ত ভানুর অভিনয়ের সুযোগ হয়নি। দু’জনের পরিচয় অবশ্য ‘পথের পাঁচালী’র সময় থেকে। বসুশ্রীতে ছবিটা দেখে মন্টু বসুদের অফিসঘরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিলেন ভানু। সত্যজিৎও তখন সেখানে বসে। ভানু তাঁকে চেনেন না। পরিচয় হতেই ভানুর ভবিষ্যদ্বাণী, ‘‘মশাই, করেছেন কী! আপনি তো কালে-কালে কাননদেবীর মতো বিখ্যাত হবেন!’’

কমেডিতে ভানুর জুড়িদার জহর রায় তবুও সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের ছবিতে কিছু মনে রাখার মতো চরিত্র পেয়েছেন। ভানুর ইন্ডাস্ট্রিতে উঠতি-পর্বের বন্ধু ঋত্বিক ঘটকও। রাসবিহারীর মোড়ে অমৃতায়নে তখন ভানু, পরিচালক মনোজ ভট্টাচার্য, দুলাল গুহ, সলিল সেনদের ঠেক। ঋত্বিক, মৃণাল সেন, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়েরা প্রধানত হাজরার প্যারাডাইস কাফেয় থাকতেন। কখনও পারস্পরিক ঠেক বদলও ঘটত। সেই আড্ডা থেকে নানা কাজের দরজা খুলত।

উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে

হাল্লা রাজার মন্ত্রী জহর রায়ের গু-গা-বা-বা যে দিন রিলিজ় করল, ভানু তখন বাইরে বিজলির সামনে পিকেটিং করছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, রবি ঘোষ, সৌম্যেন্দু রায়েরা তাঁর সঙ্গী। সেন্সরের তারিখ অনুযায়ী অন্য কয়েকটি ছবিকে টপকে ‘গুপী গাইন...’ আগে রিলিজ় করা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির ভিতরেই তুমুল মতবিরোধ ছিল। উত্তমকুমারের নেতৃত্বে টালিগঞ্জের মহারথীরা অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। সে সময়ে অভিনেতৃ সংঘের ঐক্যেও ফাটল ধরে। উত্তমকুমারের নেতৃত্বে অনেকেই বেরিয়ে গিয়ে ‘শিল্পী সংসদ’ গড়ে তোলেন। উত্তমপন্থীদের এই বিরোধিতার জন্য ভানুবাবুদের দামও দিতে হয়েছে। টানা রোদে দাঁড়িয়ে ভানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। টালিগঞ্জ থেকে তাঁদের বহিষ্কৃত হওয়ার কথা ওঠে। পরে অবশ্য উত্তমের সঙ্গে বিলক্ষণ ভাব হয়ে গিয়েছিল।

সত্যজিতের ছবিতে তো কোনও দিনও একটা পার্টও পেলে না! তবু কেন এই সত্যজিৎ-প্রীতি? স্ত্রী নীলিমার কাছেও ভানুকে এমন প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। কিন্তু ভানুর কাছে বরাবরই আগে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান। তখন বামপন্থী সিনেমাহল কর্মী-কলাকুশলীদের সংগঠন সত্যজিতের ছবির পক্ষে থাকায় ভানুও পক্ষ নিতে দ্বিধা করেননি।

ভানুর ছবি বিদেশে চলচ্চিত্র উৎসবে যায়নি। তা সত্ত্বেও নিজেকে ‘কমপ্লিট অ্যাক্টর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারার গরিমা তাঁকে আরও মহিমান্বিতই করেছে।

ভানু একাই ১০০

কৌতুকাভিনেতা নন, ভানু যে একজন সম্পূর্ণ অভিনেতা, এ কথাটা বারবার বলতেন তপন সিংহ। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর অনুজপ্রতিম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ভানুর প্রয়াণের পরে আনন্দলোকে তাঁর ভানুদাকে নিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন।

ভানুর হিট ছবিগুলোও আজ দেখতে বসলে হয়তো অনেকেই সে-যুগের কালোচিত কিছু দোষ খুঁজে পাবেন। কিন্তু তা বলে ভানুর গভীর জীবনবোধের স্বাক্ষর চিনতে ভুল হয় না। অভিনয়ের ছোট-ছোট ডিটেলিংয়ে ভানু, জহর, তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, উৎপল দত্তের মতো শক্তিশালী অভিনেতারা অনেকেই আমাদের চমৎকৃত করেন। ‘সাড়ে চুয়াত্তরে’ পরিচালক নির্মল দে-র চিত্রনাট্যও ভানুর অভিনয়ের তোড়েই পাল্টে গিয়েছিল। ‘মাসিমা মালপো খামু’ থেকে অনেক সংলাপই ভানুর ‘ইম্প্রোভাইজ়েশনে’র ফসল বলে শোনা যায়।

