পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই দুর্ঘটনার পরিণতি হয়েছে মর্মান্তিক। মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। সেই সব শিউরে ওঠা ঘটনার কথা শুনলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
তবে এই লেখা এমন এক জনকে নিয়ে, যিনি বিমান দুর্ঘটনার কারণে কোনও প্যারাসুট ছাড়াই ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে নীচে পড়ে যান। মৃত্যু অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও অলৌকিক ভাবে প্রাণ বাঁচে তাঁর।
কথা হচ্ছে বিমানসেবিকা ভেসনা ভুলোভিচকে নিয়ে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও অনেক উঁচু থেকে পড়েও প্রাণ বেঁচেছিল তাঁর। তাঁর অসাধারণ যাত্রা অদম্য মানসিক জোরের অন্যতম উদাহরণ।
১৯৫০ সালের ৩ জানুয়ারি সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জন্ম ভেসনার। ভেসনা ছিলেন সুন্দরী। পড়াশোনা শেষ হতেই এক বন্ধুকে দেখে বিমানসেবিকা হওয়ার ইচ্ছা জাগে তাঁর মনে। চাকরিও জুটে যায়।
১৯৭২ সালে জেএটি ফ্লাইট ৩৬৭ বিমানে ক্রু হিসাবে কর্মরতা ছিলেন ভেসনা। সে বছরের ২৬ জানুয়ারি চেকোস্লোভাকিয়ার (বর্তমানে চেক রিপাবলিকের অংশ) শ্রবস্কা কামেনিসের কাছে ‘লাগেজ বগি’তে বিস্ফোরণের কারণে জেএটি ফ্লাইট ৩৬৭ বিমান ভেঙে পড়ে।
মনে করা হয়, জেএটি ফ্লাইট ৩৬৭ বিমানটি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় ‘লাগেজ বগি’তে থাকা একটি স্যুটকেসে রাখা বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ-ও মনে করা হয়, অভিবাসী ক্রোয়েশিয়ান জাতীয়তাবাদীরা সেখানে বোমাটি রেখেছিলেন।
সেই বিমানেই ছিলেন ভেসনা। বিমানসেবিকা হিসাবে কাজ করছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের কারণে বিমান ভেঙে ২৭ জন যাত্রী এবং ক্রু মারা যান। কিন্তু ভেসনার ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল।
ভেসনাই ছিলেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির একমাত্র জীবিত যাত্রী। সংবাদসংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিমানটি মাটি থেকে ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতায় বিস্ফোরিত হয়। সেই উচ্চতা থেকেই মাটির দিকে পড়তে থাকেন ভেসনা।
ভেসনার কাছে কোনও প্যারাসুট ছিল না। পৃথিবীর বিমানের ইতিহাসে প্যারাসুট ছাড়া অত উঁচু থেকে কেউ কখনও পড়েননি। ৩৩ হাজার ফুট উঁচু থেকে পড়ার পর মৃত্যু কার্যত নিশ্চিত ছিল। কিন্তু ভেসনা বেঁচে যান অলৌকিক ভাবে।
বিস্ফোরণের সময় বিমানটির লেজের দিকে ছিলেন ভেসনা। খাবার পরিবেশন করছিলেন এক যাত্রীকে। বিস্ফোরণের ঝাঁকুনিতে বিমানে খাবার পৌঁছে দেওয়ার চাকা লাগানো ঠেলাতেই আটকে যান ভেসনা। আর ও ভাবেই দ্রুত গতিতে মাটির দিকে পড়তে থাকেন।
দ্বিখণ্ডিত জেএটি ফ্লাইট ৩৬৭-র লেজের অংশ পড়েছিল তুষারাবৃত এক বনভূমিতে, যা বিমানের ধ্বংসাবশেষের জন্য গদির মতো কাজ করেছিল। ফলে মাটিতে আছড়ে পড়ার পর নতুন করে বিস্ফোরিত হয়নি ওই অংশ।
মাটিতে আছড়ে পড়ার পরেও বিমানের ওই অংশেই আটকে ছিলেন ভেসনা। শরীরে গুরুতর চোট পেলেও বেঁচে ছিলেন তিনি। তবে মৃত্যুভয় গ্রাস করেছিল তাঁকে।
প্রাণ বাঁচাতে তারস্বরে চিৎকার শুরু করেন ভেসনা। ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন ব্রুনো হোন নামে এক কাঠুরে। বিমান আছড়ে পড়ার আওয়াজ শুনে ছুটে যান তিনি। ভেসনার গলাও শুনতে পান। সঙ্গে সঙ্গে ভেসনাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান ব্রুনো। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছোনোর পরেই কোমায় চলে যান ভেসনা।
১০ দিন কোমাচ্ছন্ন ছিলেন ভেসনা। শরীরেও যথেষ্ট আঘাত ছিল। তাঁর খুলি ফেটে গিয়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল দু’টি কশেরুকা, দু’টি পা, কোমরের হাড় এবং পাঁজরের বেশ কয়েকটি হাড়ও।
জ্ঞান ফেরার পর সাময়িক ভাবে কোমর থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন ভেসনা। কিন্তু চরম সঙ্কটেও হতাশ হননি তিনি। লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। আরও কয়েক মাস পরে চিকিৎসকদের চেষ্টায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন ভেসনা।
২০০৮ সালে সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভেসনা বলেন, ‘‘আমার সারা শরীর ভেঙে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা আমাকে আবার জোড়া লাগান।’’ সুস্থ হয়ে কাজেও ফিরেছিলেন ভেসনা। তবে আর বিমানসেবিকা হিসাবে নয়। বিমান সংস্থার অন্দরে করণিকের পদে যোগ দেন তিনি। ধীরে ধীরে দুর্ঘটনার স্মৃতি তাঁর কাছে ঝাপসা হয়ে যায়।
অলৌকিক ভাবে প্রাণ বাঁচায় ১৯৮৫ সালে গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে জায়গা করে নেন ভেসনা। পাশাপাশি, অবিশ্বাস্য ভাবে বেঁচে ফেরার কারণে রাতারাতি সার্বিয়ার এক জন তারকাও হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
শেষ জীবনে সমাজকর্মী হিসাবে কাজ করা শুরু করেন ভেসনা। সক্রিয় রাজনীতিতেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।
সব ছবি: সংগৃহীত।