পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির মার্কিন লড়াকু জেট ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’-র পর এ বার চিনা বৈদ্যুতিন বাস। এতে বেজিঙের ‘কিল সুইচ’ আছে বলে ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়েছে আতঙ্ক। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, এর জন্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে ইউরোপের পরিবহণ ব্যবস্থা। আর তাই তড়িঘড়ি বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং ব্রিটেন-সহ সেখানকার একাধিক দেশ। অন্য দিকে সরকারি ভাবে এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ড্রাগন।
‘ফিন্যান্সিয়াল টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রিটেন-সহ ইউরোপীয় দেশগুলিতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিন বাসের নির্মাণকারী চিনা সংস্থা হল ‘ইউটং’। চলতি বছরের অক্টোবরে বেজিঙের ৬২ বছরের পুরনো ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তে নামে ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং নরওয়ে। বৈদ্যুতিন বাসে কোনও ‘কিল সুইচ’ আছে কি না, সেটা খুঁজে বার করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। নভেম্বরে, ওই তিন দেশের দেখাদেখি একই সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার।
এখন প্রশ্ন হল কী এই ‘কিল সুইচ’? পশ্চিমি গণমাধ্যমের দাবি, সফ্টঅয়্যারচালিত এটি একটি বিশেষ ধরনের ডিভাইস। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বসে এটি সক্রিয় করতে পারবে বেজিং। সে ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করা থামিয়ে দেবে বৈদ্যুতিন বাসের ইঞ্জিন। ফলে পুরোপুরি ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে গণপরিবহণ ব্যবস্থা। এককথায় ‘কিল সুইচ’-এর জন্যই নাকি ইউরোপকে একরকম হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছে চিন।
কিন্তু, সত্যিই কি তাই? এই প্রশ্নের জবাব পেতে ‘ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার’ বা এনসিএসসি-র সঙ্গে কোমর বেঁধে তদন্তে নেমেছে ব্রিটেনের পরিবহণ দফতর। তাদের দাবি, সম্প্রতি বৈদ্যুতিন বাসগুলির সফ্টঅয়্যার আপডেট পাঠায় নির্মাণকারী চিনা সংস্থা ‘ইউটং’। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট যানগুলিতে ‘কিল সুইচ’ আপলোড করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছেন ইংরেজ গোয়েন্দারা। বর্তমানে গণপরিবহণে ইউটঙের তৈরি ৭০০ বাস ব্যবহার করছে আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্র।
ব্রিটেনে যাত্রী পরিষেবায় বৈদ্যুতিন বাস ব্যবহার করে ‘স্টেজ়কোচ’ এবং ‘ফার্স্ট বাস’ নামের দু’টি সংস্থা। এদের কাছে চিনা সংস্থাটির তৈরি অন্তত ২০০টি বৈদ্যুতিন বাস রয়েছে। এ ছাড়া ইউটঙের থেকে ডবল-ডেকার বৈদ্যুতিন বাস কেনার পরিকল্পনা রয়েছে ব্রিটিশ পরিবহণ দফতরের। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই বরাত বাতিল হতে পারে। ইউরোপের বাইরে বেজিং নির্মিত বৈদ্যুতিন বাসে ‘কিল সুইচ’-এর খোঁজ চালাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সরকারেও, জানিয়েছে ‘রিজ়িয়ন ক্যানবেরা’ নামের অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম।
অন্য দিকে নরওয়ের গণপরিবহণ পরিষেবা সংস্থা রুটারের তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বসে ইউটং বাসের ব্যাটারি এবং পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমকে হ্যাক করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট যানগুলিতে রয়েছে ‘ওভার দ্য এয়ার’ (ওটিএ) সফ্টঅয়্যার আপডেট। এর সঙ্গে ‘কিল সুইচ’-এর বেশ মিল আছে। যদিও ইউটঙের কোনও বাস পরিষেবা দেওয়ার সময় কাজ করা থামিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।
বৈদ্যুতিন বাসের ‘কিল সুইচ’ সংক্রান্ত প্রাথমিক তদন্তের পর এ ব্যাপারে একটি সহজ সমাধানের কথা বলেছে রুটার। গণপরিবহণে ব্যবহৃত চিনা গাড়িগুলিতে রয়েছে একটি সিম কার্ড। সেটা খুলে ফেলার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে নরওয়ের সংস্থা। সিম কার্ড ছাড়া সফ্টঅয়্যার আপডেট করতে পারবে না ইউটঙের বাস। ফলে বেজিঙের ‘কিল সুইচ’ হামলার ঝুঁকি কমবে। তবে সফ্টঅয়্যার আপডেট না হলে গাড়িগুলি দীর্ঘ দিন মসৃণ ভাবে কাজ করতে পারবে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
‘ওভার দ্য এয়ার’ আপডেট নিয়ে আবার মুখ খুলেছেন ব্রিটেনের ‘পেলিকান বাস অ্যান্ড কোচ’ নামের একটি সংস্থা। দ্বীপরাষ্ট্রে ইউটঙের বাস বিক্রি করে থাকে তারা। কোম্পানির পদস্থ কর্তা ইয়ান ডাউনির কথায়, ‘‘নরওয়ের তদন্ত অনুযায়ী বৈদ্যুতিন বাসগুলিতে ‘কিল সুইচ’ আছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে আমাদের ধারণা এর মাধ্যমে এসি বা মিউজিক সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ পাবে চিন। স্টিয়ারিং, ব্রেক বা ইঞ্জিন থামিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা এর নেই।’’
