দূরপাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ‘উইংম্যান’ ড্রোন। সঙ্গে লেজ়ার হাতিয়ার ও রোবট নেকড়ে! ‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজে গোটা বিশ্বের সামনে শক্তিপ্রদর্শন করল চিন। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এর মাধ্যমে সরাসরি আমেরিকার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বেজিং। ড্রাগনের সমরশক্তির প্রদর্শন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সেনা অফিসারদের রক্তচাপ যে কয়েক গুণ বাড়াল, তা বলাই বাহুল্য। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই ঘটনার জেরে তিন মাস আগের মার্কিন সেনার কুচকাওয়াজের সঙ্গে লালফৌজের তুলনা টানা শুরু করে দিয়েছেন নেটাগরিকদের একাংশ।
৩ সেপ্টেম্বর তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের ‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ প্রদর্শিত হাতিয়ারগুলির মধ্যে প্রথমেই আসবে ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। দ্বিতীয়টি শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল হওয়ায় তাকে আটকানো প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। সাবেক সেনাকর্তাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট অস্ত্রগুলির পাল্লা যুক্তরাষ্ট্রের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। কারণ, চোখের নিমেষে ১২ থেকে ২০ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিখুঁত নিশানায় আছড়ে পড়ার মতো ক্ষেপণাস্ত্রকে এ বারের কুচকাওয়াজে প্রকাশ্যে এনেছে পিএলএ।
‘বিজয় দিবস’ কুচকাওয়াজে ডংফেং-৬১ এবং ডংফেং-৫সির মতো আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম (ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) প্রদর্শন করেছে চিনা লালফৌজের রকেট ফোর্স। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রগুলি একসঙ্গে একাধিক পরমাণু হাতিয়ার বহন করতে সক্ষম। ফলে কোনও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ই (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স) এগুলিকে মাঝ-আকাশে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারবে না।
তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে চিনা বাহিনীর দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল ডংফেং-২৬ডি নামের ‘মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ বা আইআরবিএম (ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল)। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলি একে চেনে ‘গুয়াম কিলার’ হিসাবে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে রয়েছে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। বেজিং থেকে এর দূরত্ব প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এটি উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির নকশা তৈরি করেছেন ড্রাগনের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
এ ছাড়াও ওয়াইজে-১৭ এবং ওয়াইজে-১৯-এর মতো বেশ কয়েকটি রণতরী বিধ্বংসী হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র চিনা পিএলএ-র কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সামরিক গবেষক আলেকজ়ান্ডার নীল জানিয়েছেন, বেজিং তার প্রতিরোধ কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট বাহিনীকে তৈরি করেছে। মার্কিন নৌ আধিপত্যকে ধ্বংস করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
কুচকাওয়াজে অন্যান্য হাতিয়ারের মধ্যে সকলের চোখ টেনেছে এলওয়াই-১ লেজ়ার অস্ত্র। এর পাল্লা ও ধ্বংস করার ক্ষমতা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আপাতত গোপন রেখেছে চিন। তবে বেজিঙের গণমাধ্যমগুলির দাবি, মাঝ-আকাশে শত্রুর লড়াকু জেট পুড়িয়ে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে এই লেজ়ার হাতিয়ারের। খালি চোখে লেজ়ার রশ্মি দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে অস্ত্রটিকে ‘মেঘনাদ’-এর মতো ব্যবহার করতে পারবে পিএলএ।
বর্তমানে চিনা নৌবাহিনী বিশ্বের বৃহত্তম। বায়ুশক্তির দিক দিয়ে তাদের স্থান দ্বিতীয়। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত গতিতে বিমানবাহিনীর বহর বৃদ্ধি করছে বেজিং। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, খুব দ্রুত এই দিক দিয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে ছুঁয়ে ফেলবে ড্রাগনের লালফৌজ। তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজে জে-২০ এবং জে-৩৫-সহ একগুচ্ছ পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির লড়াকু জেট সামনে এনে দুনিয়াকে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তারা।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানের আকর্ষণ ছিল কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) চালিত এজেএক্স-০০২ ডুবো ড্রোন। ২০ মিটার লম্বা সমুদ্রের গভীরে চলাচলে সক্ষম সংশ্লিষ্ট ডুবোযানটি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম কি না, তা স্পষ্ট নয়। সাবেক সেনাকর্তাদের অধিকাংশেরই মত হল, মূলত নজরদারি এবং অনুসন্ধান মিশনের জন্যেই একে তৈরি করেছেন চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির জিজে-১১ হামলাকারী ড্রোন প্রদর্শন করেছে চিনা পিএলএ। যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি উড়ে গিয়ে হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে এই মানববিহীন উড়ুক্কু যানের। সেই কারণেই বেজিঙের লালফৌজের কাছে এটি ‘অনুগত উইংম্যান’। এই ড্রোনটিকেও কৃত্রিম মেধা চালিত বলে দাবি করেছে ড্রাগনভূমির একাধিক গণমাধ্যম।
