নারায়ণী সেনার প্রশিক্ষণে বিএসএফ জওয়ান।
রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাতে কেন্দ্র পরোক্ষে মদত দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
নবান্নের দাবি, নারায়ণী সেনা নামে যে বাহিনী তৈরি করেছে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন (জিসিপিএ), তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ। কোচবিহারের মাথাভাঙায় এমনই একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের ছবি এবং সবিস্তার রিপোর্ট এসেছে রাজ্য গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে। যা দেখে যারপরনাই ক্ষিপ্ত মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে এই নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে নবান্নের কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
গত ১৯ অগস্ট নবান্নে পাঠানো এক গোপন রিপোর্টে রাজ্য গোয়েন্দা বাহিনী জানিয়েছে, ‘বিএসএফ নারায়ণী সেনার স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে খবর আসার পর কোচবিহারের পুলিশ সুপার এই নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত করেন। তাতেই জানা যায়, মাথাভাঙা থানার শিকারপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের চেনাকাটা বারুনি মেলার মাঠে নারায়ণী স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিএসএফ। ১৬ অগস্ট বেলা ১২টা থেকে ২০ অগস্ট বিকাল ৫টা পর্যন্ত ওই প্রশিক্ষণ চলে। মোট ৮১ জন মহিলা এবং ৩০৯ জন পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক সেখানে উপস্থিত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন’।
পুলিশ সুপারের তদন্তে উঠে এসেছে, বিএসএফের ১৫৮ নম্বর ব্যাটেলিয়নের চেনাকাটা বর্ডার আউটপোস্টের চার অফিসার ওই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। নেতৃত্বে ছিলেন ইনস্পেক্টর ওমপ্রকাশ যাদব। উপস্থিত ছিলেন দু’জন মহিলা বিএসএফ জওয়ানও।
মাথাভাঙার সীমান্ত এলাকা বিএসএফের গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের অধীনে। সেখানকার এক কর্তার অবশ্য দাবি, ‘‘বিএসএফ কখনও কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে না। গ্রামবাসীরা বিএসএফ-এর কাছে এসে স্কুলের ছেলেমেয়েদের ‘সাবধান-বিশ্রাম’ শেখাতে অনুরোধ করেছিলেন। তাদের সেটুকুই শেখানো হয়েছে। তার বেশি কিছু নয়।’’ তবে ডিআইজি পর্যায়ের এক অফিসারকে দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
মাস চারেক আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে যিনি কোচ-রাজবংশীদের জন্য পৃথক সেনা রেজিমেন্ট তৈরির দাবি জানিয়েছিলেন, সেই দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া কিন্তু গোটা ঘটনার মধ্যে ‘অন্যায়’ কিছু দেখছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘জিসিপিএ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়, জাতীয়তাবাদী সংগঠন। আগামী ২৮ অগস্ট কোচবিহারের ভারতভুক্তি দিবস পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। রাজ্য সরকার সেটাই বানচাল করতে চায়।’’ অহলুওয়ালিয়ারও দাবি, বিএসএফ অফিসাররা জিসিপিএ স্বেচ্ছাসেবকদের শুধু ‘সাবধান-বিশ্রাম’ই শিখিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘‘সীমান্ত এলাকার নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ বিএসএফ সর্বত্রই করে। কুচকাওয়াজ ইত্যাদিতে উৎসাহ দেয়। ফলে এ ক্ষেত্রেও তারা অন্যায় কিছু করেনি।’’
নবান্নে পাঠানো ডিআইজি-র রিপোর্ট। এই রিপোর্টের সঙ্গেই পাঠানো হয়েছে ছবিটি।
রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের কিন্তু আশঙ্কা, জিসিপিএ-র হাত ধরে কোচ-রাজবংশীরা সক্রিয় হলে কেএলও-র জঙ্গিরা এর সুযোগ নিয়ে খুনোখুনি শুরু করতে পারে। যার জেরে ফের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে উত্তরবঙ্গ। রাজ্যের এক কর্তা জানান, কেএলও প্রধান জীবন সিংহ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইলেও টম অধিকারী, কৈলাস রায়, নিত্যানন্দ সরকার, নারায়ণ রায়দের মতো নেতারা এখনও জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। তারা অসমের ‘এনডিএফবি’ এবং মণিপুরের ‘কাংলি ইয়াওল কান্না লুপ’ নামে দুই জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে প্রশিক্ষণও পাচ্ছে। মায়ানমারের চিন প্রদেশের হাখা জঙ্গলেও কেএলও-র প্রশিক্ষণ চলছে।
রাজ্যের অভিযোগ, অহলুওয়ালিয়ার চিঠি দিল্লি পৌঁছতেই নারায়ণী সেনা নামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করে নানা কর্মসূচি শুরু করে দিয়েছে জিসিপিএ। (প্রসঙ্গত, বিজেপি সাংসদ তাঁর চিঠিতে কোচ-রাজবংশীদের পৃথক সেনা রেজিমেন্টের নাম নারায়ণী রেজিমেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।) এ বার বিএসএফ তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ায় ‘উত্তরবঙ্গকে ফের অশান্ত করার জন্য বিজেপি মদত দিচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলেছে রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, বিজেপির বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি তিনি কোনও ভাবেই মানবে না। প্রয়োজনে রাজনৈতিক এবং কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ করতেও দ্বিধা করবেন না তিনি।