রুজির সন্ধানে চিৎপুরের রাস্তায় ব্যস্ত চাবিওয়ালা।
চক্র রেলের স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম দক্ষিণে যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানেই বাগবাজার স্ট্রিট ও রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থল। রেলের প্ল্যাটফর্মকে ডাইনে রেখে রেললাইনের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে এলে প্রমদাসুন্দরীর গঙ্গার ঘাট ও হাওড়া-বাগবাজার লঞ্চঘাট। এখন বাগবাজার স্ট্রিটের মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ালে দেখা যায় দক্ষিণ-পুব কোণে এক ঘেরা চত্বরের ভেতর থেকে চারটি মন্দিরের চুড়ো উঁকি দিচ্ছে। রবীন্দ্র সরণির পুব-গা দিয়ে একটা সরু গলি পেরিয়ে এগোলে উত্তরমুখী অন্নপূর্ণার দালান মন্দির এবং তারই সংলগ্ন পশ্চিমমুখী চারটি আটচালা রীতির শিব মন্দির। এ মন্দিরগুচ্ছের মধ্যে যেটি উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয়, সেটির প্রবেশপথের উপর নিষিদ্ধ হয়েছে সংস্কৃত ভাষায় উৎকীর্ণ এক লিপি। লিপিটিতে সেকালে প্রচলিত প্রহেলিকার মধ্যে নিহিত যে শকাঙ্কটি দেওয়া আছে, একদা সেটির পাঠোদ্ধার করে পূর্ণচন্দ্র দে উদ্ভটসাগর জানিয়েছিলেন মন্দিরগুচ্ছের প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৯৮ শকাব্দ, অর্থাৎ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ। দু’শো বছরের অধিক প্রাচীন এই মন্দিরগুলির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, যিনি ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে কলকাতার আমিন।
এ মন্দির দর্শন শেষ করে বাগবাজার স্ট্রিট ধরে সামান্য পুবে এগিয়ে গেলে বাঁদিকে গিরীশ মঞ্চ এবং ডানদিকে বর্তমান শতকের তিন-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত বাগবাজার গৌড়ীয় মঠের নবরত্ন মন্দির। সেকালে চিৎপুর রোডে প্রাচীন দেবালয়গুলির অস্তিত্ব কিছু কিছু থেকে গেলেও সাবেকি সে সব বাড়িঘরগুলি কলকাতার ক্রমোন্নতির ধাক্কায় পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তবু এরই মধ্যে ৫৮২ নম্বর-এর সিংহ বসানো এক দোতলা বাড়ির দক্ষিণ লাগোয়া একটি মিষ্টান্ন ও আটাকলের দোকানঘরের পলেস্তারা খসা দেওয়ালের পাতলা ইটগুলো দেখলে অনুমান করা যায়, এটিও ছিল বিগত আঠারো শতকের শেষ দিক নাগাদ নির্মিত কোনও এক বসতবাড়ির স্মৃতিচিহ্ন। পথচলতি ডানদিকে লালরঙা এক সময়ের বিরাট সব গুদামঘর, যার একদিকে বসানো ছিল পোর্ট ট্রাস্ট-এর রেললাইন। এগুলি বর্তমানে রূপান্তরিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের ওষুধপত্রের গুদাম এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগের অফিসঘরে।
গুটিগুটি এ পথ দিয়ে এগিয়ে গেলে ডানদিকে এক ঘড়িআলা বাড়ির দিকে সহজেই নজর চলে যায়। বাড়ির প্রধান প্রবেশপথের উপরে বোর্ড লাগানো আছে ‘বাব সুরনাথ ভক্তমণ্ডল’। বাঁদিকে দোতলার উপরে আয়নার ডায়াল বসানো এক বড় দেওয়াল ঘড়ি। আর তার ঠিক তলায় লাগানো রয়েছে এক অভিনব ফলক, কাঠে না লোহা ঢালাইয়ে তৈরি কে জানে। বা-রিলিফে খোদাই এ ফলকটিতে দেখা যাচ্ছে, দুদিকে দুই উড়ন্ত পরীর মাঝে মা মেরির দণ্ডায়মান এক মূর্তি। হয়তো কোনওকালের এক সাহেববাড়িতে লাগানো এই ফলকটি হাতফিরি হয়ে আজ স্থান পেয়েছে এই ভবনে, মালিকের অলঙ্করণ প্রীতির নিদর্শন হিসেবে।
চিৎপুর রোডের এই বাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