চোখ-মুখ শরীরের কিছু চিরকেলে ভঙ্গি অনেক অভিনেতার ট্রেডমার্ক বলেও ধরা হয়। ভানুর প্রথম দিকের ছবিতে তার কিছু আভাস মেলে। ভানু তখন গর্বিত ২৯ ইঞ্চি ছাতির মালিক। ত্রিশোর্ধ্ব তরুণকে ছেলেমেয়ের বাপ বলে বোঝাই যায় না। তাঁর চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের ছোটরাও ভানুর বয়স বুঝতে না-পেরে নাম ধরে ডেকে ফেলেন। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর সময়ে ভানুর একটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো, লিকপিকে শরীর খানিক ধনুকের মতো পিছনে বাঁকিয়ে দেখার ভঙ্গি ছিল। ওই ভাবেই হঠযোগ আর শাকপাতার ভক্ত ‘কামাক্ষ্যা’ জহর রায়কে ঘুরিয়ে গরু বলছেন। ‘তর কিন্তু আমি লক্ষণ ভাল বুঝি না রে! বেশি শাকপাতা খাওন আরম্ভ করস’ বলতে বলতে থেমেই সেই অননুকরণীয় ভঙ্গি, ‘কী দেখিস, গুঁতাইস না’! কৃত্রিম ভয়ে পিছিয়ে আসছেন! একই ভাবে চায়ের কাপ সুচিত্রা সেনের হাতে ফেরত দিতে গিয়ে দ্বিধাজড়িত মুহূর্তের ঠকঠকানি বা মালপো খেতে জহর-অজিতদের টিটকিরির সময়ে হালকা মুখভঙ্গিতে ‘অসইভ্য’ বলে ওঠাও একটা সময়ের দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে।

‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিতে জহর রায়ের সঙ্গে

এর বছর ছয়েক বাদে ১৯৫৯-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’-এর কয়েকটি মুহূর্তও ভানুর গভীর জীবনবোধের দ্যোতক। নায়িকা রুমা গুহঠাকুরতা, নায়ক ভানুর অফিসের বস। নেমন্তন্ন বাড়ি ফেরত তাঁর হাতের ফুলের গুচ্ছ রুমা ‘রমাবাবু’ ওরফে ভানুর হাতে তুলে দেওয়ার পরে কয়েক লহমা ভানু যেন পৃথিবীতেই থাকেন না। ফুলের গন্ধটুকুর আবেশ নিয়ে যেন কয়েক কদম মেঘের উপরে হেঁটে যাচ্ছেন। চলার পথে একটি জলের গামলা উল্টোলেও টের পান না তিনি। এ ছবিতে উত্তমকুমারের হিরো হওয়ার কথা ছিল। কোনও ভাবে তা কেঁচে গিয়ে ভানু হিরো হচ্ছেন শুনে, সুরকার নচিকেতা ঘোষও ছবির অমন চমৎকার গানগুলির কথা ভেবে একটু দুঃখ করেছিলেন।

ভানু হিরো হলেও নায়কসুলভ ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হওয়ার চেষ্টা করেননি। চরিত্রের বাইরে অকারণে একটি পা-ও ফেলেননি। জহর রায় দুরন্ত ক্যারিকেচারে কয়েকটি অবিস্মরণীয় চরিত্রচিত্রণ করেছেন। ভানুর কমিক অভিনয় চরিত্রগুলির বিপন্নতা ফুটিয়ে তোলে। তাদের আয়নায় নিজেকে দেখে দর্শক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর মূল্যায়নেও বলছেন, ‘‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললে শুধুই একটা হাসাবার যন্ত্র মনে পড়ে না— একটা জীবন ধারণা, জীবন সম্পর্কে একটা মন্তব্য যেন মনকে ছুঁয়ে যায়।’’

