—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
একটা সময়ে ছেলেদের সাজগোজের সামগ্রী বলতে ছিল শেভিং কিট, কোলোন বা ডিয়োডোর্যান্ট। শীতকালে বড়জোড় কোল্ড ক্রিম। পরে ধীরে ধীরে ফেসওয়াশ, সানস্ক্রিন, হেয়ার জেল তাঁদের সাজসরঞ্জামে জায়গা করে নিল। কিন্তু গত বছর চারেকে এই ছবিটা আমূল বদলেছে। ছেলেদের মধ্যে সাজসচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সে কারণেই বাজারে পুরুষ প্রসাধনী দ্রব্যেরও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। সমীক্ষা বলছে, বছরে যদি পাঁচটি নতুন প্রসাধনী আসে, তার মধ্যে অন্তত একটি পুরুষদের।
সৌন্দর্য সচেতনতায় এগিয়ে জেন জ়ি-রা। রূপচর্চা এবং প্রসাধনী দুটোতেই তাঁরা আগের প্রজন্মকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। তবে মধ্য তিরিশ-চল্লিশের পুরুষদের মধ্যেও আগের চেয়ে সৌন্দর্যচর্চা বেড়েছে। শহরের এক নামজাদা সালঁয় কথা বলে জানা গেল, আগে পুরুষেরা চুল-দাড়ির যত্নের জন্যই মূলত আসতেন। এখন ফেশিয়াল, পেডিকিয়োর, ম্যানিকিয়োর, ওয়্যাক্সিং, হেয়ার স্পা... মেট্রোসেক্সুয়াল পুরুষরা সেলফ কেয়ারকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
শুধু রূপচর্চা নয়, মেকআপেও আগ্রহ বেড়েছে নব্য প্রজন্মের। সিসি ক্রিম, কনসিলার, লিপ বাম— থাকছে তাঁদের মেকআপ কিটে। ফ্যাশন ডিজ়াইনার অভিষেক রায় বলছিলেন, “বিয়ের সময়ে এখন ছেলেরাও আলাদা মেকআপ আর্টিস্ট বুক করছেন। শুধু বিশেষ দিন নয়, সারা বছরই এখন তাঁরা নিয়মিত রূপচর্চার মধ্যে থাকেন। তবে কমবয়সিরাই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে।”
নামজাদা মেকআপ ব্র্যান্ডগুলো পুরুষদের প্রসাধনীর সম্ভার নিয়ে এসেছে। বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা শুধু পুরুষদের সৌন্দর্যপণ্য তৈরি করে। পুরুষ প্রসাধনীর বাজারের বৃদ্ধি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। একটি ব্যবসায়ী পত্রিকার সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৩ নাগাদ পুরুষদের বিউটি-মেকআপ প্রডাক্টের বাজার ছিল ১৩০০ কোটি টাকার। এই অঙ্ক ২০৩০-এ আড়াই হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে মত। যদিও এই বৃদ্ধি মূলত শহর ও শহরতলিতেই।
যে পণ্যের চাহিদা বেশি— ফেসওয়াশ, সানস্ক্রিন, ময়শ্চারাইজ়ার, শিট মাস্ক, ফেস সেরাম, আন্ডারআই জেল, হেয়ার জেল, বিয়ার্ড অয়েল, ডিয়োডোর্যান্ট, সিসি ক্রিম, কনসিলার, লিপ বাম। —প্রতীকী চিত্র।
এই আগ্রহ বৃদ্ধির পিছনে কয়েকটি কারণ উঠে আসছে। সমাজমাধ্যম, ইনফ্লুয়েন্সারদের প্রভাব, ট্রেন্ড অনুসরণ করার চাহিদা— পুরুষদের মানসিকতাতেও প্রভাব ফেলছে। গত কয়েক বছরে কোরিয়ান বিউটি কনসেপ্টের দাপট লক্ষ করা গিয়েছে ভারতীয় বাজারে। কে-বিউটির মূল কথাই হল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজের যত্ন নেওয়া এবং ঝকঝকে উজ্জ্বল ত্বক পাওয়া। এর প্রভাব এ দেশীয় পুরুষদের মধ্যেও দেখা গিয়েছে। ভারতীয় পুরুষরা কে-বিউটির নিয়মিত খরিদ্দার এমন তথ্যও উঠে আসে সমীক্ষায়।
