ক্রোধান্ধ: ছাত্রনেতা শরিফ ওসমান হাদির হত্যার পর সাংস্কৃতিক-সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলা, ঢাকা, ১৯ ডিসেম্বর। \ ছবি: রয়টার্স।
শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের অগস্টে দেশ থেকে বিতাড়িত হলেন যে আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের ফলে, সেটা শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরি সংরক্ষণের প্রসঙ্গ ধরে। পরে বিষয়টা ঘুরে গেল সরকার পরিবর্তনের ডাকে, যার পিছনে ছিল পাকিস্তানের সমর্থন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি সংগঠন জামায়াতে ইসলামী— পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’— নেতৃত্ব দিল এই আন্দোলনে। তার পর থেকেই বাংলাদেশ এক সঙ্কট থেকে আর এক সঙ্কটের ঘূর্ণিপাকে ঘুরেই চলেছে।
সে দেশের অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সেই ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর থেকেই রাজনৈতিক উচ্চাশা বহন করছেন। তাঁর প্রশাসন অধুনা বাংলাদেশে সমস্ত রকম ভাবে ব্যর্থ। তাঁর প্রধান সমর্থনকারীরা সকলেই ইসলামি গোষ্ঠীভুক্ত— তাঁদের নেতৃত্বে গত বৎসরাধিক কাল ধরে সে দেশে দেখা গেল অবারিত গণহিংসা (মব ভায়োলেন্স), অর্থনৈতিক সঙ্কট, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নির্বিচার হত্যা, সংখ্যালঘু পীড়ন ও হত্যা, আইনশৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি।
অন্তর্বর্তী সরকারকে কব্জা করে এই গোটা সময়টা ধরে জামায়াতে পুরোদস্তুর প্রতিহিংসার রাজনীতি চালিয়েছে। ছাত্রনেতারাও ক্ষমতার পালাবদল হতেই নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। ভারতবিরোধী স্লোগান উঠেছে অন্য স্তরে। সম্প্রতি এক তরুণ নেতার গলায় শোনা গেল, উত্তর-পূর্ব ভারতকে আলাদা করে দিয়ে ‘বাংলাদেশ’-এ ঢুকিয়ে নেওয়া হবে।
এই সব উস্কানি আসছে প্রবল হিংসার বাতাবরণে। ছাত্রনেতা হাদির হত্যার পর এই পর্ব শুরু হল, তিনি খ্যাত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী আর ভারতের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণার উদ্গিরণের জন্যই। এমন উস্কানিমূলক মন্তব্য স্বভাবতই দিল্লি ভাল চোখে দেখছে না। দুই দেশের মধ্যে কূটনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দ্রুত। হাদি হত্যার পর থেকে ভারতবিরোধী ইসলামি স্লোগানে উন্মাদ জনতার ঢল আক্রমণ করেছে প্রথম আলো ও দ্য ডেলি স্টার সংবাদপত্র অফিস, ‘ছায়ানট’ সঙ্গীত শিক্ষায়তন ও সংস্কৃতি কেন্দ্র। এর আগেই জামায়াতের নির্দেশে অন্তর্বর্তী সরকার স্কুলে-স্কুলে সংস্কৃতিচর্চা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে। ময়মনসিংহের দীপু দাসের কথা ইতিমধ্যে সর্বজনবিদিত। ভারত সরকার কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাতে ঢাকা থেকে বলা হল, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সংখ্যালঘুর উপর সংগঠিত আক্রমণ বলে একে ভাবা অনুচিত। এখনও অবধি যেটুকু তদন্ত হয়েছে, তাতে প্রকাশ, নিহত ব্যক্তি আসলে ইসলাম ধর্মের অবমাননাসূচক তেমন কিছু বলেননি।
তবে ‘ছায়ানট’-এর উপর আক্রমণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, বাংলাদেশে এখন ইসলামি সংস্কৃতি চালু করার তোড়জোড় চলছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যই শেখ মুজিবের বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, স্কুলের পাঠ্যবই নতুন করে লেখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত যত ভাস্কর্য-স্থাপত্য, সে সব ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে। প্রতি ঘটনার পরেই ইউনূস সরকারের একই বক্তব্য শোনা গিয়েছে— ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। হিন্দুদের উপরে কোনও আক্রমণই নাকি ‘সাম্প্রদায়িক’ নয়, ‘রাজনৈতিক’ও নয়! এক দিকে তিনি ইসলামি গোষ্ঠীর সঙ্গে পুরোদমে পা মেলাচ্ছেন, অন্য দিকে সব ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক ঘটনা থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করছেন। ইউনূসের রাজনৈতিক উচ্চাশা চরিতার্থ, ৮৪ বছর বয়সে এখনও তিনি ক্ষমতাসীন থাকতে চান। কত দিন, সেটা অবশ্যই একটা বড় প্রশ্ন।
ইতিমধ্যে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন এবং চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটের কনসুলেটে আক্রমণ করেছে ‘মব’। সুতরাং ভারত সরকার ভিসা প্রদান বন্ধ করেছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রনেতা হাদি নিহত হওয়ার পর আন্তরিক দুঃখ জ্ঞাপন করেছেন, কিন্তু যে হিন্দুরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের জন্য একটি শব্দও খরচ করেননি। ভারত এই সব হত্যাকাণ্ড বিষয়েই গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এবং হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানিয়েছে। ইউনূস সরকারকে দিল্লি মনে করিয়ে দিয়েছে তার আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা, বাংলাদেশে অবস্থিত সমস্ত ভারতীয় কূটনীতিক ও কনসুলার ব্যক্তিকে নিরাপত্তা প্রদানের কথা।