ভানু কখনওই তাঁর শরীরী অভিনয়ের কোনও ভঙ্গিকেই মাথায় চড়তে দেননি। ১৯৬৭-তে মধ্যচল্লিশের ভানু রোম্যান্টিক কমেডি ‘মিস প্রিয়ংবদা’য় নায়িকার সঙ্গে প্রেম করা ছাড়াও বেশ খানিকটা সময়ে নারীবেশে ‘স্ক্রিনে’ থাকছেন। এমন পরিস্থিতিতে ন্যাকামি বা অতি অভিনয়ে দর্শককে হাসানোর নজির রয়েছে অনেক সু-অভিনেতারও। লক্ষণীয়, ভানু এ ক্ষেত্রেও তাঁর সময়ের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে। একফোঁটা বাড়াবাড়ি করেন না। ভানুকন্যা বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় (ঘটক) বলছিলেন, ‘‘অনেক পুরুষই মেয়ে সেজে অভিনয় করতে গিয়ে যে ভাঁড়ামো করেন, তাতে ট্রান্সনারীরা অসম্মানিত বোধ করেন। আমরা এখন শাড়ি-পরা রূপান্তরকামী নারীদের সম্মানের চোখে দেখি। বৌঠাকুরানির হাটে ‘রমাই ভাঁড়’ বা ‘মিস প্রিয়ংবদা’ হয়ে বাবার (ভানু) অভিনয়েও ‘অতি অভিনয়’ নেই।’’ এমনকি যে বাঙাল ডায়ালগের জন্য ভানুর এত নামডাক, তা-ও অকারণে ব্যবহার তাঁর পছন্দ ছিল না। নিজে বলতেনও, ৭০ ভাগ ছবিতেই এ দেশি ভাষায় অভিনয় করেছেন।

ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট

ভানু-জহরের অভিনয়ের দু’টি আঙ্গিকের তুলনা করেছেন সৌমিত্র। তাতে কখনও জহরের কিছু অতি-অভিনয়ের চিহ্নের কথা বলেছেন। অবশ্যই তা দর্শক বা পরিচালকের চাপে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। কিন্তু সত্যজিতের মতো সৌমিত্রেরও আক্ষেপ ছিল, ভানু-জহরের মতো গুণী শিল্পীদের ‘কমিক রিলিফ’ হিসেবে অপব্যবহারের পরিণতি নিয়ে। ‘‘চিত্রনাট্যে হাসি নেই অথচ হাসানোর দাবিতেই পয়সা দিয়ে এঁদের নিযুক্ত করা হয়। সে রকম অজস্র ছবিতে অভিনয় করার একটা খেসারত আছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তা দিতে হয়েছে।’’

সিনেমায় অভিনয়ের জন্য আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোলের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পরে ভানু অবশ্যই কিছু খারাপ ছবিতে সই করেছেন। তবু স্রেফ ভাঁড় হিসেবে টিকে থাকা যে নিজের শিল্পী-সত্তার প্রতি সুবিচার করা হবে না, তা শুরুতেই বুঝেছিলেন তিনি। তাঁর মতো চরিত্রাভিনেতারা সকলেই বিষয়টা বুঝুন, এটাই ভানু চাইতেন। বিশ্বমানের ছবি ‘পরশপাথর’-এ তুলসী চক্রবর্তীর মতো পার্ট হয়তো তিনি পাননি। তবু ভানু হাস্যরসের বাইরে অন্য ধরনের চরিত্রে অভিনয়েও মনোযোগী হন। সেই সঙ্গে অভিনেতা হিসেবে সাম্মানিকের একটা দর বজায় রাখাও জরুরি— এটা বুঝেছিলেন। ভানুপুত্র গৌতম বলছিলেন, ‘‘বাবা ‘ওরা থাকে ওধারে’-র মতো কিছু ছবিতে ১০০০ টাকা রোজ দরেও অভিনয় করেছেন। অনেকটা সময় তাঁর বাঁধা দর ছিল, ২৫০ টাকা। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর পর থেকেই একেবারে ছোট, চার-পাঁচ দিন কাজের পার্ট বাবা নিতেন না। ছোট চরিত্রে কেউ খুব ঝুলোঝুলি করলে, ৮০০ বা ১০০০ টাকা দর হাঁকাতেন।’’ ভানুর বিভিন্ন স্মৃতিচারণেই রয়েছে, জহর রায়কে এ বিষয়ে তিনি চেষ্টা করেও সহমত করতে পারেননি। ভানুর ২৫০ টাকা দরের সময়ে জহর ৭০ টাকায় কাজ করছেন দেখে ভানু বারবার তাঁকে সাম্মানিক বাড়াতে বলেছেন।

প্রবীণ বয়সে দুই বন্ধু মিলে ‘ভানু গোয়েন্দা, জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ করার আগে ভানু বেশ কিছু অন্য ধাঁচের ভূমিকাতেও নিজেকে মেলে ধরেছেন। যেমন অবধূতের গল্প জোগাড় করে নিজে উদ্যোগী হয়েছিলেন ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিটির বন্দোবস্তে। প্রিয় পরিচালক নির্মল দে-কে দিয়ে চিত্রনাট্য লেখানো, পরিচালনা করানোর পরিকল্পনাও ভানুর। ১৯৬৭তে ‘আশিতে আসিও না’য় একসঙ্গে বুড়ো-জোয়ানের সিরিওকমিক চরিত্র নিয়েও তাঁর তুমুল উৎসাহ ছিল। ভানুর অনুরোধেই চরিত্রটি থেকে কমিক অভিনয়ের ভাগ কমানো হয়। সে সব নাকি জহরের পার্টে ঢুকে গিয়েছিল।

জহরকে নিয়ে আর একটি কাজের পরিকল্পনা অবশ্য ভানুর পূর্ণ হয়নি। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসে এক বাক্স সন্দেশসুদ্ধ ‘শিব্রাম চকরবরতির’ কাছে গিয়ে তাঁর ‘হর্ষবর্ধন গোবর্ধন’-এর সম্পূর্ণ অভিনয় স্বত্ব নগদ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন ভানু। ভানুর অবশ্য এ ছবি পরিচালনার ইচ্ছে ছিল। জহরের অকালপ্রয়াণে সব ভন্ডুল।

ছবি বিশ্বাস দ্য গ্রেট

‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’র গুরুত্বপূর্ণ শিশুশিল্পী ভানুকন্যা বাসবী ওরফে ভুটুর মুখে কথাটা শুনে ভানু বাক্যিহারা! ভুটু বলছে, ‘‘আমি তো আমার প্রথম ছবিতেই প্রাইজ় পাব, তুমি কী পেয়েছ, বাবা!’’ পাশে বসে তখন মিটিমিটি হাসছেন ভুটুর ছবিজেঠু। ছবি বিশ্বাসের প্ররোচনাতেই ভানুকে এ কথা শুনতে হয়েছিল। ছবিদা ভানুকে খ্যাপাচ্ছেন, চুপ করে থাকলে চলবে না, বলতেই হবে! তাঁর শিল্পী-জীবনের অন্যতম প্রধান মেন্টর ‘ছবিদা’কে বাদ দিয়ে ভানুর গপ্পো শেষ হয় না।

‘বধূ’ ছবিতে কমল মিত্র, ছবি বিশ্বাস, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে

ট জাগুলিয়ার জমিদারবাবু ছবি বিশ্বাস ইন্ডাস্ট্রির এই বাঙাল ছেলেটির মাহাত্ম্য বোঝেন ‘নতুন ইহুদি’ নাটক দেখার পরেই। ভানুকে ভাইয়ের মতো স্নেহ করেছেন। ভুটু একটা সময়ে ছবিজেঠুর কোলে কোলেই থাকত। শুটিংয়ের সময়ে স্কাইরুমের হ্যাম-সসেজ আনিয়ে আকছার সপুত্র ভানুর সঙ্গে খেতেন। মঞ্চের ডায়ালগ নিয়ে পা-টানাটানিতেও দু’জনেই সমান ‘পাজি’। এক নাটকে ছবিবাবু লেটলতিফ ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা ভানু তিতিবিরক্ত হয়ে ভাড়া চাইতে এসেছেন। ‘সিনে’ ভাড়া না-পেয়ে ভানুর বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। ছবি শুরু করলেন, ‘চা খেয়ে যান’!

ভানু: না!

ছবি: তা হলে ডাব...

ভানু: না।

ছবি: আ-হা, ডাব তো খেয়ে যান।

এ বার ভানুর পাল্টা: দিন তা হলে দু’টোই খাব!

