এ বার কি অস্ত্রব্যবসায় রাশিয়াকে ছাপিয়ে যাবে চিন? ‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজে বেজিঙের শক্তি প্রদর্শনের পর উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের রাজপথে যে ভাবে অত্যাধুনিক হাতিয়ার হাতে ড্রাগন ফৌজকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গিয়েছে তাতে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, অস্ত্রের বাজারে মান্দারিনভাষীরা ‘বড় খেলোয়াড়’ হয়ে উঠলে মস্কোর পাশাপাশি আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার যে কপাল পুড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
সুইডিশ সমীক্ষক সংস্থা সিপ্রি-র (স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-’১৯ সালের মধ্যে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম হাতিয়ার রফতানিকারী দেশ ছিল চিন। ওই সময়সীমার মধ্যে আন্তর্জাতিক অস্ত্রবাজারের মাত্র ৫.৫ শতাংশ ছিল বেজিঙের দখলে। ড্রাগনের সামনে থাকা চারটি দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং জার্মানি। বিশ্বের হাতিয়ারের ব্যবসার যথাক্রমে ৩৬ শতাংশ, ২১ শতাংশ, ৭.৯ শতাংশ এবং ৫.৮ শতাংশ ছিল তাদের দখলে।
সিপ্রির দাবি, ২০২০ সাল থেকে এই ছবি বদলাতে শুরু করে। পরবর্তী চার বছরের মধ্যে এক ধাপ উঠে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে চিন। জার্মানিকে ছাপিয়ে হাতিয়ারের বাজারের ৫.৯ শতাংশ দখল করতে সক্ষম হয় বেজিং। তবে এখনও ৪৩ শতাংশ অংশীদারি নিয়ে তালিকায় এক নম্বর স্থান ধরে রেখেছে আমেরিকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে ফ্রান্স। রাশিয়া নেমে গিয়েছে তিন নম্বরে। দুনিয়ার অস্ত্রবাজারের যথাক্রমে ৯.৬ শতাংশ এবং ৭.৮ শতাংশ দখলে রেখেছে এই দুই দেশ।
চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বেজিঙের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজের আয়োজন করে চিন। ২৬ জন রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে সেখানে একের পর এক অত্যাধুনিক হাতিয়ার প্রকাশ্যে এনে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেয় ড্রাগন ফৌজ। এর মধ্যে ছিল আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা (এয়ার ডিফেন্স) ব্যবস্থা, আত্মঘাতী ড্রোন এবং রোবট কুকুর। সমরাস্ত্রের ওই বিজ্ঞাপনের পর বেজিঙের হাতিয়ারের দোকানে খদ্দেরের ভিড় বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজে যে সমস্ত চৈনিক অস্ত্র সকলের চোখ টেনেছে, সেই তালিকায় প্রথমেই থাকছে ‘জে-২০এস’। একে বিশ্বের প্রথম দুই আসন বিশিষ্ট পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু জেট বলে দাবি করেছে বেজিং। এ ছাড়া ‘এলওয়াই-১’ নামের একটি রণতরীবাহী লেজ়ার হাতিয়ার দেখিয়েছে ড্রাগন ফৌজ। সংশ্লিষ্ট সমরাস্ত্রটি নাকি নৌযুদ্ধের সংজ্ঞাই বদলে দেবে, লিখেছে মান্দারিনভাষীদের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইম্স’।
কুচকাওয়াজ়ের সময় তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের রাস্তা দাপিয়ে বেড়িয়েছে ছ’টি ভিন্ন ধরনের চিনা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর মধ্যে কয়েকটির আবার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার সক্ষমতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্সগুলির নাম এইচকিউ-৯সি, এইচকিউ-১১, এইচকিউ-১৯, এইচকিউ-২০, এইচকিউ-২২এ এবং এইচকিউ-২৯। ‘গ্লোবাল টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এইচকিউ-১৯ বেজিঙের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র, যা দিয়ে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করতে পারবে ড্রাগন।
