Review

নারীর আত্ম-অভিজ্ঞান

শাস্ত্রমতে বিধবাবিবাহের যতই আয়োজন বিদ্যাসাগর করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত দেশাচার ও লোকাচারকেই বড় হয়ে উঠতে দেখি।

অপরাজিতা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:২৬

১৮৮৬ থেকে ১৯২৯, সংক্ষিপ্ত জীবন সরসীবালার। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে, নয় ছেলেমেয়ের মা, তবু সাহিত্যসাধনায় ভাটা পড়েনি। লিখেছেন প্রায় কুড়িটি উপন্যাস, তিনটি ছোটগল্পের বই, একটি নাটিকা, একটি কাব্যগ্রন্থ। তাঁর রচনাবলির প্রথম খণ্ডে স্থান পেয়েছে চারটি উপন্যাস— কালানুক্রম অনুযায়ী: প্রায়শ্চিত্ত (১৩২৬বঙ্গাব্দ), প্রতিষ্ঠা (১৩২৭), পরিত্যক্তা (১৩৩০), আর তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত আগে প্রবাল (১৩৩৪)।

প্রতিটি উপন্যাসই একটি সামাজিক সমস্যাকে ধরে তার প্রতিকার খুঁজতে চায়। বৈধব্যকে কেন্দ্র করে লেখা প্রতিষ্ঠা উপন্যাস পুনর্বিবাহের সমাধানসূত্র পেশ না করে বরং বিধবাদের স্বনির্ভর করে তোলার এক বিকল্প রাস্তার প্রতি নির্দেশ করে। এই উপন্যাসের প্রফুল্ল চরিত্রটি দুর্বলচিত্ত, স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে অপারগ। এখানে গৃহস্থের ঘরে বিধবার গর্ভসঞ্চার ও ভ্রূণহত্যার মতো রূঢ় বাস্তবকে স্পষ্টভাবে আসতে দেখি। আবার কোনও চরিত্র যেন হয়ে ওঠে বিবেক, সামাজিক বিচারবুদ্ধি, অনুশাসন এবং নারীজীবনের নিয়ন্ত্রক পুরুষশক্তিকে খোলাখুলি ধিক্কার জানায়। কিন্তু, শাস্ত্রমতে বিধবাবিবাহের যতই আয়োজন বিদ্যাসাগর করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত দেশাচার ও লোকাচারকেই বড় হয়ে উঠতে দেখি।

প্রায়শ্চিত্ত-এর নায়ক ‘স্বদেশী হাঙ্গামা’য় যোগদানের পর ঘরে ফিরলেও সামাজিক প্রত্যাখ্যান তার মধ্যে হতাশা ও অবসাদের জন্ম দেয়, এমনকি ব্যক্তিগত প্রেমসম্পর্কও অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। এক নারীচরিত্রের পিতা, ব্রিটিশ রাজকর্মচারী, বিরক্তি প্রকাশ করেন, “এইসব রাজদ্রোহী যুবকগুলো, এতো আমাদের জাতীয় কলঙ্ক, এদের কোনও সংস্রব রাখা আমাদের উচিত নয়।” কিমাশ্চর্যম্, একদা-স্বদেশি নায়ক রতিকান্ত শেষ বিচারে ‘অন্যায়’ করেছিল বলেই সাব্যস্ত হয়, আর সেও সর্বাঙ্গীণ এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিবর্তে আরও গুটিয়ে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ আত্মহনন বেছে নেয়। প্রশ্ন জাগে, একদা স্বদেশির এই ব্রতী কেন এত দিগ্‌ভ্রান্ত, অবসাদগ্রস্ত? এমন চরিত্র কি আদৌ বাস্তবসম্মত?

প্রবাল উপন্যাসে নায়কের উক্তি, “গোটা কত মাথা ক্ষ্যাপা বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো ছেলে জুটে মাণিকতলায় কী বোমা বারুদ তুবড়ি ত’য়ের করেছে তাতে কি আর ইংরেজ বাহাদুরের সিংহাসন ভাঙবে না কেল্লা ফাটবে? সরকার ছেলেগুলোকে ধ’রে এনে দিনকতক খাঁচায় ভ’রে রেখে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” সবিস্ময়ে ভাবি, সেই সময় সশস্ত্র বিপ্লববাদের ধারাকে কি বাঙালি মধ্যবিত্তের গৃহে এ রকমই অশ্রদ্ধা করা হত, না কি এমন মন্তব্যের পিছনে কোথাও সরসীবালার প্রচ্ছন্ন রাজভক্তি ক্রিয়াশীল?

পরিত্যক্তা উপন্যাসে সামাজিক দ্বিচারিতার অদ্ভুত ছবি— যৌনবিকারগ্রস্ত দুই ব্যক্তি গৃহস্থ পুরুষদের অনুপস্থিতির সুযোগে অন্দরে ঢুকে দুই গৃহবধূর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দেয়। বধূরা প্রতিরোধ করলেও পল্লিসমাজের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়, তাঁদের ঘরে ফেরত নিতে অস্বীকার করে পরিবারের পুরুষরা। চমকিত হয়ে দেখি, তাঁদের সর্বদা বাক্যবাণে জর্জরিত করতেন যে শাশুড়ি, একমাত্র তিনিই সেই দুঃসময়ে বধূদের পাশে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সরসীবালা দেখান, সংসারের দৈনন্দিন পরিসরে যে শাশুড়িকে দাপুটে ক্ষমতাবান মনে হয়, বৃহত্তর পুরুষতন্ত্রের সামনে তিনি অসহায়।

