জীর্ণ: শোভাবাজার স্ট্রিটের এই বাড়িকেই হেরিটেজ তকমা দিয়েছে কলকাতা পুরসভা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
‘‘ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলে তবেই কোনও জায়গা বা বাড়ি হেরিটেজ বলে ঘোষিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো তেমনটা কিছুই নেই!’’
বলরাম মজুমদার স্ট্রিটের এক ভাড়াবাড়িতে বসে কথাগুলি বলছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বিমলচন্দ্র সাহা। শোভাবাজার স্ট্রিটে প্রায় পৌনে ১০ কাঠা জমির উপরে তাঁর নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। ভগ্নস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়িটি ভেঙে সেখানে নতুন ভবন তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিমলবাবু। কিন্তু তাতে বাদ সেধেছে কলকাতা পুরসভা। পুরসভার দাবি, ওই বাড়িটি হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। তাই ভাঙা যাবে না। কিন্তু কেন বাড়িটি হেরিটেজ, তার কোনও উত্তর দিতে পারেননি পুর কর্তৃপক্ষ। স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য, না কোনও মনীষীর স্মৃতি, কী কারণে বাড়িটি হেরিটেজ বলে ঘোষিত হতে পারে, তা ভেবে পাচ্ছেন না বিমলবাবুও। কারণ, ওই দু’টির একটিও তাঁর বাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অথচ, কোনও রকম ব্যাখ্যা না দিয়েই বাড়িটি হেরিটেজ বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে।
বিমলবাবুর অভিযোগ, পুরসভা ওই বাড়ির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত সম্পর্কেও কোনও তথ্য দিতে পারেনি। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িটি কেন হেরিটেজ, তা অনেক বার জানতে চেয়েছি পুরসভার কাছে। কিন্তু পুরসভা কিছুই জানাতে পারেনি।’’
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ১৯৯২ সালে ১৬ নম্বর শোভাবাজার স্ট্রিটের ওই বাড়িটি কিনেছিলেন বিমলবাবু। তখনই সেই বাড়ির বয়স প্রায় ২০০ বছর। তার পর থেকে বাড়িটি ও ভাবেই পড়ে ছিল। ওখানে কেউই থাকেন না। শুধু এক জন কেয়ারটেকার বাড়িটি দেখাশোনা করেন। ওখানে নতুন বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করতেই বাধা পেয়েছে সাহা পরিবার।
ওই বাড়িটিকে হেরিটেজ তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বিমলবাবুদের তরফে পুরসভার কাছে আবেদনও জানানো হয়। কিন্তু সে আবেদন খারিজ করে পুর কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, কোনও ভাবেই হেরিটেজ তালিকা থেকে ওই বাড়ি বাদ যাবে না। এর পরেই বিমলবাবু কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন।
ওই মামলার শুনানিতে পুরসভাকে রীতিমতো তুলোধনা করে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, যে ভাবে ওই বাড়িকে কলকাতা পুরসভা হেরিটেজ বলে ঘোষণা করেছে, তা শুধু খারাপই নয়, বেআইনি এবং ভিত্তিহীনও। তাই ওই বাড়িকে অবিলম্বে হেরিটেজ তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে হাইকোর্ট অবশ্য এটাও জানায়, যদি ওই বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করতেই হয়, তা হলে তা পুর আইন অনুযায়ী করতে হবে।
প্রসঙ্গত, এ শহরে হেরিটেজ মর্যাদা দেওয়া নিয়ে পুরসভার তরফে ‘যথেচ্ছাচার’ চলছে বলে অভিযোগ করেছেন হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদেরই একাংশ। তাঁদের মতে, পুরসভা কোথাও ইচ্ছেমতো হেরিটেজের গ্রেড ঘোষণা করছে, কোথাও আবার গ্রেডের অবনমন ঘটিয়ে সেখানে নতুন নির্মাণে উৎসাহ দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নজির হল ওল্ড কেনিলওয়ার্থ হোটেল-বিতর্ক। যেখানে হেরিটেজ গ্রেডের অবনমন ঘটিয়ে নিতুন নির্মাণ করা হয়েছে। শহর জুড়ে এই প্রবণতার পিছনে একদল প্রোমোটার-চক্র সক্রিয় বলেই মনে করছেন অনেকে। এক হেরিটেজ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘গ্রেডের অবনমন ঘটিয়ে বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। নতুন ভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার যে জায়গায় সত্যিই সংস্কারের প্রয়োজন, সেখানে সংস্কার করতে দেওয়া হচ্ছে না।’’
শোভাবাজার স্ট্রিটের বাড়িটি নিয়েও ফের সেই বিতর্কের মুখোমুখি পুরসভা। যদিও এ ক্ষেত্রে বাড়ি ভেঙে নতুন নির্মাণে সায় নেই পুরসভার। হাইকোর্টে ‘ধাক্কা’র পরে সম্প্রতি বাড়িটিকে হেরিটেজ তালিকা থেকে বাদ দিলেও পুরসভা জানিয়েছে, যে হেতু নিয়ম মেনে বাড়িটি হেরিটেজ ঘোষণার এখনও সুযোগ রয়েছে, তাই সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাড়িটি নিয়ে কিছু করতে পারবেন না বিমলবাবু।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাড়িটি রীতিমতো ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। দেওয়াল জুড়ে চার-পাঁচটা গাছ। বাড়ির এক দিকের ছাদ ভেঙে পড়ায় সেখান দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির জল পড়ে জমে থাকছে বাড়ির ভিতরেই। বিমলবাবুর ছেলে রাজীববাবু বললেন, ‘‘এত বড় বাড়ি কে দেখাশোনা করবে? নিজেদের জায়গা থাকতেও আমাদের অন্য জায়গায় থাকতে হচ্ছে।’’
বাড়িটি ভেঙে যাতে নতুন ভাবে নির্মাণ করা যায়, তার জন্য গত সপ্তাহেই হাইকোর্টে আর একটি মামলা দায়ের করেছেন বিমলবাবুরা। বিমলবাবু বলছেন, ‘‘আমাদের জায়গায় আমরা বাড়ি করতে পারব না! হেরিটেজের বিষয় থাকলে সেটা জানাক পুরসভা! এটা তো কোনও নিয়ম হতে পারে না!’’