Advertisement
Durga Puja 2021

Durga Puja 2021: আমাদের দেবী মা জীবন্ত, প্রতি দিন তাঁর মুখ বদলে যায়: সুদীপা চট্টোপাধ্যায়

সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ি ছাড়া চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে ত্রিধারা মতে পুজো হয়।

‘‘আমাদের মায়ের সাজও দেখার মতো।’’

‘‘আমাদের মায়ের সাজও দেখার মতো।’’

সুদীপা চট্টোপাধ্যায়
সুদীপা চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:৫৫
Share: Save:

সারা বছরের অপেক্ষা। রথযাত্রায় কাঠামো পুজো। শরৎ এলেই সাজো সাজো রব। পঞ্চমীতে মা দুর্গার নিমন্ত্রণ অধিবাস। চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে পুজো, হুল্লোড়, উৎসব শুরু। ষষ্ঠীতে বোধনের ঘট বসে। এ বছর সপ্তমীতে আর গঙ্গায় গিয়ে নবপত্রিকা স্নান হবে না। গত বছর করোনার কারণে গঙ্গাস্নানে বাধা পড়েছে। গঙ্গার জল ঘড়ায় করে নিয়ে এসে বাড়ির ছোট ছাদে স্নান করানো হয়েছে নবপত্রিকাকে। এটাই এ বার থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নতুন রীতি। আমাদের বাড়িতে মা দুর্গার তিন মতে পুজো হয়। পঞ্চমী থেকে সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ পর্যন্ত বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, সপ্তমীতে দেবাদিদেব মহাদেব এক দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি আসেন। তাই ওই দিন পুজোর রীতি বদলে হয় শৈব মতে। সন্ধিপুজোর বলি হওয়ার পর থেকে তন্ত্র মতে পুজো হয়। আমাদের পুজোর এই বিশেষ রীতির নাম ত্রিধারা। যা সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ি ছাড়া এই চট্টোপাধ্যায় বাড়িতেই মানা হয়।

অনেক নিয়ম আমাদের বাড়ির পুজোয়। ভোগের কথাই ধরুন। পুজোয় একের দিন একেক রকম চালের ভোগ দেওয়া হয় মাকে। অগ্নিদেবের পরিবার বাংলাদেশের ঢাকার। তাই আমাদের দেবীপুজোয় ঢাকা থেকে চিনিগুড়া চাল আর গাওয়া ঘি আসে। ষষ্ঠী বা সপ্তমীতে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে ভোগ রান্না হয়। অষ্টমীতে মা খান চিনিগুড়া চালের অন্ন। নবমীতে ভোগ তৈরি হয় তুলাইপাঞ্জি চাল দিয়ে। দশমীতে দেবী পান্তা খান দশকাঠি সেদ্ধ চাল দিয়ে। সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা, কচুর শাক, শাপলার টক। নবমীতে মহাভোগ দেওয়া হয়। সাত-আট রকমের মাছ, নিরামিষ মাংস, সুক্তো, পায়েস থাকে এ দিনের মেনুতে। অষ্টমীতে লুচি, মিষ্টি ভোগ হয়। পুজোর ক’টা দিন মাকে কোনও ছানার মিষ্টি দেওয়া হয় না। ক্ষীরের মিষ্টি ছাড়া মা খান না। পরিবারের ছেলে-মেয়েরা কাপড়ে মুখ বেঁধে, দুর্গা নাম জপতে জপতে মায়ের রান্না করেন। এই সময় ইশারায় কথা বলি সবাই। তবে পায়েস এবং ভোগ ধরে দেওয়ার কাজ প্রধানত বাড়ির ছেলেরাই করে থাকেন। মাছ খাওয়া হয় নবমী, দশমীতে। নবমীতে পদ্মার ইলিশ ভোগ দেওয়া হয়। দশমীতে গঙ্গার ইলিশ মাছ খাইয়ে মাকে বিদায় জানানো হয়। তার পর আমরা আবার ইলিশ ছুঁই সরস্বতী পুজোয়।

প্রতি বছর দশমীর বরণের পরে মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে অগ্নিদেব জোড়হাতে মাকে পরের বছরের আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় দেন।

প্রতি বছর দশমীর বরণের পরে মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে অগ্নিদেব জোড়হাতে মাকে পরের বছরের আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় দেন।

