কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন,/ ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে!’ আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটি-র রাজনীতি দীর্ঘ দিন ধরে এক কঠিন সমীকরণে আবদ্ধ ছিল। অপরিমিত অর্থবল, বৃহৎ রিয়াল এস্টেট লবি, সংবাদমাধ্যমের প্রকাশ্য ও পরোক্ষ পক্ষপাত, এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অন্দরের স্থায়ী প্রভাবশালী গোষ্ঠী— বিল ক্লিন্টন, চাক শুমার, অ্যান্ড্রু কুয়োমো, ন্যান্সি পেলোসি, বারাক ওবামা। এই প্রেক্ষাপটে গত ৪ নভেম্বরের মেয়র নির্বাচন সাধারণ কোনও নির্বাচন ছিল না, বরং ছিল ক্ষমতার এই দুর্গকে চ্যালেঞ্জ করার এক মুহূর্ত।
চৌত্রিশ বছর বয়সি প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী যুবক জ়োহরান মামদানি (ছবি) সেই চ্যালেঞ্জের নেতৃত্ব দিলেন। যে নেতৃত্ব আজকের আমেরিকার রাজনীতিতে এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ বদলের ইঙ্গিত বহন করে। তাঁর এই যাত্রাপথের নেপথ্যে রয়েছে তিনটি মূল শক্তি। এক, তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক সমাজবাদের প্রয়োগকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়া। দুই, অভিবাসী ও সংখ্যালঘু পরিচয়ের প্রতি নির্ভীক আস্থা, এবং তিন, একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রগতিশীল পরিবারে বেড়ে ওঠার প্রভাব। ব্লুমবার্গ-ক্লিন্টন ধারার অতি-ধনী পরিমণ্ডল, নিউ ইয়র্ক রিয়াল এস্টেট লবি, এবং অ্যান্ড্রু কুয়োমো-র মতো রাজনীতিকের পিছনে লাগাতার কোটি কোটি ডলার ঢালা হয়েছিল— এ অভিযোগ নতুন নয়। বরং, এই অর্থশক্তি বহু দিন ধরেই নিউ ইয়র্কের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এর আগ্রাসন শহরের বাসস্থান সঙ্কট থেকে পুলিশি বাজেটে মানুষ দেখেছে বহু বছর ধরে।
বহু কাল ধরে গড়ে ওঠা শ্রমজীবী নিউ ইয়র্কবাসীদের ক্ষোভ প্রথম বার একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক মাধ্যমের রূপ নিল, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জ়োহরান। এক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী-কর্মী জ়োহরানের হয়ে এক বছর ধরে কাজ করেছেন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকা দলের নেতৃত্বে। তাঁর প্রচারে কোনও কোনও বড় লবি, কোনও ধনী দাতা ছিল না। ছিলেন সাবওয়ে চালক, ছোট ছোট দোকানি, অ্যাপ ডেলিভারি চালক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, কিছু প্রগতিশীল শ্রম ইউনিয়ন, এবং পাবলিক হাউসিং-এর অসংখ্য দরিদ্র বাসিন্দা। নিউ ইয়র্কে শ্রমজীবী মানুষের এই সংহতি এক দিনে তৈরি হয়নি। গত পাঁচ বছরে বাসাভাড়ার অমানবিক বৃদ্ধি, বেতন থমকে যাওয়া, ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য, পুলিশি অত্যাচার এবং সামাজিক সেবার সঙ্কোচন— সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ একটি বিকল্প পথ খুঁজছিল। জ়োহরান সেই বিকল্পকে ভাষায়, নীতিতে এবং পরিকল্পনায় রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন।
জ়োহরানের পুরো প্রচারের একটি অপ্রিয় বাস্তবতা ছিল— মিডিয়ার পক্ষপাতমূলক ভূমিকা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিডিয়া তাঁকে প্রথম দিন থেকেই ‘কমিউনিস্ট’ বলে দাগিয়ে এসেছে, যা আমেরিকায় প্রায় একটি অপরাধমূলক শব্দ। ইতিহাস-অচেতন মানুষকে এই একটি শব্দ দিয়েই এ দেশে জব্দ করা সম্ভব। আমেরিকার রাজনীতিতে মুসলিম পরিচয়কে আজও ভাল চোখে দেখা হয় না। ট্রাম্পবাদের ভূত এখন গভীর, অভিবাসীদের প্রতি কর্তৃত্ববাদী এবং নিপীড়নমূলক আচরণ এখন স্বাভাবিক। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে জ়োহরানের মতো এক জন তরুণ মুসলিম, যিনি প্রকাশ্যে প্রার্থনা করেন, নিজের পরিচয়কে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন। এ শুধু ব্যক্তিগত সাহস নয়— এটি মুসলিম-আমেরিকানদের, এবং প্রকাশ্য ও অ-প্রকাশ্য জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়া অভিবাসীদের দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের এক বিলম্বিত সম্মান। শ্রমিক, ট্যাক্সিচালক, রেস্তরাঁকর্মী, ছোট ব্যবসায়ী, স্কুল-শিক্ষক— এই সব মানুষ নিউ ইয়র্কের বিশাল অর্থনীতি গড়ে তুলেছেন তাঁদের শ্রম দিয়ে। ওয়াল স্ট্রিটের আকাশচুম্বী টাওয়ারগুলো তাঁদেরই রক্তে নির্মিত। অথচ, রাজনীতির ক্ষমতার কেন্দ্রে তাঁদের স্থান ছিল না কখনও। জ়োহরানের জয়ের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল, সংখ্যালঘু পরিচয় আর নিষিদ্ধ নয়, বরং বৈচিত্রময় আমেরিকার প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তি।
জ়োহরানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির নেপথ্যে রয়েছে তাঁর পরিবার। মা মীরা নায়ার পরিচালিত সালাম বম্বে!, মিসিসিপি মসালা শুধু সিনেমা নয়, বরং অবহেলিত মানুষের গল্পকে কেন্দ্র করে এক মানবিক ও রাজনৈতিক ভাষা। এই অভিজ্ঞতা জ়োহরানের রাজনৈতিক ভাবনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। বাবা মেহমুদ মামদানি, এক জন নৃতাত্ত্বিক-অধ্যাপক, গড়ে তুলেছেন তাঁর বিশ্লেষণী মন।
এই দুই প্রবাহ— মানবিকতা এবং যুক্তিবোধ— জ়োহরানকে এমন এক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে, যিনি শুধুমাত্র রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা খোঁজেন না, বরং নিজের অঞ্চলের তীব্র অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য বুঝে কিছু সমাধানেরও পথ দেখান।
অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং তাঁর ধনী পৃষ্ঠপোষকরা ভেবেছিলেন ভয়, ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুৎসা, উপহাস-পরিহাস, এবং অর্থশক্তি দিয়ে তাঁরা জ়োহরানকে সহজেই হারিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু ফল হল উল্টো। ব্যক্তিগত অপমান ও আক্রমণ, নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি, সংবাদমাধ্যমের বর্ণবাদী প্রচার— সব কিছুই সাধারণ মানুষকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করেছে, সংগঠিত করেছে। নতুন আমেরিকার শ্রমজীবী গণতন্ত্রের এক ঐতিহাসিক উত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছেন জ়োহরান মামদানি। মানুষের চোখের সামনেই ঘটে গেল এক অহিংস, গণতান্ত্রিক বিপ্লব।