Lakshmir Bhandar

ভরসার ভান্ডারে আর পরিসংখ্যানে কি ঢাকা যায় মেয়েদের হাল

মেয়েদের নিজস্ব টাকা না নেহাতই ভোটের দান? লক্ষ্মীর ভান্ডার ঘিরে কিছু প্রশ্ন।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:১৭
Share:

রাজ্যের মহিলাদের আর্থিক সহায়তার জন্য ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি দাবি করেছেন, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প অন্য রাজ্যগুলিও অনুসরণ করছে। উত্তরে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “এটা করে ভোট পাওয়া যায়। তাই অনুসরণ করছে। এটা উন্নয়ন নয়। এটা অপচয়।” অনেক অর্থনীতিবিদ অবশ্য মেয়েদের হাতে টাকা দেওয়াকে ‘অপচয়’ বলতে রাজি নন। মেয়েদের, বিশেষত দরিদ্র, প্রান্তিক মেয়েদের হাতে নগদ টাকা থাকলে তা সংসার ও সন্তানের কাজেই লাগে। বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারও দিলীপবাবুর কথা মানবে না, কারণ নগদ পাওয়ার প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তিকে মেয়েদের সক্ষমতার একটি সূচক বলে ধরছে কেন্দ্র। সে দিক থেকে ২ কোটি ২১ লক্ষ লক্ষ্মীর ভান্ডার গ্রাহক দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গ জাঁক করতে পারে। তবে সক্ষমতার আরও দুটি সূচক তৈরি করেছে কেন্দ্র— মেয়েদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা, আর শ্রমের বাজারে মেয়েদের যোগদান।

কেন্দ্রের হিসেব, বাংলায় প্রায় চুয়াল্লিশ শতাংশ মেয়ে কর্মরত (২০২৩-২৪)। এই উজ্জ্বল সংখ্যার পিছনে রয়েছে অনেকখানি অন্ধকার— মেয়েদের মধ্যে স্বনিযুক্তি দ্রুত বেড়েছে (২০১৭-১৮ সালে ৪৫ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ সালে ৭৫ শতাংশ), আর অর্ধেক হয়েছে নিয়মিত বেতন পাওয়া মেয়ের অনুপাত (২০১৭-১৮ সালে ১৮ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ সালে ৯ শতাংশ)। অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) নিয়োগও কমেছে। এই ‘স্বনিযুক্ত’ মেয়ে আসলে কী করে? তাদের ৩৫ শতাংশ স্রেফ পরিবারের খেতে বা ব্যবসায় কাজ করে, হাতে কোনও টাকাই পায় না। আর ৬৪ শতাংশ নিজে মালিক, নিজেই মজুর। মাত্র এক শতাংশ মেয়ে অন্য কোনও কর্মী নিয়োগ করার ক্ষমতা রাখে। সরকারের খাতায় যা ‘স্বনিযুক্তি,’ মেয়েদের জীবনে তা হাড়-কালি করা খাটুনি— বিনা পয়সায়, সামান্য পয়সায়। জরি, পাট, বিড়ি, টেলারিং, মিড ডে মিল রান্না— প্রায় সর্বত্র রোজগার ঘণ্টাপ্রতি দশ টাকা থেকে পঁচিশ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ১০০ দিনের কাজ চার বছর বন্ধ থাকায় গ্রামের মেয়েদের দরদস্তুরের ক্ষমতা আরও কমেছে।