এতক্ষণে ছবি জব্দ! আর একটি নাটকে আবার ভানু জব্দ। ভানুর নাম কৃতান্ত বিশ্বাস। ছবি শুনে বলছেন, কাউকে বিশ্বাস করবেন না। ভানু মাথা নাড়েন। ছবি: অবিশ্বাসও করবেন না। ভানু আবার বলেন, বেশ তাই হবে। ছবি বলতে থাকেন, বিশ্বাস করবেন না, অবিশ্বাসও করবেন না, তবে করবেনটা কী? ভানুর কাঁচুমাচু দশায় নিজেই ফিসফিসিয়ে শিখিয়ে দেন, বল বাড়ি গিয়ে ভাবব!

১৯৬২তে পথ দুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাসের অকালপ্রয়াণের দিন ভানুরও সঙ্গে যাওয়ার ছিল। রেডিয়ো নাটক পড়ায় যাওয়া হয়নি। কমেডিয়ান ভানুর শিল্পী-জীবনের ট্র্যাজেডির ছায়া রয়েছে ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিতে। সে ছবি জুড়েও ভানু আর ছবি বিশ্বাস। ভানুর বেদনা তাতে তাঁর ‘ছবিদা’র সংলাপেই মূর্ত— ‘‘হাসাও, হাসাও জগৎকে শুধু হাসিয়ে যাও! লোকে জানুক তোমার শোক নেই, নৈরাশ্য নেই, ব্যর্থতা নেই! আছে শুধু ফেনায়িত পুঞ্জ পুঞ্জ হাসি!’’

আপনার বৌ কি আপনাকে দেখেই হাসেন

ভানুকে তেলেবেগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য সম্ভবত এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট ছিল। একদা কোনও অভিজাত নারীর এমন ইনিয়েবিনিয়ে প্রশ্নের সামনে পাল্টা বললেন, ‘‘আপনার স্বামী কী করেন?’’ মহিলার বর ডাক্তার, সার্জন! শুনে ভানুর টিপ্পনী, ‘‘উনি কি তবে আপনাকে দেখেই ছুরি কাঁচি নিয়ে তেড়ে আসেন।’’

‘ওগো শুনছ’ ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে

১৯৪১-এ ঢাকায় অনুশীলন সমিতির ব্রিটিশ-বিরোধী কাজে ভানুর নামে হুলিয়া প্রকাশের পরে বন্ধু গোপাল মিয়াঁর গাড়ির পাদানিতে শুয়ে কলকাতায় আসেন তিনি। থাকতেন দিদির বাড়ি, চারু অ্যাভিনিউয়ে। পাশের পাড়া থেকে সেখানে মধুদা’র (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাকা সিদ্ধেশ্বর) কাছে গান শিখতে আসতেন নীলিমা। সিড়িঙ্গে ছেলেটিকে অপছন্দ ছিল না নীলিমার। মধুদাই চার হাত এক করালেন। ব্যক্তিত্বময়ী নীলিমাদেবীর হাতেই বরাবর সংসারের রাশ থেকেছে।

নীলিমা বা ভানু কেউই চাননি, মেয়ে পড়াশোনায় ফাঁকি দিক। তাই তপন সিংহের ‘অতিথি’তে পুরস্কার পেয়েও বাসবীর আর ছবি করা হয়নি। বাড়িতে ভানু রাশভারী বাবা। মেজ ছেলে পিনাকীর (অধুনা আমেরিকাবাসী) ভবিষ্যৎ চিন্তায় ‘সত্যেনদা’র সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছেন। পাড়ার সরস্বতী পুজোর কমিটিতে ঢুকে ভানু ধুতি-পাঞ্জাবি আবশ্যক করেছিলেন। ভাসানে চ্যাংড়াদের দলে নাচের জন্য বড় ছেলে গৌতমকে পাড়ার মোড় থেকে মারতে মারতে বাড়ি টেনে নিয়ে যান।

বাড়িতে ভানুও অন্য মানুষ। স্ত্রীর মদ নিয়ে আপত্তি। তাই জীবনে এক দিনও বাড়িতে মদ্যপান করেননি। এ প্রসঙ্গে একদিনের গল্পে অন্যতম চরিত্র ভানুর বিশেষ স্নেহভাজন রবি ঘোষ। রবিদের মদ্যপানের একটি আসর বসত ভিক্টোরিয়ার বাগানের ধারে, গাড়িতে। সেখানে একদিন ‘ভানুদা’কেও টেনে নিয়ে যেতে রবি মরিয়া। ভানু সে দিন রাজি হননি। কারণ, ‘আমাগো পাড়ার শ্যামল মজুমদারের লেবুগাছটা কাইট্যা ফালাইসে।’

তাতে কী?