আমাদের মায়ের সাজও দেখার মতো। ষষ্ঠীতে মাকে আপেল দিয়ে তৈরি ফলের মালা পরানো হয়। যা থাকে দশমী পর্যন্ত। একটা ফলও নষ্ট হয় না! দশমীর দিন মালা থেকে ফল খুলে হরির লুটের মতো ছুঁড়ে দেওয়া হয়। যে যতগুলো ফল লুফতে পারবেন, তাঁর তত কর্মফল দূর হয়। কারণ, মা আমাদের কাছে ফলহারিণী। সপ্তমীতে দেওয়া হয় রজনীগন্ধার মালা। অষ্টমীর সকালে মায়ের জন্য বরাদ্দ টাটকা লাল গোলাপের মালা। সন্ধিপুজোর সময় জুঁই, বেলপাতা আর অপরাজিতার মালা পরেন মা। নবমীতে মা সাজেন শিউলি ফুলের মালায়। প্রতি বছর এই মালা জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যায় আমাদের। দশমীতে সমস্ত গয়না খুলিয়ে ফুলের সাজে সেজে ওঠেন দেবী। মা আসেন বেনারসি পরে। যাওয়ার সময় ওই শাড়ির উপরেই একটি চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হয়। এক বার বরণের সময় প্রদীপ থেকে আগুন ধরে গিয়েছিল মায়ের শাড়িতে। তার পর থেকে শাড়ি বদলে মাকে বিদায় জানানোর রীতি চালু হয়েছে চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে। পাশাপাশি প্রতি বছর, একটি করে নতুন গয়না গড়ানো হয়। এ বছর মায়ের ইচ্ছে, বড় নথ পরবেন। আমাদের মায়ের গয়না কিন্তু মেশিনে তৈরি হয় না বা কেনা হয় না। আমরা বায়না দিই। কারিগর হাতে গড়ে দেন। তাই এর খাটনি এবং ঝক্কি দুইই বেশি। এমনিতে মায়ের নাকে আছে বাংলাদেশের কমল হিরে। এ ছাড়া, বুক জুড়ে থাকে রুপোর অহেন বর্ম। আমাদের মা যুদ্ধের সাজে থাকেন বলে এই বিশেষ অলঙ্কারে সাজেন তিনি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সীতাহার আছে। আছে ভিক্টোরীয় আমলে তৈরি জড়োয়ার ময়ূর কণ্ঠহার। পাশাপাশি, সবাই প্রতি বছর কিছু না কিছু অলঙ্কার মাকে উপহার হিসেবে দেন। দেবীর বাহন সিংহও সোনার মুকুটে সাজে! আর মায়ের হাতে কালসর্প, ঢাল থাকে না। বদলে থাকে রুপোর পদ্ম। মা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে এ ভাবেই শান্তির বার্তাও দেন।

চারটে দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মায়ের সেবাতেই কেটে যায়। নিজেরা তাই খুব সাজগোজের সময় পাই না।

চারটে দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মায়ের সেবাতেই কেটে যায়। নিজেরা তাই খুব সাজগোজের সময় পাই না।

চারটে দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মায়ের সেবাতেই কেটে যায়। নিজেরা তাই খুব সাজগোজের সময় পাই না। রান্নায় ব্যস্ত থাকতে হয় বলে নরম শাড়ি, হালকা গয়না, নথ-- এগুলোই বেছে নিই। ছেলেদের ধুতি, জোড় বাধ্যতামূলক। আমাদের মাকে নিয়ে অনেক অলৌকিক ঘটনাও আছে। এক বছর, এক সাংবাদিক চিত্রগ্রাহককে নিয়ে পুজোয় এসেছিলেন। সাংবাদিক কথা বলছেন আমার সঙ্গে। চিত্রগ্রাহক দালানে বসে। তার আগেই জোর গলায় জানিয়েছেন, তিনি ঠাকুর-দেবতা মানেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মত বদল! আমাকে ডেকে জানালেন, মাকে তিনি নড়তে দেখেছেন। এখনও প্রতি বছর প্রতিদিন মায়ের মুখের আদল বদলে যায়। আগের দিন যে মুখ দেখে আমরা শুতে যাই, পরের দিন সেই মুখ আর দেখতে পাই না। কিছু না কিছু বদল আসবেই। সত্য-মিথ্যা প্রমাণের জন্য ছবি তুলে পরখ করে দেখেছি। ক্যামেরাতেও সেই পরিবর্তন স্পষ্ট। তবে এক বছরের কথা না বললেই নয়। প্রতি বছর দশমীর বরণের পরে মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে অগ্নিদেব জোড়হাতে মাকে পরের বছরের আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় দেন। বলেন, ‘‘আবার এসো মা।’’ এক বছর এই নিমন্ত্রণ জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সে বছর কেউ কিছুতেই দেবী প্রতিমা নাড়াতে পারেননি! শেষে আমার পরিচালক স্বামী হাত জোড় করে জানু পেতে মায়ের সামনে বসে আমন্ত্রণ জানাতেই নড়ে ওঠে কাঠামো।

আমরা সে বার সবাই কেঁদে ফেলেছিলাম, মা আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছেন না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE