মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আর কৃত্রিম মেধার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) যুগলবন্দি। এই দু’য়ের সংমিশ্রণে এ বার ‘সুপার হিউম্যান’ তৈরির স্বপ্ন দেখছে চিন! দাবি, শক্তির নিরিখে তা ছাপিয়ে যাবে রোবটকে। শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বা মহাকাশ গবেষণা— এর মাধ্যমে উন্নয়নের প্রতিটা ক্ষেত্রে ‘খেলা ঘোরানো’র পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। ড্রাগনের এ-হেন ‘এআই মানব’ নির্মাণের সিদ্ধান্তে তাই ঘুম উড়েছে আমেরিকার। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে নয়াদিল্লিরও।
সম্প্রতি চিনের ‘সুপার হিউম্যান’ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইম্স’। তার পরই সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে দুনিয়া জুড়ে পড়ে যায় হইচই। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমটির দাবি, বর্তমানে ‘ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস’ বা মস্তিষ্ক-কম্পিউটার সংমিশ্রণের গবেষণায় অনেকটা সাফল্য পেয়েছে বেজিং। এর উপরে ভিত্তি করে ‘এআই মানব’ গড়ে তোলার নীলনকশা ছকে ফেলেছেন মান্দারিনভাষী বিজ্ঞানীরা।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, ‘এআই মানব’ প্রকৃতপক্ষে মানুষ এবং মেশিনের সংমিশ্রণ। এর কাজ বা চিন্তা করার ক্ষমতা সাধারণ কোনও পুরুষ বা মহিলার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ ব্যাপারে সাফল্য এলে মানবসভ্যতার ইতিহাসকে যে চিন অন্য খাতে বইয়ে দেবে, তা বলাই বাহুল্য। আর তাই সংশ্লিষ্ট গবেষণার বিষয়টিকে যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করছে বেজিং, জানিয়েছে ‘দ্য ওয়াশিংটন টাইম্স’।
সূত্রের খবর, চৈনিক ‘সুপার হিউম্যান’-এর মস্তিষ্ক সরাসরি যুক্ত থাকবে কম্পিউটারের সঙ্গে। এরই পোশাকি নাম ‘ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস’ বা মস্তিষ্ক কম্পিউটার সংমিশ্রণ। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলিতে এর সুবিধা সংক্রান্ত বিষয়ে একটি কাল্পনিক চিত্র দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি, ‘এআই মানব’ কোনও ইমেল লেখার কথা ভাবলে সঙ্গে সঙ্গে তা ফুটে উঠবে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। ওই ব্যক্তিকে এর জন্য আলাদা করে কিবোর্ডে একটি শব্দও টাইপ করতে হবে না।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এ-হেন কাল্পনিক চিন্তাভাবনার তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হবে চিনের ‘সুপার হিউম্যান’। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজি’ বিভাগ। তাদের দাবি, মোট তিন শ্রেণির ‘এআই মানব’ তৈরির চেষ্টা করছে বেজিং। সেগুলি হল, আক্রমণাত্মক, আধা-আক্রমণাত্মক এবং অনাক্রমণাত্মক।
মার্কিন গবেষণা সংস্থাটির দাবি, ‘সুপার হিউম্যান’ তৈরি করতে হলে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে সরাসরি গণনামূলক কোনও ডিভাইসে যুক্ত করতে হবে। এর পর টার্বোচার্জ প্রযুক্তির ব্যবহারে সেগুলির সক্ষমতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা যাবে। বর্তমানে চিনের বিজ্ঞানীরা সেই প্রক্রিয়ার প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে গিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ-হেন ‘এআই মানব’ তৈরির ক্ষেত্রে ঝুঁকিও রয়েছে বিস্তর।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজ়ি’র এক পদস্থ আধিকারিক বলেছেন, ‘‘বেজিং যেটা করছে তাতে হয় যন্ত্র মানুষের মতো আচরণ করবে, নয়তো মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে ফারাক মুছে যাবে। তাদের গবেষণা সফল হলে মানব-মস্তিষ্ক এবং সার্কিট একসঙ্গে কাজ করবে। তখনই মুছে যাবে যন্ত্র এবং মানুষের মধ্যেকার সীমারেখা।’’ এই প্রক্রিয়ায় মানুষের মনের উপর সরাসরি প্রযুক্তি প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে আরও বৃহৎ আকারে কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তিকে গড়ে তুলতে এর ‘ভাষা মডেল’কে (ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল) উন্নত করার দিকে নজর দিয়েছে ওপেনএআই বা মেটার মতো মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থা। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতায় অংশ না নিয়ে মস্তিষ্ক অনুপ্রাণিত সিস্টেম গড়ে তোলার রাস্তায় ছুটেছে চিন। বেজিঙের এই গবেষণা চিপ নির্মাণ বা ব্রুট-ফোর্স কম্পিউটিংয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং এর মাধ্যমে বিকল্প একটি রাস্তার সন্ধান দিতে পারেন মান্দারিনভাষী বিজ্ঞানীরা।