ডার্মাটোলজিক্যাল সেন্টারে গিয়ে ত্বকচর্চা করার ক্ষেত্রেও পুরুষদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ব্রণ, পিগমেন্টেশন তুলে ঝকঝকে ত্বক পেতে অনেকেই এ ধরনের ক্লিনিকে যাচ্ছেন। তবে এ রাজ্যে এখনও ছেলেদের মধ্যে চুলের যত্ন নেওয়ার প্রবণতাই বেশি। কনসালট্যান্ট ডার্মাটোলজিস্ট ইশাদ আগরওয়াল জানালেন, দাগছোপ দূর করার জন্য দামি স্কিন ট্রিটমেন্টেও পিছপা নন পুরুষেরা। তবে চুলের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের সংখ্যা চমকে দেওয়ার মতো।
মেকআপ শিল্পী অভিজিৎ চন্দ বলছিলেন, “মেট্রোসেক্সুয়াল পুরুষরা দেখতে ভাল লাগার প্রতি গুরুত্ব দেয়। পুরুষেরা এখন সালঁ-য় গিয়ে নিয়মিত ত্বকের যত্ন নিচ্ছেন। আসলে দেখতে ভাল লাগার উপরে মানুষের আত্মবিশ্বাসও নির্ভর করে।” বিয়ের মরসুমে কনের পাশাপাশি পাত্র সাজানোর কাজও আসে শিল্পীর কাছে। “অনেক সময়েই এমন হয়েছে কনেকে সাজাতে গিয়েছি, তখন পাত্র জানাচ্ছে সে-ও টাচআপ করতে চায়। আলাদা করেও বরকে সাজানোর প্রস্তাব আসে,” বললেন অভিজিৎ।
সমাজমাধ্যমে পুরুষ সৌন্দর্য-বিশেষজ্ঞদের ফলোয়ার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অঙ্কুশ বহুগুণার মতো ইনফ্লুয়েন্সারের ফলোয়ারের সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি। শাহরুখ খান, হৃতিক রোশন থেকে কার্তিক আরিয়ান— কোনও না কোনও প্রসাধনী ব্র্যান্ড এনডর্স করেন। এগুলোও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করার, অনেক পুরুষই তাঁর সৌন্দর্যপণ্য ব্যবহারের কথা প্রকাশ্যে বলতে রাজি নন। যে কারণে দোকান থেকে সরাসরি কেনার বদলে অনলাইনে পণ্য ক্রয় করার সংখ্যা বেশি। “এ ক্ষেত্রে এখনও কিছু ছুঁতমার্গ আছে এবং সেটা হয়তো মধ্যবয়সিদের মধ্যে বেশি। জেন জ়ি অনেক অকপট যে কোনও ব্যাপারেই,” মন্তব্য মেকআপ শিল্পী অভিজিতের।
সাজগোজ করা মানেই মেয়েলি ব্যাপার— এই ধারণাকে ধীরে ধীরে নস্যাৎ করেছেন আধুনিক পুরুষেরা। তাঁরাও সারা দিনের স্কিন কেয়ার রুটিন বানিয়ে নিচ্ছেন। তার মধ্যে ক্লেনজ়িং, ময়শ্চরাইজ়ার, সানস্ক্রিন, শিট মাস্ক ব্যবহার যেমন আছে, তেমনই নাইট ক্রিম, সেরাম, আন্ডারআই জেল এবং ফুট ক্রিমের ব্যবহারও রয়েছে। গুগলে ‘মেন’স স্কিনকেয়ার রুটিন’ লিখে সার্চ দেওয়ার হার সাম্প্রতিক সময়ে চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। প্রসাধনী সংস্থাগুলো এ প্রবণতাকে কাজে লাগাচ্ছে। এখনও এ দেশে পুরুষদের হাতে ক্রয়ক্ষমতা বেশি। তাই আগামী দিনে ছেলেদের সৌন্দর্যপণ্যের বাজার যে আরও বাড়বে তা আন্দাজ করা যায়।