নিজেকে নিয়ে কাটাছেড়া করেন প্রযোজক স্নেহাশিস চক্রবর্তী? ছবি: ফেসবুক।
বড়পর্দা ছেড়ে ছোটপর্দায় এসেছেন। তাঁর ধারাবাহিক মানেই রেটিং তালিকায় প্রথম। প্রযোজনা সংস্থার অফিস সারা ক্ষণ গমগম করে লোকের ভিড়ে। এটাই স্বপ্ন ছিল? ২০ বছরের পেশাজীবন ফিরে দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস। ফোনের ও পার থেকে ভেসে এল শান্ত কণ্ঠস্বর, “ইদানীং যেন ক্লান্ত লাগে।” কেন? আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে আড্ডায় স্নেহাশিস চক্রবর্তী।
প্রশ্ন: পেশা জীবনের ২০ বছর, উদ্যাপন করছেন?
স্নেহাশিস: মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণসন্তান। বাড়িতে নারায়ণ শিলা আছে। তার নিত্যপুজো হয়। অফিসে খাওয়াদাওয়া হবে। সকলে হয়তো আসবেন। মুশকিল হল, কে এত আয়োজন করবে! আমি তো ভাইরাল জ্বরে বিছানায় শুয়ে।
প্রশ্ন: কাজের হিসাবনিকাশের সময় এসেছে?
স্নেহাশিস: আমি না। আমায় যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা হিসাব করছিলেন। ২২ হাজারেরও বেশি পর্ব উপহার দিয়েছি। ৪৫টি টেলিফিল্ম, ২৫টি সিনেমা, অজস্র জনপ্রিয় গান আর তার সুর করেছি। সঙ্গে প্রযোজনা সংস্থা ব্লু’জ়। গত এক বছর ধরে বলিউডেও আমার প্রথম হিন্দি ধারাবাহিক জনপ্রিয়।
প্রশ্ন: কতগুলো সফল?
স্নেহাশিস: ৯০ শতাংশ। এ ব্যাপারে সত্যিই ভাগ্যবান।
প্রশ্ন: স্কুল-কলেজে এ রকমই ফল করতেন?
স্নেহাশিস: (হেসে ফেলে) বিজ্ঞানের ছাত্র। তার পর ইন্টার করেছিলাম কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্সিতে। খানিকটা এগিয়ে একই দিনে আইন আর কস্টিং ছেড়ে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর করেছিলাম। সেটাও শেষ করিনি। তিনটি দিক ছেড়ে নাটকে মন দিই। তার পর এই পেশায়। ক্লাস টেন থেকে পড়ানো শুরু করি। আমার প্রচুর ছাত্রছাত্রী। মেধাবী, দুঃস্থদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতাম। এখনও সুযোগ পেলে পড়াই।
প্রশ্ন: বিজ্ঞানের ছাত্র বিনোদনের দুনিয়ায়! প্রেমে ব্যথা পেয়েছিলেন নাকি?
স্নেহাশিস: না, না! আমার প্রেমে কোনও ব্যথা পাওয়ার ব্যাপার নেই। ক্লাস ফাইভ থেকে মা হারমোনিয়াম ধরিয়েছিলেন। তখন থেকে শুরু, গান। ক্লাস টেনের পরে হাতে গিটার, একটু কি-বোর্ড, একটু পিয়ানো। এই করতে করতে নাটক। আমার মতো পাগল কিছু ছেলেপুলের সঙ্গে মিলে ওই যে পাগলামির শুরু— সেটা চলছেই।
প্রশ্ন: মঞ্চ থেকে পর্দায় কী ভাবে?
স্নেহাশিস: দু’জনের জন্য। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর প্রয়াত নির্দেশ অনিমেষ ভট্টাচার্য আমায় এনেছিলেন। বুম্বাদার হাত ধরে প্রচুর হিট ছবির কাহিনি লিখেছি আমি। ২০০৫-এ নিজের প্রযোজনা সংস্থা খুললাম। সেখান থেকে ছোটপর্দায়।
প্রশ্ন: খ্যাতি ছেড়ে ছোটপর্দায়... আবার অনিশ্চয়তার জগতে!
স্নেহাশিস: সত্যিই তখন প্রচুর ছবি করছিলাম। মিঠুন চক্রবর্তী, জিৎ, হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায়— তারকাদের সঙ্গে ওঠাবসা করছি।
প্রশ্ন: শত্রুরও বাড়বাড়ন্ত?
