Advertisement
Durga Puja Celebration

আঁচলে অ্যাত্তোখানি আর খোল এত ফাঁকা!

যে দিন সন্ধেবেলায় শাড়ির দোকানে যাওয়া হবে, সে দিন ভোর থেকে গোটা বাড়ির আবহাওয়াটাই যেন বদলে যেতে শুরু করে।

পুজোয় শাড়ি ছাড়া চলে না বঙ্গ ললনাদের।

পুজোয় শাড়ি ছাড়া চলে না বঙ্গ ললনাদের।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ১০:২০
Share: Save:

এটা সবাই জানে, যে কোনও বাঙালি বাড়িতে তত দিন পর্যন্ত পুজোর গন্ধ ঠিক সেই ভাবে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় না, যত দিন না সে বাড়ির মেয়েদের জন্যে পুজোর শাড়ি কিনতে যাওয়া হচ্ছে। আর শতকরা পঁচানব্বই ভাগ কন্যা-জায়া-জননীর কাছে পুজোর শাড়ি কিনতে যাওয়াটা তো কোনও সাধারণ কাজে যাওয়া নয়, ছোটখাটো একটা এক্সপিডিশন।

যে দিন সন্ধেবেলায় শাড়ির দোকানে যাওয়া হবে, সে দিন ভোর থেকে গোটা বাড়ির আবহাওয়াটাই যেন বদলে যেতে শুরু করে। খোকাবাবু হয়তো সে দিন সকালে স্কুলে বেরনোর আগে আলুসেদ্ধ-ভাতের বদলে এগ-চাউমিন পায় আর তার টিফিনে পাউরুটির বদলে যায় পরোটা-আলুভাজা। খোকাবাবুর মৃদু কোলেস্টেরল-বাবার কপালেও সে দিন হয়তো শশা-মুড়ির বদলে ছেলের মতোই পরোটা-আলুভাজা জোটে। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ পাড়ার সব্জিওয়ালা হয়তো অবাক হয়ে দেখে বউদিমণি আজ দর না করেই কাঁচাবাজার কিনে নিয়ে গেলেন। আরেকটু বেলার দিকে সারা বাড়ি ঝাড়পোঁছ করার পর পুরনো লোক রামভজনের খেয়াল হয়, কত্তামা আজ একবারও ‘মুখপোড়া’ বলছেন না!

খোকার বাবা সে দিন অফিস থেকে ফিরে এক কাপ কফি খেয়ে, সবাইকে গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছেন গড়িয়াহাটার এক বহু পুরনো শাড়ির দোকানে। এই ধরনের অভিজাত দোকান মানেই, দোকান ঘরের মেঝেয় বিশাল মাপের ধবধবে ফরাশ পাতা। আর বাংলাশার্টের সঙ্গে নরুনপাড় ধুতি পরা বিক্রেতারা, মুখে মিছরিধোয়া হাসি নিয়ে, তার উপরে বাবু হয়ে বসে খরিদ্দারকে শাড়ি দেখাতে শুরু করবেন। কোনও বয়স্ক খরিদ্দারের যদি গেঁটে বাত থাকে অর্থাৎ হাঁটু মুড়ে বসতে অসুবিধা হয়, তবে ফরাশের বাউন্ডারির কাছে তাঁকে একটি স্বাস্থ্যকর, ছোট মাপের টুল দেওয়া হবে। যাতে বসে তিনি সমুদ্রের তীর থেকে ঢেউ দেখার মতো করে শাড়ি দেখতে পারেন। ইচ্ছে হলে সেগুলো ছুঁয়ে দেখতেও কোনও অসুবিধা নেই।

আরও পড়ুন: শরতের এই-মেঘ এই-বৃষ্টির মতো প্যান্ডেলের পারিজাতকে ভাল লাগার শুরু​

আরও পড়ুন: ভোরের শিউলি, রাতের ছাতিম নিয়ে পুজো আসছে​

এর পরেই কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আসল ক্লাইম্যাক্সের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে। কারণ, ধৈর্যের পরীক্ষা শুরু হবে সেই ঝানু বিক্রেতার, যিনি মা-জননীদের শাড়ি পছন্দ করানোর গুরুদায়িত্ব স্ব-ইচ্ছায় নিজের ‘হাতে’ তুলে নিয়েছেন। চার দিকের দেওয়ালজোড়া তাক থেকে একে একে নেমে আসবে ঢাকাই, তাঁত, বালুচরি, জামদানি, কাঞ্জিভরম, কাতান, সিল্ক, বোমকাই, বেনারসি...।