চিনের এই গবেষণার সবচেয়ে বড় সমর্থক হলেন তিয়ানজ়িন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডং মিং। গত সেপ্টেম্বরে বেজিঙের সরকারি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এআই নিয়ে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে মানুষের পরিবর্তে কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি কাজ করবে, এই ধারণা সঠিক নয়। বরং মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।’’
‘সুপার হিউম্যান’ তৈরি করার লক্ষ্যে মস্তিষ্ক কম্পিউটার সংমিশ্রণের গবেষণা খুব অল্প দিন ধরে যে চিন চালাচ্ছে, এমনটা নয়। ২০১৮ সালে ‘জ়েড অ্যাডভান্স কম্পিউটিং’ প্রযুক্তি তৈরি করে সরকারের নজরে আসেন বেজিঙের দুই গবেষক ভাই, বিজ়ান এবং সাইদ তাদায়ন। সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিতে ইমেজ বা ছবি চিহ্নিতকরণের জন্য মস্তিষ্ক অনুপ্রাণিত অ্যালগরিদম তৈরি করতে সক্ষম হন তাঁরা, যা এআইয়ের দুনিয়ায় বিপ্লব এনেছিল।
এর পরই তাদায়ন ভাইদের সংস্থার ২০ শতাংশ অংশীদারি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় কমিউনিস্ট চিনের সরকার। পাশাপাশি, ‘এআই মানব’ প্রকল্পে কাজ করার জন্য প্রশাসনের তরফে তিন কোটি ডলারের প্রস্তাব পান তাঁরা। পরবর্তী সময়ে তাদায়ন ভাইদের তৈরি অ্যালগরিদমকে অন্য ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন মান্দারিনভাষী বিজ্ঞানীরা। এর জন্য তৈরি করা হয় উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ‘গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট’ (জিপিইউ)। মানব-মস্তিষ্ক কী ভাবে বিভিন্ন তথ্য বোঝে এবং তা শ্রেণিবদ্ধ রাখে, সেটাই বোঝার চেষ্টা রয়েছে তাঁদের।
সংশ্লিষ্ট গবেষণার সবচেয়ে বড় বাধার জায়গাটি হল মানব পরীক্ষা বা হিউম্যান ট্রায়াল। মানুষের দেহের অন্যতম জটিল অঙ্গ হল মস্তিষ্ক। এর বহু কিছু এখনও চিকিৎসক গবেষকদের কাছে অজানা রয়ে গিয়েছে। ফলে হাউব্রিড মানব মডেল নির্মাণ কতটা বাস্তবের মুখ দেখবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয় সমস্যার জায়গাটি হল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। ‘এআই মানুষ’-এর মস্তিষ্কের তার জোড়া থাকবে কম্পিউটারের সঙ্গে। ফলে তাঁর চিন্তাভাবনা পুরোপুরি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চলে যেতে পারে সরকারের মুষ্টিমেয় কয়েক জনের হাতে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আমজনতাকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহারের সুযোগ পাবেন তাঁরা। এর ‘কুফল’ যে সমাজের উপরে দেখতে পাওয়া যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তৃতীয়ত, মানব-মস্তিষ্ক সুকুমার কাজের সঙ্গেও যুক্ত। আনন্দ বা বিষাদের সময় বিভিন্ন রকমের যে অনুভূতি সকলে ব্যক্ত করে থাকে, সেটাও আসে মস্তিষ্ক থেকেই। ‘সুপার হিউম্যান’-এর ক্ষেত্রে সেখানে যান্ত্রিকতা আসার আশঙ্কা থাকছে। ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে পারে হাসি, কান্না, ছবি আঁকা, গান বা অন্য যে কোনও সৃজনশীল শিল্পকীর্তি।
অন্য দিকে, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রাণী ও কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ব্যবহারের চেষ্টা রয়েছে জার্মানির। সেখানকার ‘সোয়ার্ম বায়োট্যাকটিক্স’ নামের স্টার্টআপ সংস্থা তৈরি করেছে বিশেষ ধরনের একটি ‘ব্যাকপ্যাক’। এটি বাঁধা হবে আরশোলার পিঠে। এর পর শত্রুর দেশে কায়দা করে ওই সন্ধিপদ পতঙ্গগুলিকে ছেড়়ে দিতে পারলেই সেখানকার হাঁড়ির খবর জোগাড় করা যাবে বলে দাবি করেছে ওই সংস্থা।
সংবাদসংস্থা ‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘সোয়ার্ম বায়োট্যাকটিক্স’-এর তৈরি ওই ব্যাকপ্যাকে থাকছে সেন্সর, ক্যামেরা এবং নিউরাল স্টিমুলেটর। রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বহু দূর থেকে এগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট ব্যাকপ্যাকটিতে কৃত্রিম মেধা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তারা। গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ওই ব্যাকপ্যাকই আরশোলার পিঠে বাঁধা হবে বলে জানা গিয়েছে।
তবে যে কোনও ধরনের আরশোলাকে জার্মানেরা গুপ্তচরবৃত্তিতে নামাচ্ছে, তা ভাবলে ভুল হবে। এর জন্য পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার থেকে হিসিং প্রজাতির আরশোলা আমদানি করেছে বার্লিনের ওই স্টার্টআপ। ‘সোয়ার্ম বায়োট্যাকটিক্স’ জানিয়েছে, যে কোনও ধ্বংসস্তূপ, দেওয়াল বা সঙ্কীর্ণ জায়গায় চলাফেরা করতে পারে তেলাপোকা। ফলে পতঙ্গটিকে ব্যবহার করে ‘রিয়্যাল টাইম ডেটা’ সংগ্রহ করা সম্ভব।
জার্মান সংস্থাটির দাবি, যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে ড্রোনে নজরদারি করা সম্ভব নয়, সেখানে তথ্য পাচারের কাজ করবে আরশোলা গুপ্তচরবাহিনী। শত্রু ফৌজের গোপন আস্তানা খুঁজে বার করা বা পণবন্দিদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি দুর্দান্ত ভাবে কাজ করবে। এ ছাড়া পতঙ্গগুলির পাঠানো তথ্যের উপরে ভিত্তি করে জঙ্গি দমন অভিযানও পরিচালনা করা যাবে বলে দাবি করেছে ওই সংস্থা।
সব ছবি: সংগৃহীত।