এ ছাড়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ছিল লড়াকু জেটের জেএল-১, ডুবোজাহাজের জেএল-৩ এবং স্থলবাহিনীর ডিএফ-৬১ ও ডিএফ-৩১বিজে। শেষের তিনটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বলে জানা গিয়েছে। কৌশলগত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে কুচকাওয়াজে অংশ নেয় ডিএফ-৫সি। ১২-১৫ হাজার কিলোমিটার পাল্লার এই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনও শহরকে চোখের নিমেষে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া যাবে বলে দাবি ড্রাগনের।
পাশাপাশি, রণতরী ধ্বংসকারী ওয়াইজে সিরিজ়ের চারটে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র এবং বেশ কিছু ড্রোন সংশ্লিষ্ট কুচকাওয়াজে প্রকাশ্যে এনে শক্তি দেখিয়েছে বেজিং। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির মধ্যে অবশ্যই বলতে হবে হংডু জিজে-১১র কথা। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি উইংম্যান ড্রোন, যা নিয়ে শত্রুব্যূহে হামলা চালাতে পারবে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বিমানবাহিনী। লড়াকু জেটের সঙ্গে উড়ে গিয়ে হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট উইংম্যান ড্রোনের।
সিপ্রি-র সমীক্ষকদের অনুমান, ‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজে অস্ত্র প্রদর্শনীর ফলস্বরূপ এশিয়া এবং আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৃদ্ধি পাবে চিনের হাতিয়ার রফতানি। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজ়িক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ়’-এর (সিএসআইএস) দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০-’২০ সালের মধ্যে বেজিঙের বিক্রি করা অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল পাকিস্তান। এই সময়সীমার মধ্যে ড্রাগনের রফতানি করা হাতিয়ারের ৪৯.১ শতাংশ গিয়েছে ইসলামাবাদে।
পাক ফৌজের হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ চিনা সমরাস্ত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জে-১০সি এবং জেএফ-১৭ লড়াকু জেট। এ ছাড়া বেজিঙের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে ইসলামাবাদ। রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা ড্রাগনের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির জে-৩৫এ যুদ্ধবিমানের প্রথম গ্রাহক হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
বেজিঙের অস্ত্রব্যবসার আরও দুই গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহক হল বাংলাদেশ এবং মায়ানমার। সিএসআইএস জানিয়েছে, ২০১০-’২০ সালের মধ্যে চিনের রফতানি করা হাতিয়ারের ২০ শতাংশ ছিল ঢাকার দখলে। আর সাবেক বর্মা মুলুকটির ক্ষেত্রে এই অঙ্ক ১১ শতাংশ। এ ছাড়া তাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়াও ড্রাগনের হাতিয়ার আমদানি করে থাকে। ড্রাগনের অস্ত্রব্যবসায় এই দুই দেশের অবদান যথাক্রমে ৩.২ শতাংশ এবং ২.৬ শতাংশ।
সিপ্রির রিপোর্ট অনুযায়ী, এশিয়ার মাত্র তিনটি দেশে ৮০ শতাংশ হাতিয়ার রফতানি করে থাকে চিন। সংশ্লিষ্ট তিনটি রাষ্ট্রই ভারতের প্রতিবেশী। তারা হল পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং মায়ানমার। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, হাতিয়ার ব্যবসায় দারুণ ভাবে পা জমানোর ক্ষেত্রে বেজিঙের কিছু অসুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল সমরাস্ত্রের গুণগত মান। তা ছাড়া এ ব্যাপারে রাশিয়া পিছিয়ে পড়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
বেশ কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের কথায়, এখনও পর্যন্ত চিনের তৈরি কোনও হাতিয়ার যুদ্ধের রং বদলে দিয়েছে, এমনটা নয়। এ ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং জার্মানি। ভিয়েতনামের লড়াই থেকে আফগানিস্তান কিংবা হালফিলের ইউক্রেন সংঘাত— কখনও একে-৪৭ রাইফেল, কখনও আবার স্টিঙ্গার বা জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র, যে ভাবে নিজেদের জাত চিনিয়েছে, তার ধারেকাছে নেই ড্রাগন।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার মতো জটিল হাতিয়ারের সব কিছু যে চিনা প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি তৈরি করছে, তা কিন্তু নয়। উদাহরণ হিসাবে লড়াকু জেটের ইঞ্জিনের কথা বলা যেতে পারে, যা এখনও মস্কোর থেকে আমদানি করতে হচ্ছে বেজিংকে। তা ছাড়া ড্রাগন ফৌজের বহরে রয়েছে ক্রেমলিনের ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ, নিজেদের তৈরি এয়ার ডিফেন্স নিয়ে পিএলএ-র ভরসার জায়গাটা যে টলমল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এ বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের সংঘর্ষে ভারতের হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয় পাক ফৌজ। সংঘাতের সময় নয়াদিল্লির ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিতই করতে পারেনি চিনের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। উল্টে ইজ়রায়েলি ড্রোন ব্যবহার করে সেগুলিকে ধ্বংস করে এ দেশের সেনা। এ ছাড়া মাঝ-আকাশের লড়াইয়ে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেও সেটি কাজ করেনি। পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম থেকে অক্ষত অবস্থায় সেটিকে উদ্ধার করে এলাকাবাসী।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ চিনা হাতিয়ারগুলির এ-হেন বেহাল দশা দেখার পর বেজিঙের অস্ত্রের উপর ভরসা কমেছে। সম্প্রতি ড্রাগনের থেকে জেএফ-১৭ থান্ডার লড়াকু জেট কেনার পরিকল্পনা করেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই বরাত বাতিল করে বুয়েনাস আইরেস। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-১৬ কেনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
তৃতীয়ত, পশ্চিম ইউরোপ, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশের বাহিনী মার্কিন হাতিয়ার ব্যবহার করতে পছন্দ করে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় একগুচ্ছ দেশের সঙ্গে আবার চিনের রয়েছে সীমান্ত বিবাদ। ফলে তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করা বেজিঙের পক্ষে অসম্ভব। শুধু তা-ই নয়, ড্রাগনের ‘দৌরাত্ম্যে’ অতিষ্ঠ হয়ে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার (রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে) মতো দেশ।
এ ছাড়া গত কয়েক বছরে অত্যাধুনিক হাতিয়ার নির্মাণের ব্যাপারে যথেষ্ট ক্ষমতা অর্জন করেছে ভারত। নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বিমানবাহী রণতরী, পরমাণু হাতিয়ার বহণে সক্ষম ডুবোজাহাজ এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বর্তমানে ঘরের মাটিতেই তৈরি করছে নয়াদিল্লি। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ সেগুলির চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের পর বিশ্বের অস্ত্রব্যবসায় পা জমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, হাতিয়ার ব্যবসায় রাশিয়ার সূচক নিম্নমুখী হওয়ার মূল কারণ হল নিষেধাজ্ঞা। মস্কোর উপর থেকে সেটা যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়া তুলে নিলে ফের হু-হু করে বিক্রি হবে ক্রেমলিনের তৈরি সমরাস্ত্র। গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের দরুন পূর্ব ইউরোপের দেশটির একাধিক হাতিয়ারের চাহিদা দুনিয়া যে তুঙ্গে রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চিনের অস্ত্রব্যবসার আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হল ইজ়রায়েল। ইহুদিদের তৈরি ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং লেজ়ার হাতিয়ারের যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। হাতিয়ারের দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারলে বছরে ১৫ হাজার কোটি ডলার মুনাফার সুযোগ রয়েছে বেজিঙের। তবে সেখানে ড্রাগন আদৌ পৌঁছোতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।