আস্তে করে শাড়ির একটা ধার তুলে, তার নীচে ঢুকে যাবে হাতের লম্বা চারটে আঙুল। তার পর বুড়ো আঙুলটির সঙ্গে তাদের সামান্য ঘষাঘষি। এর পর অবধারিত ভাবে জলে ডোবা ফাতনার মতো ঘাড়টা সামান্য নড়বে। দর হবে। দাম হবে। বিক্রেতা ভাববেন, এই বার টোপটা বঁড়শি-সমেত নিশ্চয়ই নীচের ঠোঁটে ঠিকঠাক গেঁথে গিয়েছে। কিন্তু হরি হরি! শেষ মুহূর্তে ফস এবং হুস! আবার বুড়বুড়ি। আবার ফড়িং ওড়া। আবার সেই বৃষ্টি ও রোদ্দুর। মানে, ওই একই স্টাইলে ঘণ্টা দেড়-দুই ধরে বউদিমণি শাড়ি দেখবেন। কত্তামা শাড়ি দেখবেন। দেখে চলবেন তো দেখেই চলবেন! থামবেন না। খোকার বাবা দোকানে ঢোকা থেকে খেপে খেপে মোবাইল ঘাঁটবেন। ফোন করবেন দু’-তিনজনকে। বার দুই বাইরে গিয়ে আকাশে-বাতাসে ধোঁয়া উড়িয়ে আসবেন। কিন্তু, সময় তো কাটতেই চাইবে না!

খোকাবাবু প্রথম দিকটায় মায়ের গা ঘেঁষটে বসে নানা রকম শাড়ি দেখবে। এর পর বেঁটে বেঁটে কাচের গেলাসে আসা কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবে। শেষে বাবার কাছে গিয়ে মোবাইলে গেম খেলার জন্যে কিছু ক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে, ফরাশের এক পাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে। শুয়ে শুয়ে দেখবে, কী ভাবে এক জন সরুমতো রোগা লোক কখনও লম্বা একটা টুলে দাঁড়িয়ে, আবার কখনও তাকের উপর ঝুল খেয়ে উঠে গোছা গোছা শাড়ি নামিয়ে আনছে। এনে দিচ্ছে ধুতি পরা জেঠুটার হাতে। একটার পর একটা শাড়ি ভাঁজ খুলে বেরিয়ে, এ ওর উপরে উঠে একটা ছোটখাটো পাহাড়ে মতো হয়ে যাচ্ছে! মা আর আম্মার কোনও শাড়িই পছন্দ হচ্ছে না। মুখ দুটো যেন থমথমে, গম্ভীর। ওর পড়া না পারার মতো রাগ রাগ। মায়ের ডান পাশে অবশ্য তিন-চারটে শাড়ি আলাদা করে সরানো রয়েছে, কিন্তু মা সে দিকে মোটেও তাকাচ্ছে না। বাবা এক বার বুঝিয়েছিল, ওগুলো আসলে সিলেকটেড— মুখে কিচ্ছু বলা হচ্ছে না— শেষে ঠিক নেওয়া হবে। খোকাবাবুর কানে মাঝে মাঝে যে কথাগুলো ভেসে আসছে, তার সবটা কিন্তু ও ধরতে পারছে না। যেমন, ‘একটু ডিসেন্ট কালার বের করুন, যেটা ফর্মাল!’, ‘এ বার হাজার বুটিগুলো দেখান।’, ‘কেন, অলওভার কাজ নেই?’, ‘আঁচলে অ্যাত্তোখানি আর খোল এত ফাঁকা!’, ‘ব্লাউজ পিস কই?’, ‘এটা ছিল বেশ— চুমকি বসিয়েই সব শেষ!’

খোকাবাবু এ বার রাজহাঁসের মতো সাদা পোশাক পরা, শাড়ি দেখানো জেঠুটাকে মন দিয়ে দেখতে শুরু করে। জেঠুটা এক বার নীলচে-সবুজ একটা শাড়ি নিজের বুকের উপর পেখমের মতো মেলে ধরে ময়ূর হয়ে যাচ্ছে। এক বার ধূসররঙা একখানা শাড়ি কাঁধের উপর ফেলে যেন হয়ে যাচ্ছে ইঁদুর। হঠাৎ সামনের জায়গাটা ফাঁকা করতে গিয়ে একপাঁজা শাড়ি দু’হাতে তুলে ধরে নিজের চশমার ভিতর দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে হয়ে যাচ্ছে পেঁচা। আবার কখনও, যে হেল্পারদাদা তাক থেকে শাড়ি নামিয়ে আনছে, তাকে দু’হাত উঁচিয়ে নিজের ঘাড় পর্যন্ত চুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে এমন ভাবে বকছে, যেন মা দুগ্গার সিংহ। খোকাবাবু এ বার ঘাড় ফিরিয়ে এক বার মাকে আর এক বার আম্মাকে দেখে ভাবতে চেষ্টা করছে, কাকে মা দুগ্গা ভাবা যায়, আর কাকে লক্ষ্মী।

ওর যেটা জানা নেই, সেটা হল পুজোর আগে প্রতিটি বাঙালি বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ওর বাবার মতো যে সমস্ত পুরুষ শাড়ির দোকানে শাড়ি কিনতে যান, তাঁরা প্রত্যেকে ধৈর্যে, স্থৈর্যে, প্রেমে ও সহিষ্ণুতায় খোদ দেবাদিদেবের চেয়ে এক সুতোও কম নন। বরং সামান্য উপরেই।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE