যজ্ঞে তাঁকে আবাহন করা হয়নি, তবুও আগুনের শিখা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন অপরূপা এক কন্যা। যজ্ঞ থেকে জন্ম নেওয়ায় তিনি যাজ্ঞসেনী, আবার পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা হিসেবে দ্রৌপদী। মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্রের অন্যতম, যাঁকে স্ত্রী হিসেবে পেতে স্বয়ংবরে হাজির দেশ-বিদেশের মহারথীরা, তিনিই জন্মে অনাহূতা। পুত্রকামনায় দ্রুপদ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্নের পাশাপাশি ‘উপরি’ পেলেন কন্যাকে।
মহাভারতের এই আখ্যানই বুঝিয়ে দেয়, প্রাচীন ভারতে কন্যাসন্তান লাভে রাজাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। দেবীদাস আচার্য মহাভারত অবলম্বনে প্রাচীন ভারতের নারীজীবনকে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর লেখার শুরুতেও দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত। শুধু দ্রৌপদীই নন, মহাভারত দেখিয়েছে, সত্যবতী, কুন্তী, দুঃশলা— কেউই পিতামাতার আকাঙ্ক্ষিত নন। পুত্রসন্তানই একমাত্র সম্পদ। সে ইহজন্মের বস্তুগত লাভের জন্য হোক বা পরকালের সুখভোগে।
নারীজীবন বিশ্লেষণে উপসংহার বাদে পনেরোটি অধ্যায় রেখেছেন লেখক: জন্ম, শিক্ষা, বিয়ে, আর্থিক অবস্থা, পতিভক্তি, ভাগের ঘর, মা, স্বভাব, যৌনতার দু’টি পর্ব, গণিকা ও দাসী, নিয়োগপ্রথা, কামনা, ব্যভিচার ও বিধবা। জীবনের নানা পর্বে লিঙ্গ-অসাম্য ও পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকল কী ভাবে নারীদের পিষে এসেছে, অধ্যায়গুলি তা তুলে ধরে। এই পুরুষতান্ত্রিক দর্শনকে নিবিড় করে তোলে ধর্মশাস্ত্রের বিধান, যা সমাজের ‘মগজধোলাই’ যন্ত্ররূপে কাজ করে।
প্রাচীন ভারতের নারীদের শিক্ষা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। বৈদিক সাহিত্যে অপালা, ঘোষা, বিশ্ববারাদের উল্লেখ মেনে। মহাভারতেও দ্রৌপদীর মুখে নানা বিচক্ষণতার কথা শোনা যায়। কিন্তু শিক্ষায় নারীদের অধিকার? শুধু মহাভারত নয়, উপনিষদ, মনুসংহিতা, জাতকের গল্প ইত্যাদি সাহিত্যিক সূত্রকে কাজে লাগিয়ে বিপরীতধর্মী নানা ছবি তুলে ধরেছেন লেখক। মনে রাখা প্রয়োজন, এই সূত্রগুলি বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সমাজের কথা বলে। তাই একমুখী ছবি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি যে শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যকে হাতিয়ার করে পুরুষতন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠা করত, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মহাভারতে নারীজীবন
দেবীদাস আচার্য
৬০০.০০
সিগনেট প্রেস
ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিতে নারীর জন্য আদর্শ সাংসারিক জ্ঞান। তাই বিবাহের জন্য নারীর শিক্ষা নয়, তাঁর বাবা-ভাইয়ের শিক্ষাই পরম কাঙ্ক্ষিত। বিবাহেই নারী বৈদিক সংস্কার লাভ করে। বিয়ের পরে স্ত্রী আদতে সন্তান (পড়ুন, পুত্রসন্তান) উৎপাদনের যন্ত্র। পুত্রজন্ম দিতে অক্ষম নারীকে এগারো বছর পরে ত্যাগ করারও ‘অনুমতি’ দিয়েছে শাস্ত্র। বিয়ের জন্য কেমন নারী উপযুক্ত, তার বিধানও ধর্মশাস্ত্র দিয়েছে; সেই বৈশিষ্ট্য বিচারে নারীর জননাঙ্গের গঠনও বাদ যায়নি!
পুরুষতন্ত্রের এই আধিপত্য বিশ্লেষণে দাম্পত্যের নিবিড় পরিসরও বাদ দেননি লেখক। সুদর্শন-ওঘবতীর গল্প বলে দেখিয়েছেন, পতিব্রতা হিসেবে স্বামীর নির্দেশ অনুযায়ী ওঘবতী ব্রাহ্মণরূপী মৃত্যুর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হন। সে কথা জেনেও ‘অতিথি’র তৃপ্তির পথে বাধা হন না সুদর্শন। বিনিময়ে মৃত্যুঞ্জয়ী হন তিনি। এই গল্প বোঝায়, নিজের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে স্ত্রীকে যে কোনও ভাবে ব্যবহারও পুরুষতন্ত্র-অনুমোদিত। মহাকাব্যের নানা গল্প পুরুষতন্ত্র মেনে চলা মেয়েদেরই ‘আদর্শ নারী’ বলে নির্ধারণ করেছে। এই নারী-আখ্যানে মিশে থাকে এক নারীর সঙ্গে আর এক নারীর দ্বন্দ্ব। পুরুষতন্ত্র-নির্ধারিত সেই দ্বন্দ্বের মূল বস্তু পুরুষই: কখনও স্বামী নিয়ে সতিনদের ঝগড়়া, কখনও সতিন পুত্রসন্তানের (কখনও অধিক পুত্রসন্তানের) মা হওয়ায় বিবাদ। আবার নারীকে সংজ্ঞায়িত করতে পুরুষ বেছে নেয় এক নারীচরিত্র, অপ্সরা পঞ্চচূড়়াকে। নারীর স্বভাব-ব্যাখ্যার ভরকেন্দ্র অবশ্য যৌনতা। মহাভারতের গল্পে-গল্পে যৌনতাড়নায় নারীদের পদস্খলনের আখ্যান।,তার বাইরে নারীর স্বভাবে যেন কিছুই নেই!
নারীর যৌনতাও যে পুুরুষ-নিয়ন্ত্রিত, সে কথাও মনে করিয়ে দেন লেখক। এই পর্যায়ের দু’টি অধ্যায়ের নামও আকর্ষণীয়— ‘বাগে আনতে লাঠি’ এবং ‘জলের তোড়ে পা না ভাঙে’। এই পর্বে ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শে নারীর শরীরের উপরে পুরুষের প্রতিপত্তি স্থাপনের কথা যেমন শোনা গিয়েছে, তেমনই নজর পড়ে রাক্ষসী হিড়িম্বা বা নাগকন্যা উলুপীর গল্পেও। দু’জনেই নিজের ইচ্ছেয় কামতাড়িত হয়ে ভীম ও অর্জুুনের সঙ্গলাভ করেছিলেন। এই দু’জনের গল্প ইঙ্গিত দেয়, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বাইরে থাকা নারীদের যৌন-স্বাধীনতা ছিল। আবার পরের পর্বেই ফিরে এসেছে পুরুষতন্ত্রের হাতকড়ার কথা, যেখানে গণিকার পাশাপাশি দাসীদের উপরেও মালিকের যৌন নির্যাতনের কথা এসেছে। মহাভারতের গল্পে কীচকের হাতে সৈরিন্ধ্রীরূপী দ্রৌপদীর নিগ্রহের কথা তারই প্রমাণ। মালিক হিসেবে যুধিষ্ঠিরও তো পাশাখেলায় লক্ষ দাসীকে পণ রেখেছিলেন।
যৌনতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত নিয়োগ প্রথা, কামনা ও ব্যভিচার নিয়ে অধ্যায়গুলি। স্বামী সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ হলে সন্তানলাভে পরপুরুষের কাছে যেতে হত স্ত্রীকে। তাঁর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনও মূল্য নেই। মহাভারতে নিয়োগ প্রথার উল্লেখ বার বার এসেছে, কাম ও ব্যভিচারের কথাও। প্রতি পদে ধর্মশাস্ত্রীরা দেখিয়েছেন, অসংযত কাম বা ব্যভিচারে দুষ্ট নারীরা। বহু মহিলা-সংসর্গে পুরুষের দোষ হয় না। বৈধব্যও নির্দিষ্ট মেয়েদের জন্যই। তবে এই বইয়ে ‘মা: পৃথিবীর চেয়ে ভারী’ অধ্যায়টি পাঠকের বিশেষ প্রাপ্তি। মহাযুদ্ধের পরে কুন্তী ও গান্ধারীর অনুতাপ ও ক্রোধের বিবরণ ও বিশ্লেষণ যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে, সন্দেহ নেই।
মহাকাব্য, জাতক, উপনিষদ, ধর্মশাস্ত্রের সূত্র ধরে নারীর অবস্থার বিশ্লেষণ পড়তে পড়তে মনে হয়, আধুনিক ভারতেও কি শাস্ত্রভিত্তিক মানসিকতা থেকে বেরোতে পেরেছি আমরা? উত্তর যে নেতিবাচক, শেষ কথায় সেই ইঙ্গিতও দেন লেখক।