স্নেহাশিস: (হেসে ফেলে) বলতে পারেন। ওই জন্যই একটা সময়ের পরে মনে হল, ছোটপর্দায় কাজ করি। যেখানে স্বাচ্ছন্দ্য সেখানে স্নেহাশিস।
প্রশ্ন: যাঁরা নিজেকে প্রমাণ করতে চান তাঁরা তো সব সময় স্বাচ্ছন্দ্য সরিয়ে চ্যালেঞ্জ খোঁজেন!
স্নেহাশিস: কাজের ক্ষেত্রে নয়, মানসিক দিক থেকে স্বাচ্ছন্দ্য চাই আমার। প্রচণ্ড অনুভূতিপ্রবণ আমি। হয়তো তাই এটুকু চাই। খেয়াল করে দেখবেন, আমি কিন্তু বেশি চ্যালেঞ্জিং কাজ করেছি ছোটপর্দায় এসে। টেলিফিল্ম যেগুলো লিখেছি সেগুলো এখনকার বড় ছবির সমতুল। প্রভাত রায়, মহেন্দ্র সোনি-সহ বহু খ্যাতনামীর সঙ্গে এই ধরনের ছবি বানিয়েছি। বড়পর্দার ছবির থেকে কোনও অংশে এগুলো কম নয়। আমি টেলিভিশনে ছবি বানানোর চেষ্টা করে গিয়েছি বরাবর। ‘টিপিক্যাল ড্রইংরুম ড্রামা’ কিন্তু বানাই না। সাম্প্রতিক ‘আজকের পরশুরাম’-এও ছবির স্বাদ আনার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: প্রথম ধারাবাহিকের কথা মনে পড়ে?
স্নেহাশিস: ‘কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি’। কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মিমি দত্ত। তখন বড়পর্দায় কাজ করার জন্য নামডাক হয়েছে। ওটা কাজে সাহায্য করেছিল। প্রথম ধারাবাহিক ১১৭৬ পর্বের! সকলের খুব ভাল লেগেছিল। একজন খ্যাতনামী সে সময়ে বলেছিলেন, “এটা আমার কাছে টেক্সট বুক হয়ে রইল।” প্রথম কাজ সফল হওয়ায় আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আস্তে আস্তে কর্মীর সংখ্যা বাড়ল। সংস্থা বড় হল। ২০ বছরে অনেক কিছু ঘটল (হাসি)।
বাড়ির পুজোয় স্নেহাশিস চক্রবর্তী, অভিনেত্রী শ্রাবণী ভূইঞাঁ, রূপসা চক্রবর্তী। ছবি: ফেসবুক।
প্রশ্ন: আরও সাফল্য পেয়ে স্নেহাশিসও বদলে গেলেন?
স্নেহাশিস: এক ফোঁটাও না। এখনও গিটার বাজাই। গান করি। ছেলের পছন্দসই রান্না করে দিই। গিন্নি অসুস্থ হলে সেবা করি। ‘মায়ের ছেলে’ হয়ে গা ঘেঁষে পড়ে থাকি। পরিবারের প্রত্যেকটা লোকের প্রতি দায়িত্ব পালন করি। বলতে পারেন, দায়িত্ব আরও বেড়েছে। বাবা চলে যাওয়ার আগে পাঁচটি কথা বলেছিলেন, “কোনও ছেলে পড়তে পারছে না, কোনও মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কেউ চাল বা ওষুধ কিনতে পারছে না, কিংবা অর্থের অভাবে কারও মা-বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে না— এ রকম কাউকে দেখলে তার পাশে থেকো।” এখনও বাবার সেই নির্দেশ মেনে চলেছি। এখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকি। কোনও নেশা নেই। পার্টিতেও আমায় দেখতে পাবেন না। শুধু এখনও কাজ নিয়ে পাগলামিটা আছে।
প্রশ্ন: অনেক নায়ক-নায়িকা তৈরি করলেন। কত জন মনে রেখেছেন?
স্নেহাশিস: (মুহূর্তের নীরবতা) ২০ বছরে শিখেছি, শতকরা ৯৯ জন কাজের পরে আর ফোন ঘুরিয়ে খবর নেন না, কেমন আছি। এটা সকলের ক্ষেত্রেই সত্যি। আমার মধ্যে এখনও শিক্ষক সত্তা রয়ে গিয়েছে। কাজ না পারলে আজও বকাঝকা দিই তো। সেটাই হয়তো অনেকের ভাল লাগে না। তাই আকাশ ছোঁয়ার পর তাঁরা এই শাসনটা নিতে পারেন না। স্বাভাবিক, তাঁরা তখন ‘স্টার’ বা ‘সুপারস্টার’। খুব কম লোকই ফোন করে খোঁজ নেন। বরং যাঁরা এখনও লড়ছেন তাঁরা সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টির বাক্স হাতে দাঁড়ান। আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন, ‘দাদা, এটা আপনার জন্য।’ আমার মেলামেশাও তাই তৃণমূল স্তরে।
প্রশ্ন: তাই কি সফল প্রযোজকের স্ত্রী কোনও নায়িকা নন?