তবুও ‘সাবধানের মার নেই’ এই মনোভাব থেকে বৈদ্যুতিন বাসের সফ্টঅয়্যার আপডেট ‘ম্যানুয়ালি’ করছে অস্ট্রেলিয়া। ‘ওভার দ্য এয়ার’-এর ব্যবহার বন্ধ করেছে তারা। অন্য দিকে ‘কিল সুইচ’ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে ইউটং। সংস্থার মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘আমরা সর্বদাই গাড়ির তথ্য সুরক্ষা এবং গ্রাহকের গোপনীয়তার অধিকার রক্ষায় তৎপর। সেইমতো নিয়ম মেনে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।’’
ওটিএ আপডেটের পদ্ধতি শুধুমাত্র চিনা বৈদ্যুতিন বাসে রয়েছে, এমনটা নয়। বর্তমানে টেসলা, ফোর্ড, বিওয়াইডি বা বিএমডব্লিউ-এর মতো গাড়িতেও দূরবর্তী সফ্টঅয়্যার আপডেটের ব্যবস্থা থাকে। এসি, নেভিগেশন মানচিত্র এবং অ্যাডভান্স ড্রাইভার অ্যাসিস্ট্যান্স সিস্টেমকে মসৃণ ভাবে চালু রাখতে এটি ব্যবহার করা হয়। এতে কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ইঞ্জিন বন্ধ (ফ্রিজ়) করতে পারে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
গাড়িতে ‘ইঞ্জিন ফ্রিজ়িং’ পদ্ধতি রাখার নেপথ্যে টেসলা বা ফোর্ডের মতো সংস্থা দু’টি যুক্তি দিয়ে থাকে। প্রথমত, গাড়ি চুরি গেলে এই ‘কিল সুইচ’ ব্যবহার করতে পারবেন গ্রাহক। দ্বিতীয়ত, গাড়ির ঋণ সময়মতো পরিশোধ না করলে ইঞ্জিন ফ্রিজ় করে রাখা যাবে। এই ধরনের ক্ষেত্রে সহজেই গাড়িটিকে বাজেয়াপ্ত করতে পারবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক বা ঋণ প্রদানকারী সংস্থা।
ইউরোপীয় গণপরিবহণ সংস্থাগুলির তার পরেও অবশ্য সন্দেহ যাচ্ছে না। কারণ, চিনা কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। ২০১৭ সালে বেজিঙের হুয়াওয়ে এবং জ়েডটিই নামের দু’টি সংস্থার থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার বরাত বাতিল করে আমেরিকার যুদ্ধ সদর দফতর পেন্টাগন। যুক্তি ছিল, ব্যবসার নামে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর হাঁড়ির খবর জোগাড় করার চেষ্টা করছে ড্রাগন।
২০১৮ সালে হুয়াওয়ের তৈরি মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ডিভাইসের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ। পরে এ ব্যাপারে বিবৃতি দেয় ওয়াশিংটন। সেখানে বলা হয়, তথ্য আদানপ্রদানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ডিভাইসগুলিকে ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি চালাচ্ছে চিন। ওই বছরই হুয়াওয়ের থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা বন্ধ করে অস্ট্রেলিয়ার সরকার।
২০২০ সালে ৫জি নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটেন। আর তাই ২০২৭ সালের মধ্যে টেলি যোগাযোগ ক্ষেত্রে চৈনিক সংস্থাটির যাবতীয় সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে আটলান্টিকের পারের দ্বীপরাষ্ট্র। এর জন্য ৬৫ কোটি ৩০ লক্ষ ডলারের লোকসান হচ্ছে তাদের।
এ ছাড়া গুপ্তচরবৃত্তির আশঙ্কায় সেনাঘাঁটি থেকে শুরু করে সরকারি দফতরে চিনা সংস্থা হিকভিশন এবং ডাহুয়ার সিসি ক্যামেরা লাগানো বন্ধ করেছে আমেরিকা। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বেজিঙের তৈরি কোনও ড্রোন যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে ঢোকানো যাবে না বলে কড়া নির্দেশ দিয়েছে পেন্টাগন। অসামরিক ক্ষেত্রগুলিতেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে বলে জানা গিয়েছে।
আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি অবশ্য গুপ্তচরবৃত্তির আশঙ্কার নেপথ্যে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) জাতীয় নিরাপত্তা আইনের দিকে আঙুল তুলেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে সমস্ত নাগরিককে রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াতে হবে। হুয়াওয়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কারণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতারা প্রায় ১০ বছর বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
চলতি বছরের মার্চে ‘কিল সুইচ’-এর বিষয়টি প্রথম বার প্রকাশ্যে আনে একটি জার্মান গণমাধ্যম। মার্কিন সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর তৈরি এফ-৩৫ লড়াকু জেটে ওই ব্যবস্থা রয়েছে বলে দাবি করে তারা। এর পরই ইউরোপ জুড়ে হইচই পড়ে যায়। তড়িঘড়ি এফ-৩৫-এর বরাত বাতিল করে সেখানকার একাধিক রাষ্ট্র।
‘লকহিড মার্টিন’ এবং মার্কিন প্রশাসন অবশ্য এই নিয়ে মুখ খুলেছিল। এই ধরনের কোনও ব্যবস্থা এফ-৩৫ লড়াকু জেটে নেই বলে জানিয়ে দেয় তারা। যদিও তাতে পুরোপুরি সন্দেহ দূর হয়নি। ‘কিল সুইচ’-এর সমস্যা এড়াতে অনেকেই ঝুঁকেছে ফ্রান্সের দিকে। তাদের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমানকে বায়ুসেনার বহরে শামিল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।