পাশাপাশি কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল রোবট নেকড়ে। বিভিন্ন কাজে এগুলিকে ব্যবহার করতে পারবে পিএলএ। তার মধ্যে রয়েছে দুর্গম এলাকায় নজরদারি এবং শত্রু সৈন্যদের খুঁজে বার করা। রোবটগুলির উপরের অংশে ছোট মেশিনগান বসানোর জায়গাও রয়েছে, যা দিয়ে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে গুলি ছুড়তে পারবেন চিনা সৈনিকেরা।
অনুষ্ঠানটিতে পিএলএ সৈনিকদের মধ্যে একতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাহিনীর এক একটি অংশ কুচকাওয়াজে যে শৃঙ্খলা প্রদর্শন করেছে, তা যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। আর এইখানেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা টানছেন অনেকে। গত ১৪ জুন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ফৌজের ২৫০তম বার্ষিকীতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কুচকাওয়াজের আয়োজন করে মার্কিন সেনা। কিন্তু, সেখানে শৃঙ্খলিত ভাবে আমেরিকার সৈনিকদের রাজপথে পা ফেলতে দেখা গিয়েছিল, এমনটা নয়।
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইকেল রাস্কা বলেছেন, ‘‘তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে আমেরিকার সঙ্গে সমান তালে দৌড়োচ্ছে চিন। শুধু তা-ই নয়, কৃত্রিম মেধাভিত্তিক লড়াইয়ের নিরিখে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সামান্য এগিয়ে রয়েছে বেজিং। সংঘাত দ্রুত শেষ করার ক্ষেত্রে এআই যে আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, তা বুঝে গিয়েছে ড্রাগন।’’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত সাড়ে তিন বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উপর কড়া নজর রেখেছে চিন। দু’তরফের রণকৌশল থেকে শেখার চেষ্টা করছেন বেজিঙের ফৌজি জেনারেলরা। এর পরেই তাঁদের মধ্যে কৃত্রিম মেধাকে সমরাস্ত্র প্রযুক্তিতে যুক্ত করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে। আর সেখানে যে ড্রাগনের গবেষকেরা অনেকটাই সাফল্য পেয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামরিক শক্তিতে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া ছাড়াও তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওজের আরও কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন এক ডজনের বেশি রাষ্ট্রপ্রধান। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকের (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) ‘সুপ্রিম লিডার’ কিম জং-উন। এঁদের মার্কিন-বিরোধী জোটের অংশ হিসাবে তুলে ধরেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
দ্বিতীয়ত, কুচকাওয়াজে অত্যাধুনিক চিনা হাতিয়ার প্রদর্শনী ছিল অস্ত্রের বাজারে পা জমানোর একটা কৌশল। সেখানে অনেকটাই সাফল্য পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি। ইতিমধ্যেই মায়ানমার-সহ বেশ কয়েকটি দেশ বেজিঙের কাছে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ারের বরাত দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে ইসলামাবাদের অস্ত্রভান্ডারের প্রায় ৮০ শতাংশই রয়েছে ড্রাগনের দখলে।
কিন্তু, তার পরেও তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত চিনা অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সেগুলির অধিকাংশের নকশার সঙ্গে মার্কিন হাতিয়ারের মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে কোনও সমরাস্ত্রই তৈরি করতে পারেনি বেজিং। তাঁদের অধিকাংশ হাতিয়ারই হয় রাশিয়া, নয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কোনও না কোনও মারণাস্ত্রের ‘নকল’। ফলে রণক্ষেত্রে অস্ত্রগুলি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন অধ্যাপক রাস্কা। তাঁর কথায়, ‘‘গত অগস্টে ফিলিপিন্সের উপকূলরক্ষীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় চিনা নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। ওই সময়ে আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে গিয়ে নিজেদের একটি যুদ্ধজাহাজকেই ধাক্কা মেরে বসে তাঁদের রণতরী। এতেই প্রমাণিত যুদ্ধের সময়ে নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার মতো কৌশল এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি ড্রাগনের হাতিয়ার।’’
গত শতাব্দীর ’৭০-এর দশকের পর থেকে আর কখনওই কোনও সংঘর্ষে জড়ায়নি চিন। ফলে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র সেই অর্থে কোনও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। অন্য দিকে সারা বছরই কোনও না কোনও ভাবে সংঘর্ষের সঙ্গে যুক্ত থাকে মার্কিন ফৌজ। দেশের বাইরে ৮০০-র বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে তাঁদের। কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক রণকৌশলের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী যথেষ্ট পটু।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে কোরীয় উপদ্বীপ এবং তাইওয়ানের দখল নিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়াতে পারে আমেরিকা ও চিন। দু’টি দেশই এখন থেকে তার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। গবেষক নীল বলেছেন, ‘‘বেজিঙের হাতিয়ার নিঃসন্দেহে আমেরিকার চিন্তা বাড়াবে। তবে লম্বা সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ড্রাগনের পক্ষে অসম্ভব। সেখানে প্রেসিডেন্ট শি-র থিয়েটার কমান্ডগুলি ব্যর্থ হতে পারে।’’
সব ছবি: সংগৃহীত।