নীল আকাশের নীচে ডানা মেলেছে গুটিকয়েক বকের পাঁতি। কমলদিঘির ফোটা শতদলে এক জোড়া কালো ভ্রমর অতি সন্তর্পণে কী যেন খুঁজে চলে। সে দৃশ্য উপেক্ষা করেই পাশ কাটিয়ে একদল হাঁস আপন মনে বেরিয়েছে অণ্বেষণে। মৃদু হাওয়ায় দিঘির ধারে কাশবনে ঢেউ লেগেছে। দূরে বাগানে শিউলি আর শেফালি মনের সুখে বিছিয়ে রেখেছে আপন আঁচলখানি।
বাংলা নয়। তবু এক টুকরো বাংলাই যেন! শরৎ এলে প্রকৃতি এ ভাবেই সেজে ওঠে সবুজে ঘেরা ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলার মারহা গ্রামে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষও যেন প্রস্তুত হয় দেবীকে বরণ করতে। বোকারো থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে আজকের মারহা চন্দনকেয়ারি ব্লকের অন্তর্গত। গ্রামে বসবাসকারী প্রায় ২৬০০ মানুষের মধ্যে ৭০০ জন বাঙালি।
এ গ্রামের পুজো মানেই প্রায় আড়াইশো বছরেরও বেশি বয়সী, ঘোষবাড়ির সাবেক পুজো। অতীতে ঘোষ পরিবারের বসবাস ছিল পুরুলিয়ার কেটকায়। সে সময়ে এই পরিবারের এক সদস্য পুরুলিয়ার কাশীপুরের মহারাজার তহশিলদার ছিলেন। রাজা তাঁকে মারহা গ্রামে জমিদারি দেন। পরিবারের প্রবীণ সদস্য ভবতরণ ঘোষ বলছিলেন, “এই পরিবারের জমিদার রাসবিহারী ঘোষের ষোলো বছরের ছেলে নিরঞ্জন হঠাই মরণাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন। একাধিক চিকিৎসক তাঁকে সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর মা দেবী দুর্গার কাছে ছেলের আরোগ্য কামনায় মানত করেন। দৈব কৃপায় ছেলে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সেই থেকেই পরিবারে প্রচলন হয় দুর্গোৎসবের।” আজও এলাকার মানুষের সহজ সরল বিশ্বাস- দেবীর কাছে কিছু চাইলে তিনি ভক্তকে নিরাশ করেন না। সে জন্য সন্ধিপুজোয় প্রদীপ জ্বালাতে ভিড় করেন গ্রামের মহিলারা।
আরও পড়ুন: সখীবেশে রানি রাসমণির পুজোয় আরাধনা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ
সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের পরে তা পাল্কিতে করে দুর্গামন্দিরে নিয়ে আসা হয়।
বাংলার অন্যান্য প্রান্তের দুর্গা প্রতিমার চেয়ে মারহার ঘোষ পরিবারের প্রতিমা কিছুটা আলাদা। বিশেষত দেবীর গঠন এবং মুখাবয়ব। দেবীর মুখের সঙ্গে মিল আছে ছো নাচে ব্যবহৃত মুখোশের। সোনালি জরির সাজেও আঞ্চলিকতার ছাপ স্পষ্ট।
অতীতে পরিবারের সদস্যরা সকলে এই গ্রামে থাকলেও বর্তমানে বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকেন। তবু পুজোর সময় প্রতি বছরই সকলে চেষ্টা করেন গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসতে। তেমনই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষও এই পুজোয় সামিল হন। আজও এক ঘরোয়া, আন্তরিক পরিবেশ পুজো হয় মারহার ঘোষ বাড়িতে।
মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজো। তাতে গ্রামে বসবাসকারী নানা বর্ণ, নানা সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণরা পুজোর দায়িত্বে থাকেন, কুমোররা প্রতিমা গড়েন, নাপিতরা পুজোর ফুলের জোগান দেন এবং দশমীর দিনে বাউরিরা থাকেন প্রতিমা বিসর্জনের দায়িত্বে। এঁরা সকলেই বংশ পরম্পরায় এই পুজোয় কাজ করে আসছেন।
আরও পড়ুন: বিজয়িনীর হাসি আর আয়ত চোখের স্নিগ্ধতায় অনন্যা মাতৃমূর্তি
সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের পরে তা পাল্কিতে করে দুর্গামন্দিরে নিয়ে আসা হয়। বাড়ির মহিলারা নবপত্রিকাকে বরণ করে মন্দিরে তোলেন। পুজোয় তিন দিন আজও ছাগবলি হয়। বলির পরে পারিবারিক প্রথা অনুসারে হয় সিঁদুর খেলা। পরিবারের রীতি মেনে তিন দিনই বন্দুক দাগা হয়। বলির পরে আঞ্চলিক ভাষায় বাড়ির ছেলেরা দেবীর স্তুতি করেন। এই পরিবারে দেবীর আরাধনা হয় উমা রূপে। তাই বিসর্জনের সময়ে বাড়ির বৌরা কখনওই যান না।
দুর্গা দালান।
পুজো উপলক্ষে আজও বাড়িতেই ভিয়েন বসে। তৈরি হয় নানা ধরনের মিষ্টি- বেসনের লাড্ডু, আনন্দনাড়ু, আর্সি পিঠে ইত্যাদি। পুজোয় অন্নভোগ হয় না। সকালে চালের নৈবেদ্যের সঙ্গে থাকে রকমারি ফল। রাতে থাকে খই, মুড়কি, মঠ, মিছরি ও হরেক রকম মিষ্টি।
দশমীর দিন প্রতি বছর মেলা বসে। বিসর্জনের আট দিন পরে দেবীর কাঠামো জল থেকে তুলে আনা হয়। পরিবারের সদস্য সাগরময় ঘোষ ও ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ জানালেন, এ বছর করোনার জন্য পারস্পরিক দূরত্ব মেনে চলা হবে। পুজো প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের প্রবেশও নিয়ন্ত্রিত করা হবে।
বিসর্জনের পরে বাড়ির প্রবীণ থেকে নবীনতম পুরুষ সদস্যরা বাড়ি ফিরে একটি কাগজে একটি বিশেষ মন্ত্র লিখে ধান দূর্বা-সহ একটি রূপোর টাকায় সিঁদুর মাখিয়ে ছাপ দেন। এটাই পুজোর সমাপ্তি ঘোষণা করে।
সময়ের সঙ্গে আধুনিকতা গ্রাস করেছে গ্রামাঞ্চলের পুজোর ঐতিহ্যকে। তবে মারহায় এলে মনে হতেই পারে পুজোর কটা দিন সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আধুনিকতা এতটুকুও প্রভাব ফেলতে পারেনি দূর গাঁয়ের এই পুজোয়।
ছবি পরিবার সূত্রে পাওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy