মাদাগাস্কার থেকে প্রায় ৪৫০ কিমি দূরের এক নির্জন দ্বীপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত মিটার উঁচু, আয়তন মাত্র এক বর্গকিলোমিটার। মানুষের বসবাসের উপযোগী কোনও উপকরণই প্রায় ছিল না সেখানে। একমাত্র সামুদ্রিক প্রাণীরাই জীবন ধারণ করতে পারত। সেই দ্বীপের কাছেই ডুবে যায় একটি জাহাজ। এর ফলে দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় আটকে ছিলেন একদল মানুষ। প্রাণ গিয়েছিল শতাধিক মানুষের।
২৬৫ বছর আগে আপাত অবিশ্বাস্য এই ঘটনা ঘটেছিল ট্রোমেলিন দ্বীপে। ১৫ বছর ধরে চলেছিল বেঁচে থাকার ভয়ঙ্কর লড়াই। শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচেছিলেন মাত্র সাত জন। তাঁর মধ্যে এক শিশুর বয়স ছিল মাত্র আট মাস!
কথা হচ্ছে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের পরের সময়ের। সে সময় ফ্রান্স এবং ব্রিটেন একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। উত্তর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ আর উপনিবেশ রক্ষার জন্য উভয় দেশ প্রাণপণ লড়ছে। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধ ‘সেভেন ইয়ার্স ওয়ার’ নামে পরিচিত।
সেই সময় ক্রীতদাস প্রথা আইনত স্বীকৃত থাকলেও, যুদ্ধের কারণে তা সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। মরিশাসে কেউ ক্রীতদাস আমদানি করতে গিয়ে ধরা পড়লে মোটা জরিমানা এবং কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হত।
যুদ্ধ চলাকালীন মাদাগাস্কার থেকে আইল ডে ফ্রান্সে (আজকের মরিশাস) খাবার, অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী জাহাজে করে পাঠানো হত। সেইমতো ১৭৬১ সালের ৩১ জুলাই ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজ মরিশাসের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। জাহাজটির নাম দেওয়া হয়েছিল এল’ইউটিল।
এল’ইউটিল-এ মোট ১৪২ জন নাবিক ছিলেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন জিন দে লা ফার্গু। তথ্য বলছে, ফার্গু একজন লোভী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর লোলুপ স্বভাবের কারণে প্রাণ গিয়েছিল শতাধিক মানুষের। ভয়াবহ জাহাজডুবির ঘটনাও ঘটেছিল তাঁর ভুল সিদ্ধান্তের জেরেই।
ক্রীতদাস আমদানি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মোটা টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে ফার্গু ১৬০ জন দাস কিনেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল মরিশাসে গিয়ে বেআইনি ভাবে দাস বিক্রি করে মোটা টাকা উপার্জন করার। যদিও নিজের ভুল সিদ্ধান্তের জেরে সে আশা আর পূরণ হয়নি ফার্গুর।
১৬০ জন দাসকে জাহাজের কার্গো বিভাগে (যেখানে খাবার এবং অন্যান্য সামগ্রী রাখা হয়) বন্দি করে রওনা দেয় জাহাজটি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে জাহাজে তখন তিনশোর বেশি মানুষ ছিলেন। ফার্গু নিজেও জানতেন তিনি বেআইনি কাজ করছেন। তাই নাবিকদের সাধারণ গতিবেগের চেয়ে অনেক বেশি গতিতে জাহাজ চালানোর নির্দেশ দেন।
সে নির্দেশ পালন করতে গিয়ে রাতের অন্ধকারে দিক হারিয়ে ফেলে জাহাজটি। কিন্তু তার পরেও নির্দেশ ছিল জাহাজের গতি না কমানোর। শেষ পর্যন্ত সামলাতে না পেরে মাদাগাস্কার থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে এবং মরিশাস থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বে একটি বালির দ্বীপে ধাক্কা মারে জাহাজটি।
সংঘর্ষের সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজটির সামনের অংশ ভেঙে যায়। জাহাজের ভিতর জল ঢুকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে জাহাজডুবির পরিস্থিতি তৈরি হয়। ওই সময়ই ২০ জনের মৃত্যু হয়।
জাহাজের কার্গোও ভেঙে যায়। ফলে, আটকে থাকা ক্রীতদাসদের মধ্যে বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়। ১৬০ জনের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ জন কোনও রকমে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলেন। সকলেই ওই বালির দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন এবং প্রথম অফিসার জীবিত থাকলেও ফার্গু মানসিক ভাবে বিধস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এক দিকে ভরাডুবি, অন্য দিকে বেআইনি দাস কেনা— সব মিলিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না তিনি। তবে নাবিকদের আশা ছিল, এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন তাঁরা।
অগত্যা, প্রথম অফিসার বার্থেলেমি ক্যাসেলান ডু ভার্নেট নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। প্রথমেই নাবিক এবং দাসদের নিয়ে জাহাজডুবির জায়গায় যান। ভেঙে যাওয়া জাহাজ থেকে যতটা সম্ভব খাবার এবং পান করার জল সংগ্রহ করেন তাঁরা।
যেটুকু খাবার পাওয়া গিয়েছিল তার সবটা নাবিকেরাই খেয়ে ফেলেন। ক্রীতদাসদের জন্য কিছুই রাখা হয়নি। ভাঙা জাহাজ থেকে অবশিষ্ট যে কাঠ পাওয়া গিয়েছিল, তা দিয়ে নাবিকেরা নিজেদের তাঁবু তৈরি করেন। অভুক্ত থাকায় এবং জল না পাওয়ায় আরও কয়েক জন ক্রীতদাসের মৃত্যু হয়।
সময় যত পেরোতে থাকে জল, খাবার ফুরিয়ে যেতে থাকে। নাবিক এবং দাসেরা মিলে প্রায় এক সপ্তাহ পর বালি খুঁড়ে কুয়ো বানান। সামুদ্রিক প্রাণীদের মেরে খাবারের বন্দোবস্ত করেন তাঁরা। প্রাকৃতিক উনুনও তৈরি করা হয়।
এই ভাবে প্রায় দু’মাস কেটে গেল। অবশেষে দ্বিতীয় একটি জাহাজ বানাতে সক্ষম হন নাবিক এবং ক্রীতদাসেরা। কিন্তু ওই জাহাজটি বেশি যাত্রী বহন করতে সক্ষম ছিল না। তাই শুধুমাত্র ফার্গু, বার্থেলেমি এবং নাবিকেরা মাদাগাস্কারের দিকে রওনা দেন। ক্রীতদাসদের আশা দেওয়া হয় খুব শীঘ্রই একটি জাহাজ পাঠিয়ে তাঁদের উদ্ধার করা হবে।
এই আশাতেই প্রায় ১০ বছরের বেশি সেই দ্বীপে কাটিয়ে দিয়েছিলেন ক্রীতদাসেরা। একটা সময়ের পর তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন আর কোনও জাহাজ আসবে না তাঁদের উদ্ধার করতে। তাই কোনও রকমে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু করে দিয়েছিলেন সেই দ্বীপে।
এ দিকে চার দিন পর ফার্গুদের জাহাজ মাদাগাস্কার পৌঁছোয়। তবে ফার্গু জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারেননি। ফেরার পথে জাহাজে বেশ কিছু নাবিকের বিশেষ অসুখ করে। এর ফলে কয়েক জন নাবিক এবং ফার্গুর মৃত্যু হয়। মাদাগাস্কার থেকে বার্থেলেমি পুনরায় একটি জাহাজ নিয়ে মরিশাসের উদ্দেশে রওনা দেন।
সেই সময় মরিশাসে অ্যান্টোইন মেরির রাজত্ব চলছিল। জানা যায়, অ্যান্টোইন খুবই কঠোর মনোভাবের মানুষ ছিলেন। বার্থেলেমি তাঁর কাছে জাহাজ পাঠিয়ে ক্রীতদাসদের উদ্ধারের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বহু আবেদনের পরেও অ্যান্টোইনের তরফে কোনও সাড়া মেলেনি।
বার্থেলেমি পুনরায় মাদাগাস্কারে ফিরে আসেন। সেখানে গিয়ে আবার জাহাজে করে খাবার আদান-প্রদানের কাজ শুরু করে দেন। তিনি চেয়েছিলেন ফেলে আসা ক্রীতদাসদের উদ্ধার করতে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাঁর।
এই ভাবে প্রায় ১৫ বছর কেটে গিয়েছিল। এর মধ্যে অ্যান্টোইনের মৃত্যু হয়। অ্যান্টোইনের পর যিনি মরিশাসের ক্ষমতায় আসেন তিনি বেশ নরম মনের ছিলেন বলে জানা যায়। বার্থেলেমি তাঁকে চিঠি লেখায় সদুত্তর মেলে। শেষ পর্যন্ত একটি জাহাজ পাঠানো হয় ওই বালির দ্বীপে।
যদিও দ্বীপে যাওয়ার পর নাবিকেরা দেখেন মাত্র সাত জন মহিলা বেঁচে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জনের আট মাসের সন্তান ছিল। পরে জানা যায়, প্রথম পাঁচ বছরেই বেশির ভাগ ক্রীতদাসের মৃত্যু হয়েছিল। কিছু ক্রীতদাস কাঠের একটি ছোট নৌকো নিয়ে মরিশাসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। যদিও তাঁরা আর মরিশাস পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেননি।
উদ্ধার হওয়া ক্রীতদাসদের মরিশাসে ফিরিয়ে এনে স্বাধীন করে দেওয়া হয়। জীর্ণ, মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার হন ওই মহিলারা। ফার্গুর ভুলের মাসুল দিতে হয়েছিল একশোর বেশি মানুষকে। ১৭৭৬ সালে মরিশাস সরকারের তরফে ওই দ্বীপের নাম দেওয়া হয় ‘ট্রোমেলিন’ দ্বীপ।
সব ছবি: সংগৃহীত।