স্নেহাশিস: রূপসা তো গান গাইত। গানের সূত্রে আলাপ, প্রেম, বিয়ে। কোনও দিন অভিনয় করেইনি। আমার পাল্লায় পড়ে বরং অভিনয়ে এসেছে।
প্রশ্ন: প্রচণ্ড রূপসী। দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতোই...
স্নেহাশিস: খুব ভাল মনের মেয়ে। আমার মতো মধ্যবিত্ত মানসিকতার। আমায় যদি সফল বলেন তা হলে সেই সফল প্রযোজকের স্ত্রী হয়েও কোনও দেমাক নেই! আমাদের ছেলেও তেমনই। ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালবাসে। ছুটির দিনে নিজের হাতে রাঁধে-বাড়ে।
প্রশ্ন: তা বলে কোনও নায়িকার সঙ্গে প্রেমও কি থাকতে নেই?
স্নেহাশিস: হয়নি, বিশ্বাস করুন। এই রাস্তায় হাঁটি না।
স্নেহাশিস চক্রবর্তীর 'পরশুরাম আজকের নায়ক' ধারাবাহিকে তৃণা সাহা, ইন্দ্রজিৎ বসু। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনার ধারাবাহিকে নায়ক বা নায়িকার একাধিক সম্পর্কও নেই!
স্নেহাশিস: আমি পরকীয়া পছন্দ করি না। এ সব বিষয়ে খুব কড়া।
প্রশ্ন: আপনার না হয় হয় না, আপনার ধারাবাহিকের নায়ক-নায়িকার মধ্যে মনোমালিন্য হলে?
স্নেহাশিস: একবার হয়েছিল। খুব কড়া হাতে সামলেছি। তার পর থেকে সজাগ থাকি। এ সব হতে দিই না। যেমন, আমার সেটে কেউ গসিপ করে না! অবশ্যই মজা করে। কূটকচালি নেই।
প্রশ্ন: ২০ বছর ধরে প্রায় প্রত্যেকটা ধারাবাহিক রেটিং তালিকায় প্রথম, আপনি খুশি?
স্নেহাশিস: কই হল! এখন তো দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খায়। আমার এই পতাকা কে বহন করে নিয়ে যাবে? ছেলে সিরিয়ালের দুনিয়া একদম ভালবাসে না! ওর অন্য ধারার ছবির প্রতি আগ্রহ। ইদানীং খুব ক্লান্ত লাগে। চারপাশের পরিবেশও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কারও মধ্যে কাজ নিয়ে সেই পাগলামি নেই।
প্রশ্ন: টেলিপাড়ায় রাজনৈতিক দলাদলি, স্বাধীন ভাবে কেউ কাজ করতে পারেন না...
স্নেহাশিস: আমার সঙ্গে তেমন কিছু সত্যিই হয়নি।
স্নেহাশিস প্রযোজিত ধারাবাহিকে রুবেল দাস, শ্বেতা ভট্টাচার্য। ছবি: ফেসবুক।
প্রশ্ন: বড় পর্দায় ফিরতে ইচ্ছে করে না?
স্নেহাশিস: অবশ্যই করে। আমার শুরুটাই তো সিনেমা দিয়ে। কিন্তু তার আগে কয়েকটা জিনিস আমায় বুঝে নিতে হবে। আমি বাণিজ্য এবং ডিস্ট্রিবিউশন বুঝি না। ও ব্যাপারে এখনও কাঁচা। এগুলো বুঝে ছবি বানাতে নামব না।
প্রশ্ন: স্নেহাশিস চক্রবর্তীর কাছে ‘সাফল্য’ কী?
স্নেহাশিস: কাজ নিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত পাগলামি। শাহরুখ খানের একটা কথা মনে রাখি। উনি বলেছিলেন, ‘সাফল্যের জন্য সবাই পাগল। সফল হওয়ার পর সেই পাগলামো আর কেউ ধরে রাখতে পারে না।’ খাঁটি কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: অবসরে অন্য পরিচালক বা প্রযোজকদের ধারাবাহিক দেখেন?
স্নেহাশিস: কখনও কোনও দিন কারও ধারাবাহিক দেখি না।
প্রশ্ন: এখনও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল?
স্নেহাশিস: কই আর সব করে উঠতে পারলাম! এক জীবনে সব কি আর হয়? তাই ‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়....’।
স্নেহাশিস গুনগুনিয়ে উঠলেন মান্না দে-র বিখ্যাত সেই গান।