‘অন্য দিন তো মাল খাইয়া ডুকার সময়ে তর বৌদির ভয়ে লেবুপাতাটা চিবাইতাম’! রবি ঘোষও হাসতে হাসতে সারা!

নব রামায়ণ

ওষুধের মোড়কের মতো যে কোনও রসিকতার গায়েও অদৃশ্য মেয়াদ-উত্তীর্ণ তারিখ লেখা থাকে। আগে হাসি পেত এমন অনেক কিছুতেই আর তত হাসি পায় না। ভানুর কৌতুক-নকশার অনেকটাই তবু নিত্যনতুন আবিষ্কারের। ‘নেতা ভানু’ রামায়ণ পড়ানোর সওয়াল করছেন। কারণ ‘আমরা মানে দেশের নেতারা তা হলে রক্ষা পামু। রামায়ণ ভাল কইরা পড়া থাকলে আর কথায় কথায় নেতাগো দোষ ধরব না। তা হইলে মরাল কী দাঁড়াইল, বাপ প্রতিজ্ঞা করব, ছেলে পালন করব! বাপ দেনা করব, ছেলে শোধ করব, সুতরাং নেতা ভুল করব, জনসাধারণ ঘুইরা মরব।’ সেই নব রামায়ণের রামচন্দ্রও বাঙালির মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা সুকুমার রায়ের ধারা মেনে মনুষ্যসুলভ। ভানু বলছেন, ‘‘হরধনু ভাইঙ্গা সীতারে বিয়া করসিল, এই রে ফলো কইরা আমার মেজ পোলা পাশের বাড়ির সীতারে বিয়া করনের লিগ্যা ধনুক ভাঙ্গা পণ করসে। পাবলিকের প্যাঁদানির ভয়ে যে নিজ়ের বৌরে আগুনে ডুকতে কয় সে আবার আদর্শ রাজ়া!’’

ভানুর আক্ষেপ ছিল, এ দেশের কৌতুকে রাজনৈতিক নেতাদের দুরমুশ করার সাহস নেই। তাই রসিকতায় বীরবল, গোপাল ভাঁড় বা শেক্সপিয়রের ‘ফুল’দের খোঁজ করে চলেছেন। এখানে বাঙাল ভাষা বলাও একটা কৌশল। হাসির আঙ্গিকে মিশিয়ে দিয়েছেন, দেশভাগের বেদনায় মিশে থাকা অনন্য ইতিহাসবোধ।

আমি মরলেও কি লোকে হাসব

ঢাকার নবাবের আমমোক্তার, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘ইনস্পেক্টর অব স্কুলস’ সুনীতিদেবীর মেজছেলে সাম্যময়কে এ প্রশ্নও শেষ জীবনে তাড়া করেছে। ইতিহাসবিদ দাদামশাইয়ের রাখা নাম, তত দিনে ডাকনাম ‘ভানু’র দীপ্তিতে বিস্মরণের গর্ভে। শ্যামবাজারের মঞ্চে জীবনের শেষ পর্যন্ত থিয়েটার এবং শুটিংয়ের ধকল হয়তো তাঁর মৃত্যু কিছুটা এগিয়ে এনেছিল। ভাল কাজ করার তাগিদটা অটুট ছিল

শেষ পর্যন্ত। জহরের মৃত্যুর পরে আকাশবাণীর স্টুডিয়োয় রেকর্ডিং করতে গিয়ে কান্নায় গলা বুজে আসায় বারবার থামতে হচ্ছিল ভানুকে। কিন্তু তিনি স্টুডিয়ো থেকে বেরোনোর পরে তাঁকে দেখেই আশপাশের লোকের হাসি। ৬৩ বছর বয়সে ভানু চলে যাওয়ার পরে অবশ্য শোকার্ত ভিড় উপচে পড়ে টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো-পাড়ায়।

চারু অ্যাভিনিউয়ে ভানুর পুরনো বাড়ি এখন ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত। তার দেওয়ালে আঁকা ছবিতে তুলসী লাহিড়ী, তুলসী চক্রবর্তী, নবদ্বীপ হালদার, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, জহর রায়, স্নেহভাজন রবিদের সঙ্গেই খোশমেজাজে ভানু। আছেন চার্লি চ্যাপলিনও। কুলীন অভিনেতাদের দলে ভানুর ঠাঁই চিরকালীন।

ঋণ: ভানু সমগ্র (পত্রভারতী), গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসবী ঘটক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন