দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। নাম ‘বিটুইন সিয়িং অ্যান্ড আনসিয়িং’। কিউরেটর ছিলেন সিদ্ধার্থ বসু। গত চার দশক ধরে কলকাতার শিল্পরসিকরা সুশান্ত চক্রবর্তীর ছবি দেখেছেন। তাঁর শৈল্পিক যাত্রা শুরু হয়েছিল গ্ৰাফিক শিল্পী পরিচয়ে, হরেন দাসের ছাত্র হিসেবে। তখন প্রধানত এন্টালিও এবং উডকাট মাস্টার করতে চেয়েছিলেন সুশান্ত। তাঁর আগেকার প্রদর্শনীতে ছাপচিত্রের এই দুই মাধ্যমে, বিশেষত উডকাটে যথেষ্ট দক্ষতা লক্ষণীয়। এর পর যথাক্রমে সুশান্ত চিত্রাঙ্কনের অন্যান্য শাখার সঙ্গে পরিচিত হন এবং ক্রমশ তেলরং, অ্যাক্রিলিক ছাড়াও বিশেষ ভাবেই অয়েল প্যাস্টেলে মনোযোগী হয়ে পড়েন। অনেক পথ চলার পরে তিনি সাম্প্রতিক কালে অয়েল প্যাস্টেলে কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন।
দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
এখানে সুশান্ত মহাকাব্যের পৌরাণিক নায়কদের সঙ্গে আজকের সমাজ-সংসারের চালকদের অবস্থা এবং যে পরিস্থিতি, সেই রকম সব ঘটনার ইঙ্গিত করছেন। এ ছাড়াও তিনি ‘অ্যামোরাস’ বা ‘প্রেমঘনতা’ বলে আর একটি সিরিজ় নিয়ে তুলনামূলক ভাবে বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে মহাকাব্যের পাত্রপাত্রীর সঙ্গে সঙ্গে আজকের দুনিয়ার শিথিল মূল্যবোধ নিয়ে হয়তো বা কটাক্ষ করেছেন।
শিল্পীর কাজে চড়া রঙের ব্যবহার বিশেষ লক্ষ করা যায় না। কাজগুলো যেন শব্দরোধ করা মিউটেড রং থেকে উঠে হঠাৎ এক চড়া কোবাল্ট ব্লু বা ক্রিমসন রেডে দর্শককে তাক লাগিয়ে দেয়। একটার পর একটা লেয়ারে কাজ এগোতে থাকে অয়েল প্যাস্টেলে। জটিল বিষয় নিয়ে চিত্রাঙ্কন করায় তাঁর কাজের আঙ্গিক সর্বত্র দুরূহ হলেও সংযত। কোনও ভাবেই আবেগ-বিহ্বলতা দর্শককে আচ্ছন্ন করে না। বরং এই চিন্তাশীল মানুষটির শিল্পকর্ম ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে।
দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
প্রথমেই চোখে পড়ে সুশান্ত চক্রবর্তীর রথের চাকা। মহাভারতের রথের চাকা কুন্তীপুত্র কর্ণকে মনে করায়। তার পরেই আমরা দেখি, রথের চাকা যেন বিষ্ণু বা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র হয়ে উঠেছে। এখানে শিল্পী যেন আবর্তনশীল চক্রকে কালচক্র হিসেবে দেখাচ্ছেন। এক দিকে হয়তো তিনি বলছেন কালের চক্র যুগে যুগে একই ভাবে ঘোরে। মহাভারতে যা দেখেছি, আজকের সমাজেও সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। কিন্তু অপর দিকে চাকা যখন ভাঙা দেখাচ্ছেন, তখন কি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন শিল্পী?
‘অদর্শন’ বলতে শিল্পী হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। তাই প্রদর্শনীর নামে ‘অদর্শন’ শব্দটি রয়েছে। কিন্তু মহাভারতের যে ব্যাখ্যা তিনি করেছেন, সেখানে প্রদর্শনীর প্রধান চরিত্র ভীষ্ম। তিনি অনায়াসে রাজা হতে পারতেন, কিন্তু যে আত্মাহুতি তিনি দিয়েছিলেন এবং ভীষ্মের শরশয্যা সম্ভব হয়েছিল, সেটা তাঁর নৈতিক চরিত্রের সঙ্গে বিরোধী মতের সমঝোতার কারণেই।
দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
সুশান্তর ছবিতে এ সব কথা তেমন স্পষ্ট নয়। যদিও তাঁর কাজে সর্বত্রই আজকের জীবনের নীতিহীনতা, বিচ্যুতি, অসাধুতার ইঙ্গিত। এই সব বলা হয়েছে নানা ফর্ম এবং টেক্সচারের মাধ্যমে। অনেক ছবিতেই সারফেসকে সমান্তরাল ভাবে কেটে দেখানো হয়েছে ছবিকে সম্পূর্ণ ভাবে রূপকধর্মী না করার জন্য। তাঁর ছবির আঙ্গিক জটিল, সেখানে শুধু আখ্যান বা কাহিনি খুঁজলে চলবে না। এটাই বলা যায় যে, মহাভারতের কাহিনিকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি আজকের দিনের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলতে। আবার সেখানেও অর্থালঙ্কার ছাড়িয়ে দেখতে হবে। হঠাৎ চমকে যেতে হয় একই লাইনে একটি বিমূর্ত আকার থেকে অপর একটি আকারে চলে যাওয়া, কিন্তু এই দু’জন মানুষই জন্মান্তরের কালচক্রের বহু দূরে অবস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে ওদের কোনও যোগাযোগ নেই। সেখানেই দর্শককে ভাবতে বাধ্য করেন শিল্পী।
সুশান্ত চক্রবর্তী নিজের ছবিতে অয়েল প্যাস্টেলের ব্যবহারে যথেষ্ট স্বকীয়তার পরিচয় রেখেছেন। কিছুটা যেন ইমপ্যাস্টো আর শুকনো ব্রাশ ব্যবহার করে পাতলা অস্বচ্ছ বা অর্ধঅস্পষ্ট রঙের স্তর ঢেকে দিয়ে রংটা কম উজ্জ্বল করেছেন। তার পরের স্ট্রোকে সাদা দিয়ে হাইলাইটের কারুকার্য। এতেই বিমূর্ততা পেয়েছেন শিল্পী।
দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
ভীষ্মের শরশয্যার উপরে হতাশার মুখ স্বয়ং কৃষ্ণের। কৃষ্ণকে এই নাটকের নায়ক তিনি করেননি। অপর একটি ছবিতে নায়ক শরশয্যার পাশাপাশি ভার্টিকালি একাংশে বসে আছেন ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী। গান্ধারীকেই তিনি যেন কিছুটা দায়ী করতে চেয়েছেন মহাভারতের যুদ্ধের কারণ হিসেবে। তবে কি শিল্পী নারীজাতিকে দায়িত্ব তুলে নিতে বলছেন সমাজসংসারে শান্তির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে?
আর একটি ছবিতে কুরুপাণ্ডবের পাশা খেলা দেখিয়েছেন। সেখানেও পাত্রপাত্রীদের চোখে হিংস্রতার ছোঁয়া। সুশান্তর ছবিতে একেবারেই সরল ভাবে গল্প বলা হয়নি। তিনি মহাভারতের বিশেষ কোনও চরিত্রের সঙ্গে অন্য জগতের চরিত্রের মিলন ঘটিয়ে এক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছেন, যেটা কিছুটা অজন্তার দেওয়ালচিত্রকে বা কিছুটা মিনিয়েচার ছবি মনে করায়।
দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
তাঁর একটি স্টিল লাইফ দেখা গেল প্রদর্শনীতে। কিন্তু দেখতে দেখতে মুহূর্তে দর্শক দেখলেন, সেই স্টিল লাইফ উধাও হয়ে কিছু অন্ধকারের ছায়ামূর্তি নজর কেড়ে নিল। এ ছাড়া বেশ কিছু ছবিতে ছাতা দেখা গেল। বেশির ভাগ ছাতা ভাঙা অথবা অর্ধনিমীলিত। এখানেও রূপকের সাহায্যে যেন দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষের চরম অসহায়তা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ঔদাসীন্য।
দেখা-অদেখা: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। — নিজস্ব চিত্র।
শিল্পীর ছবিতে সুপ্ত সামাজিক এবং রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, ছবিতে রঙের অভিনবত্ব এবং গঠনের নতুনত্বের জন্যে রসগ্ৰহণ করা সম্ভব। তেলরং এবং বিশেষ করে অয়েল প্যাস্টেলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে সুশান্ত মুগ্ধ করেছেন দর্শককে।