Sujoy Ghosh

‘কলকাতায় পা রাখলেই আর মনে হয় না ছেড়ে গিয়েছিলাম’! নিজের শহরের প্রতি টানের কথা সুজয়ের মুখে

এই শহরটা তাঁর কাছে বদলায় না। কারণ পরিচালক সুজয় ঘোষ বিশ্বাস করেন তাঁর চিন্তাভাবনা, কাজ এবং লেখালিখির মধ্যেই রয়েছে কলকাতা। শহরের ভাল লাগার বিভিন্ন ক্ষেত্র তুলে ধরলেন তিনি।

Advertisement
অভিনন্দন দত্ত
শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৬
Bengali director Sujoy Ghosh talks about his recent visit to Kolkata and the memories connected to the city

পরিচালক সুজয় ঘোষ বিশ্বাস করেন কলকাতা তাঁর সঙ্গেই থাকে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রায় পাঁচ মাসের লম্বা বিরতির পর সম্প্রতি শহরে এসেছিলেন। ঝটিকা সফর। ব্যক্তিগত কাজ ছাড়াও ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মুম্বই থেকে ফোনে কলকাতা সফরের গল্প এবং এই শহরকে ঘিরে স্মৃতি ভাগ করে নিলেন পরিচালক সুজয় ঘোষ।

Advertisement

চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে বলার জন্য তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য লিখে এনেছিলেন সুজয়। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘‘একটু বুক ধুকপুক ধুকপুক করছিল। তার পর হয়েও গেল। নতুন অভিজ্ঞতা।’’ কলকাতা থেকে ফেরার সময়ে সঙ্গে করে একরাশ স্মৃতি নিয়ে ফেরেন সুজয়। এ বারে তালিকায় সবচেয়ে পছন্দের স্মৃতি বড় পর্দায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র রেস্টোরড ভার্সন দেখা। প্রেক্ষাগৃহে প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় সুজয়কে। প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘‘আমি যে ওঁর স্বামীর কত বড় অনুরাগী, সেটাই বৌদিকে বলছিলাম।’’ উল্লেখ্য, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সুজয়ের অন্যতম প্রিয় উপন্যাস। সেই সূত্রেই অন্য আখ্যান শোনালেন তিনি।

Bengali director Sujoy Ghosh talks about his recent visit to Kolkata and the memories connected to the city

চলতি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে সুজয় ঘোষ। ছবি: ফেসবুক।

কিশোরকালে লুকিয়ে লাইব্রেরিতে সুনীলের একাধিক উপন্যাস পড়ে ফেলেছেন। তাই পরিচালক হওয়ার পর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র স্বত্ব নিতে লেখকের বাড়িতে হাজির হন সুজয়। তখন সবে মাত্র ‘কহানি’ মুক্তি পেয়েছে। সুজয় বললেন, ‘‘সুনীলদা চট করে একটা সাদা কাগজে লিখে আমাকে স্বত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। বললেন, ‘এই নাও স্বত্ব’। বৌদিও পাশে ছিলেন। সেই চিঠিটা কিন্তু আজও আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।’’

এখন কাজের চাপে কলকাতায় কম সময় কাটালেও এই শহর তাঁর পিছু ধাওয়া করে বলেই বিশ্বাস করেন সুজয়। বললেন, ‘‘কলকাতাকে আমি মিস্ করি না। কারণ, আমার মধ্যেই কলকাতা রয়েছে। আমার কাজ, চিন্তাভাবনার মধ্যেই কলকাতা লুকিয়ে রয়েছে।’’ তাঁর কাছে কলকাতায় ফেরা মানেই একরাশ নস্টালজিয়া। তাই বিমানবন্দরে পা রাখামাত্রই একটি স্মৃতি সুজয়ের মনে ফিরে ফিরে আসে।

সময়টা ১৯৭৪ সাল। কলকাতা বিমানবন্দরের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক কিশোর। কাচের ওপারে সিঁড়ি দিয়ে উঠে হাত নেড়ে বিমানে ঢুকে গেলেন এক মহিলা। মায়ের লন্ডনযাত্রার সেই স্মৃতি কলকাতায় এলেই মনে পড়ে সুজয়ের। তিনি বললেন, ‘‘মায়ের প্রথম বিলেতযাত্রা। আমি টাটা করছি। খুব গর্বিত এবং উত্তেজিত ছিলাম। সেই স্মৃতিটা এখনও আমার মনে টাটকা।’’

Bengali director Sujoy Ghosh talks about his recent visit to Kolkata and the memories connected to the city

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির প্রদর্শনে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের (ডান দিকে) সঙ্গে কথোপকথনে সুজয় ঘোষ। ছবি: সম্পিতা দাস।

কলকাতা ক্রমশ বদলাচ্ছে। সেখানে ভাল-মন্দ মিশে রয়েছে। তবে সুজয়ের যুক্তি, ‘‘কোনও শহর বদলায় না, বদলে যায় মানুষ। হাওড়া ব্রিজ দেখে তো কলকাতাকে চেনা যায় না। ব্রিজের উপর যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের সঙ্গে মিশলে শহরটাকে চেনা যায়।’’ শহরের খোলনলচে বদলেছে। পরিষেবা এবং পরিবহণ উন্নত হয়েছে। কিন্তু এই শহর যেন এখনও সুজয়ের কাছে ‘অপরিবর্তিত’ হয়েই রয়ে গিয়েছে।

সুজয় খাদ্যরসিক। কিন্তু নিজে রান্না করতে পারেন না। হেসে বললেন, ‘‘লন্ডনে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার চাপে জলদি খাওয়া শিখেছি, রান্নাটা শিখিনি।’’ কিন্তু কলকাতার জনপ্রিয় খাবারের ঠিকানাগুলির প্রতি তাঁর ভাল লাগা অফুরান। এখনও শহরে এলে ‘জিমিজ় কিচেন’ এবং ‘সিরাজ়’-এ ঢুঁ মারেন। ‘উডিপি’র দোসাও তাঁর পছন্দের। আবার সময় হলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকাও খেয়ে নেন।

Bengali director Sujoy Ghosh talks about his recent visit to Kolkata and the memories connected to the city

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির প্রদর্শনের আগে শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর এবং সুজয় ঘোষ (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

কর্মসূত্রেই এখন বেশির ভাগ কলকাতা সফর। সুজয় তারকা। কিন্তু এমন একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, যেখানে তাঁকে কেউ চেনেন না। শহর কলকাতায় এক দিন নিজের মতো করে কাটাতে চাইবেন সুজয়। ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘‘আমি অল্পেই সন্তুষ্ট। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব। দোকানে গিয়ে একটু বই ঘাঁটব। সময় থাকলে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের কালীবাড়িতে যাব। একটা দিন এ ভাবেই কেটে যাবে।’’

নিজের কাজের মাধ্যমে একাধিক বার কলকাতাকে পর্দায় তুলে ধরেছেন সুজয়। বাংলার একাধিক লেখকের কাজ নিয়ে ছবি তৈরির ইচ্ছাও রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই কাহিনিগুলির প্রাসঙ্গিকতা এবং বলিউডে সিনেমার সঙ্গে অর্থনীতি জড়িয়ে যাওয়ায় তিনি চিন্তিত। সুজয় বলছিলেন, ‘‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, বুদ্ধদেব গুহ বা প্রফুল্ল রায়ের সময়টা ছিল অন্য রকম। আমরা তাঁদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। কিন্তু সেটা আজকের বৃহত্তর দর্শক কী ভাবে নেবে, তা আমার জানা নেই।’’ এই ধরনের সাহিত্যকে ‘পার্সোনাল’ বলেই মনে করেন সুজয়। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে না জেনে ঝুঁকি নিতে নারাজ তিনি। সুজয়ের উপলব্ধি, ‘‘দর্শক আরও সচেতন হয়ে উঠছে। তাই তাদের প্রত্যাশাও তো বাড়ছে। ফলে কার কী পছন্দ হবে, তা আগে থেকে বলা কঠিন।’’

বলিউডে এখন শুধুমাত্র পরিচালকের পছন্দে ছবি তৈরি হয় না। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক বৃহৎ কর্পোরেট ব্যবস্থা। ‘প্রথম আলো’ বা ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর মতো উপন্যাসকে বড়পর্দায় তৈরি করতে গেলে যে বাজেটের প্রয়োজন, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সুজয়। তিনি বললেন, ‘‘‘ওয়াইকিকি’র গল্পটা কাউকে শোনালে তার সাধারণ মনে হতেই পারে। বলতেই পারেন, ‘এর জন্য টাকা দেব না’। তাই শেষে হয়তো নিজের টাকায় ছবিটা করতে হবে।’’

সুজয়ের কন্যা দিয়া অন্নপূর্ণা ঘোষ ‘বব বিশ্বাস’ ছবিটির শুটিং করেছিলেন কলকাতায়। মেয়ের পাশে বাবা ছিলেন ছায়াসঙ্গী। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে তাঁরা আবার বাংলায় ফিরতে রাজি। তবে কলকাতা সম্পর্কে মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিতে নারাজ সুজয়। বললেন, ‘‘ওর ক্যামেরা দিয়েই দর্শকের কলকাতা দেখা ভাল। আমি বলে দিলে সেটা তো আমার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যাবে।’’ এই মুহূর্তে সুজয় নতুন গল্পের সন্ধানে রয়েছেন। লেখালিখি নিয়েই ব্যস্ত। সেই চিত্রনাট্যে কি কলকাতা থাকছে? হেসে বললেন, ‘‘মুশকিল হল, কলকাতায় এক বার পা রাখলে মনে হয় না যে, কখনও ছেড়ে এসেছিলাম! তাই দেখা যাক কী হয়।’’

Advertisement
আরও পড়ুন