এই সব ঘটনার পর কিছু প্রতিবাদ দেখা গেল দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে। সেই ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখতে লাগল ঢাকা, বলা হল হিন্দু কট্টরপন্থীদের অশান্তি তৈরির প্রয়াস। বোঝা যায়, মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে ঢাকা, নিজেদের ভারতীয় হাই কমিশনকে নিরাপত্তাদানের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছে। ভারত সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়েছে, এ সব ঢাকার ‘মিসলিডিং প্রোপাগান্ডা’। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভারতীয়দের ভিসা প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও ভারত মানবিক কারণে সীমিত ভাবে ভিসা প্রদান আবার চালু করেছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জ, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতরা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার কর্মিবৃন্দ সকলেই নিহত ছাত্রনেতার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দরিদ্র হিন্দু কারখানার কর্মীটিকে যে হিংস্র ভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হল, সে বিষয়ে সকলেই নীরব। উন্নয়নশীল দেশের প্রতি বিষয়ে ক্ষণে ক্ষণে উপদেশ দানকারী এই সব ব্যক্তি/ গোষ্ঠীর এমন ক্ষেত্রভিত্তিক নীরবতা— বিশেষ লক্ষণীয়।
লক্ষণীয়, নির্বাচনের ঘোষণা শোনা গিয়েছে কিছু দিন আগেই— ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে ভোট। নির্বাচনের মাধ্যমে কি সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসবে? আসতেই পারে, যদি নির্বাচন হয় মুক্ত, আইনসম্মত, এবং সব দল যদি তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এখনও স্পষ্ট নয় নির্বাচনে তারা যোগ দিতে পারবে কি না। আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন— তাঁর দেশের ক্যাঙারু কোর্টের আদেশে তাঁর উপর ঝুলছে মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া। শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে ইউনূস সরকারকে ব্যঙ্গ করে অনৈতিক রাজনীতির কারবারি বলেছেন, এই সরকারের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ভোট নেওয়ার ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, তাঁর দল এই নির্বাচনে যোগ দিতে চায় না। এ কথা শুনে নিশ্চয়ই সে দেশের অন্য বৃহৎ দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি বা বিএনপি খুশি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জ়িয়া এখন ঢাকার একটি হাসপাতালে শয্যাগত, মরণাপন্ন। ইসলামিরাও খুশি এই সিদ্ধান্তে, কেননা গত নির্বাচনে তারা ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। সব মিলিয়ে সন্দেহ, নির্বাচন যতই এগিয়ে আসবে, হিংসার প্রকোপ বাড়তে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এনসিপি (ন্যাশনাল সিটিজ়েন পার্টি) এবং জামায়াতে, এরাই আন্দোলনের পরিচালক ছিল, কিন্তু নির্বাচনে এদের জেতার আশা কম। তাই হিংসা অব্যাহত থাকলে নির্বাচন পিছিয়ে গেলে কাদের সুবিধা, বুঝতে অসুবিধা নেই। তা ছাড়া, ভোটের সময় জুলাই বিপ্লবের ‘চার্টার’-এর উপর গণভোটও নেওয়ার কথা, পরবর্তী সরকারকে সেই চার্টার মানতেই হবে, এমনই স্থির হয়েছে। অবশ্যই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যাবে না নির্বাচিত পার্লামেন্ট ছাড়া। জামায়াতের এখন দাবি, নির্বাচন হবে প্রোপরশনাল রিপ্রেজ়েন্টেশন বা অনুপাতভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে— কেননা এখনকার ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নীতির থেকে ওই নীতিতেই নির্বাচন হলে তাদের আসন জেতার সম্ভাবনা বেশি বলে তারা মনে করে।
ভারতের কাছে বাংলাদেশ এখন বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এত দিন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই ছিল ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ও প্রতিবেশী। ফলে এখন কৌশলী নীরবতা অবলম্বন করেছে ভারত। দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়, হঠকারী পদক্ষেপ করার বিরোধী ভারত। দিল্লি বরং আশাবাদী যে ঢাকায় নির্বাচন হবে এবং তার ফলে রাজনৈতিক স্থিতি ফিরবে। তার পর নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সুস্থ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। বাংলাদেশ বিষয়ে পাকিস্তান, আমেরিকা ও চিনের আগ্রহও যথেষ্ট, ফলে ভারতকেও অনেক মেপে পা ফেলতে হয়। ইউনূস সরকারের কৌশলটা সম্ভবত এই যে— এই তিন দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নিজের জোর বাড়ানো। বিপজ্জনক কৌশল— দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বড় মাপের দীঘমেয়াদি ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এতে। বাংলাদেশের বোঝা দরকার, রাজনীতির রেটরিক আর ভূরাজনীতির বাস্তব ঠিক তুলনীয় বিষয় নয়, দুটোকে আলাদা ভাবে বিচার করা জরুরি।
প্রাক্তন সচিব, কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রক; বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন ডেপুটি হাই কমিশনার ও প্রাক্তন হাই কমিশনার