এবার বাঁ-হাতি পড়ল কাশী মিত্র ঘাট লেন। এ গলিটির বিশেষ এক খ্যাতি হল বিখ্যাত ভাস্কর জি. পালের অর্থাৎ গোপেশ্বর পালের বসতবাড়ি ও তাঁর স্টুডিওর অবস্থিতি। সরু গলির ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল বাঁ-হাতি তিন নম্বর বাড়িটিতে রয়েছে কাঠের কড়ি দিয়ে তৈরি এক ঝুলবারান্দা। উনিশ শতকে উইলিয়াম সিমসনের আঁকা ঝুলবারান্দার স্মৃতিচিহ্ন হঠাৎ যেন স্মরণ করিয়ে দেয় সেই বিগত ট্রাডিশনের কথা। পাশের ‘শিবালয়’ ঠাকুরবাড়ি পেরিয়ে সামান্য এগুলেই বাঁহাতি মোড়ের মাথায় জি. পালের স্টুডিও ও তার ডানহাতি শিল্পীর বসতবাড়ি। স্টুডিওর বাইরের চত্বরে রাখা সিমেন্ট জমানো নানান মূর্তিভাস্কর্যের মধ্যে উপবিষ্ট এক গ্রাম্য দম্পতির প্রমাণমাপের সাবলীল মূর্তি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রখ্যাত এই ভাস্কর কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় এসে কুমোরটুলি এলাকায় শুধু স্টুডিও বসিয়ে নানাবিধ মূর্তি রচনাই করেননি, একদা বিলেতের ওয়েমব্লিতে ‘ব্রিটিশ এম্পায়ার এগজিবিশন’ উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে তাৎক্ষণিক মূর্তি নির্মাণের দক্ষতায় সেখানে তিনি যে চমক সৃষ্টি করেছিলেন, সে কৃতিত্ব বাঙালির একান্তই গৌরবের বিষয়। আজও তাঁর এবং তাঁর সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র মণি পালের কৃত ভারতের বহু মনীষীর মূর্তি-ভাস্কর্যের মডেল তাঁর এই স্টুডিওতে থরে থরে সাজানো রয়েছে। গোপেশ্বর ও মণিবাবু অকালেই ঝরে গেছেন, কিন্তু গোপেশ্বরবাবুর সুযোগ্য পুত্র সিদ্ধেশ্বরবাবু আজও যে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন, তাঁর গঠিত ভাস্কর্যের মডেল তাঁর এই স্টুডিওতে থরে থরে সাজানো রয়েছে। গোপেশ্বর ও মণিবাবু অকালেই ঝরে গেছেন, কিন্তু গোপেশ্বরবাবুর সুযোগ্য পুত্র সিদ্ধেশ্বরবাবু আজও যে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন, তাঁর গঠিত ভাস্কর্যের বহুবিধ নিদর্শনগুলিই তাঁর দক্ষতা ও কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। দুঃখের কথা, গোপেশ্বর ও মণিবাবু জীবিতকালে গোটা ভারত জুড়ে যে সব স্বনামধন্য মহাপুরুষের মূর্তি রচনা করেছিলেন তার একটা তালিকা যদি পাওয়া যেত, তা হলে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পরসিকরা এই ক্ষণজন্মা শিল্পীদের কর্মজীবনের সাধনা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারতেন।
জি. পালের স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আবার দক্ষিণমুখো রবীন্দ্র সরণির পথে পথে। সামনেই বাঁ ফুটপাতে মদনমোহনের মন্দির, যা সাধারণের কাছে মদনমোহনতলা নামেই সমধিক পরিচিত। এ ঠাকুরবাড়িটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোকুল মিত্র, যিনি একদা নুনের ব্যবসায়ে অগাধ ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর স্থাপিত মার্বেল পাথর দিয়ে ঢাকা বৃহদাকার দোতলা দালান মন্দির, দোলমঞ্চ ও রাসমঞ্চটি আজও অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য হিসাবে টিকে রয়েছে। পাশেই মিত্র পরিবারের বসতবাড়ি এবং তার পুব গায়ে দক্ষিণমুখী ভুবনেশ্বর শিবের আটচালা মন্দির। ঠাকুরবাড়ির মধ্যস্থলে নির্মিত বিশালাকার নাটমন্দিরের থামগুলিতে উৎকীর্ণ হয়েছে বিদেশি স্থাপত্য প্রভাবিত আয়োনিয়ান ভাস্কর্যশৈলী। এক সময়ে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুররাজ চৈতন্য সিংহ দেনার দায়ে তাঁর গৃহদেবতা মদনমোহনকে লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে বন্ধক রাখেন এবং শেষ অবধি ঋণশোধ না দিতে পারার কারণে তিনি তাঁর ওই বিগ্রহের উপর দাবি পরিত্যাগ করেন বলেই জনশ্রুতি। পরবর্তীকালে বালকেরা এই বিগ্রহের উপর দাবি পরিত্যাগ করেন বলেই জনশ্রুতি। পরবর্তীকালে বালকেরা এই স্মৃতিকে খেলাচ্ছলে জাগরূক করে রেখেছিল প্রচলিত ছড়ায়, ‘কার কী হারিয়েছে, বাগবাজারের মদনমোহন পালিয়েছে।’
(ছবি: আনন্দবাজারের আর্কাইভ থেকে)
(উপরের নিবন্ধটি তারাপদ সাঁতরা-র ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ গ্রন্থের ‘স্মৃতির সরণি: চিৎপুর রোড’ অধ্যায় থেকে নেওয়া। আজ তার দ্বিতীয় অংশ। সৌজন্যে আনন্দ পাবলিশার্স)