সরসীবালা বসু রচনা সমগ্র ১

সঙ্কলন: সোমাইয়া আখতার

৯০০.০০

রাবণ

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অন্ধকার কোণে আলো ফেলেছেন সরসীবালা। নারীর অধিকার বিষয়ে, তার অবমাননা-বঞ্চনার প্রসঙ্গে জোরালো বক্তব্য তাঁর। মাঝে মাঝে চমকপ্রদ শব্দচয়নে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন রূঢ় সমাজবাস্তবের সামনে: “বাঙলা দেশে কানা হোক খোঁড়া হোক কুঁজো হোক রুগ্ন হোক, অক্ষম হোক পুরুষ যে পুরুষ এই পরিচয় নিয়ে অনায়াসে ক’নের বাজারে বেরুলেই বাজীমাৎ।”

রক্ষণশীল গ্রামসমাজ প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেরই প্রেক্ষাপট, দু’-এক বার উঁকি দিয়ে যায় জাতপাতের ভয়ঙ্কর বাস্তব। যেমন, বহুদিনের অনুগত দাসী জাতে বাগদি বলে অসহায় অবস্থাতেও তার জল গৃহিণীর কাজে আসে না। বিশেষত এই সমাজের মেয়েমহলের মানসিকতা লেখিকা ফুটিয়ে তোলেন অনায়াসে। প্রবাল উপন্যাসে এক নারীর উক্তি, “মেয়েমানুষ আবার বর পছন্দ ক’রবে কি? কোন্ দিন শুনব ব’লছে— আমি স্বয়ম্বরা হব… মেয়ে-মানষের বাড় কলা-গাছের বাড়, দু-দিনেই মাগী হয়ে উঠবে তখন ঠেকাবে কে?” এই সময়কালে বাঙালি নারীর আত্ম-অভিজ্ঞানে প্রাচীনা বনাম নবীনার সংঘাতেরও আভাস রয়েছে এই উপন্যাসে। সতীত্বের তেজ, সংসারে মেয়েদের নিঃস্বার্থ প্রেমের আদর্শ নিয়ে প্রাচীনপন্থী রমার দীর্ঘ বক্তৃতার পর নবীনা প্রিয়ব্রতা সহজ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারে, “ব্যভিচার অসংযম প্রভৃতি মেয়েমানুষের পক্ষেও যেমন দোষের, পুরুষের পক্ষেও তাই।”

ভূমিকায় সোমাইয়া আখতার বলেছেন, সরসীবালা রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র দু’জনের দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। প্রবাল উপন্যাসে প্রবাল ও কেদারের বন্ধুত্ব যেন গোরা ও বিনয়ের বন্ধুত্বকেই মনে করায়। আবার উপন্যাসের নায়িকা, বিধবা সেবার সঙ্গে আশ্চর্য মিল রবীন্দ্রকবিতা ‘নিষ্কৃতি’র মঞ্জুলিকার— শুধু অকালবৈধ্যব্যের মধ্যেই নয়, দু’টি মেয়ের বাবা-ই স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহ করে ঘরে নিয়ে আসেন বালিকা বধূ!

চারটির মধ্যে তিনটি উপন্যাসেরই পরিণতি বিয়োগান্তক। শুধু প্রবাল উপন্যাসেই সরসীবালা ভরসা জাগাতে পারেন। ভাষা ব্যবহারের দিক থেকেও এই উপন্যাস অপেক্ষাকৃত পরিণত, একমাত্র এখানেই ব্যবহৃত চলিত ভাষা। উপন্যাসের শেষে এক যুবতী বিধবার প্রেম কর্মমুখর দাম্পত্যে পরিণতি পায়। “বিশ্বজয়ী প্রেমের বলে তুমি সহজেই সকলের বিদ্বেষ সকলের অপ্রীতিকে জয় করে নিতে পারবে,” উপন্যাসের শেষ বাক্যটি পাঠককেও আশাবাদে উত্তীর্ণ করে।

সরসীবালা যখন লিখছেন সেটা উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, একই সঙ্গে বাঙালি তথা ভারতীয় নারীজাগরণেরও। বিশ শতকের গোড়ার দশকগুলিতে বাঙালি মেয়েদের লেখার জগতে এক জরুরি বিস্ফোরণ ঘটে। জ্যোতির্ময়ী দেবী, অনিন্দিতা দেবী, সরলাবালা সরকার, শান্তিসুধা ঘোষের লেখায় উন্মোচিত হয় পিতৃতন্ত্রের অজস্র বন্ধনের স্বরূপ, যার গোড়াপত্তন বেগম রোকেয়ার হাত ধরে। এই বৃহত্তর রাজনৈতিক বৌদ্ধিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে সরসীবালার রচনাকর্ম বুঝতে সুবিধে হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মহিলা প্রাবন্ধিক দূরস্থান, মহিলা ঔপন্যাসিকরাও আজ বিস্মৃতপ্রায়। গোড়ার কথায় অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন, বাংলা সাহিত্যের পাঠক্রমে এখন এঁদের উপস্থিতি নগণ্য। সরসীবালা বসুও ব্যতিক্রম নন, বাঙালির পাঠাভ্যাসে আশ্চর্যজনক বিস্মৃতির গ্রাস তিনিও। তাঁর রচনাসমগ্র খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করে বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিককে পুনর্বার জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য প্রকাশক তাই বিশেষ ধন্যবাদার্হ।

আরও পড়ুন