ব্যাঙ্ক-সংযুক্তির পরিসংখ্যান দিয়েই বা মেয়েদের হাল কতটুকু বোঝা যায়? সিপিআইএম-এল নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “বিহারে ‘জীবিকা’ প্রকল্পের অধীনে মেয়েদের দশ হাজার টাকা করে দেওয়া হল, শর্তহীন ঋণ হিসেবে। চাপা পড়ে গেল এই সত্যিটা যে, বেসরকারি সংস্থার ঋণ শোধ করার উপায় না দেখে মেয়েরা ঘরবাড়ি ছাড়ছে।” পশ্চিমবঙ্গের ছবি কি ভিন্ন? “বাগনানের গোপালপুর আর রামচন্দ্রপুরে দু’জন মেয়েকে চিনি, যাঁরা নানা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করার উপায় না দেখে বাড়িছাড়া,” বললেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কর্মরত এক সংস্থার কর্মী। সংবাদে নিয়মিত আসে ঋণখেলাপি মেয়েদের আত্মহত্যা, হেনস্থার ঘটনা। বেসরকারি ঋণে মাথাপিছু বকেয়ার পরিমাণে (আউটস্ট্যান্ডিং লোন) পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষের দিকে (এমফিন, ২০২৪)। আবার, অনাদায়ী ঋণে দেশের শীর্ষ বারোটি জেলার মধ্যে অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের (সিআরআইএফ, ২০২৩)। উচ্চহারে সুদ, উপর্যুপরি ঋণের ফাঁসে নাভিশ্বাস উঠছে মেয়েদের। বিহারে আন্দোলন শুরু হয়েছে, বেসরকারি সংস্থার থেকে নেওয়া ক্ষুদ্র ঋণ মকুব করুক রাজ্য।

লক্ষ্মীর ভান্ডারকে দেখতে হবে এই প্রেক্ষাপটে। “বাজার সব সময় দরিদ্র পরিবারকে যথেষ্ট টাকা জোগাতে পারে না, সেই জন্যই দরকার অনুদান। কিন্তু অনুদান তো আর রোজগারের বিকল্প হতে পারে না,” বললেন অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী। ঠিক এই কথা শ্রম দিবসের অনুষ্ঠানে বলছিলেন বাগদা, বনগাঁ, গাইঘাটার খেতমজুর, দিনমজুর কয়েক জন মহিলা। “আমরা ডোল-দান চাই না, আমাদের কাজ দিন।”

এ কি কেবল স্লোগান? বছরে বারো হাজার থেকে চোদ্দো হাজার টাকা সত্যিই কি ছেড়ে দিতে রাজি মেয়েরা? বারাসতের সমাজকর্মী নির্মলা মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) বললেন, “যে মেয়েদের ভাল রোজগারের আশা নেই, তারা লক্ষ্মীর (ভান্ডারের) টাকা আঁকড়ে রয়েছে। যাদের ঘরে ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে বেকার বসে রয়েছে, তারা টাকা চায় না। কাজ চায়।” শহর আর গ্রাম, দরিদ্র আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মানে বদলে যায়, বললেন পূর্ব মেদিনীপুরের ঘাটালের এক সমাজ-পর্যবেক্ষক। “বেকারত্ব, দুর্নীতি, নারী-নির্যাতন, এগুলো গ্রামের মেয়েরা দেখছে, কিন্তু তাদের তেমন করে স্পর্শ করছে না। যে সব পরিবার নগদ পায় বছরে দু’একবার, ধান-আলু বেচে, বাকি সময়ে দিনগুজরান করে মজুরি করে, তাদের ঘরে তিন-চারজন মহিলা থাকলে মাসে তিন-চার হাজার টাকা ঢুকছে। এটা তাদের মস্ত ভরসা।”

এই ভরসা ধরে রাখতে চলতি অর্থবর্ষে লক্ষ্মীর ভান্ডারের বাজেট বরাদ্দ (২৬,০০০ কোটি টাকা)ছাড়িয়ে গিয়েছে কৃষি, আবাসন, এমনকি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের বরাদ্দকেও। ‘গ্রাম উন্নয়ন’ যত টাকা পাচ্ছে, লক্ষ্মীর ভান্ডার পাচ্ছে তার প্রায় দ্বিগুণ।

তাতেও কি তৃণমূল মন পেয়েছে সব মেয়ের? “এসসি (তফসিলি জাতি) মেয়েরা তো বেশি টাকা পায়— আগে পেত হাজার টাকা, এখন বারোশো টাকা। তা হলে এসসি এলাকায় বিজেপি বেশি ভোটপায় কেন?” প্রশ্ন করলেনমুর্শিদাবাদের এক মহিলা রাজনৈতিক কর্মী। বিগত নির্বাচনগুলি দেখাচ্ছে, যে সব আসনে বিজেপি জিতেছে, সেখানে তফসিলি জাতির ভাগ বেশি। তা হলে কি ‘ভাত না জাত’ — এই পুরনো প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হবে রাজ্যকে?

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন