ঠিক যেন রক্ত-মাংসের মানুষ। কথাবার্তা ও হাঁটাচলা এতটাই সাবলীল যে, সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে এর পার্থক্য বোঝার জো নেই! এ-হেন অত্যাধুনিক যন্ত্রমানবের সাহায্যে এ বার ভারতীয় সেনার গতিবিধির উপর নজরদারি চালাচ্ছে চিন? মনুষ্যরূপী রোবটগুলিকে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসিতে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) মোতায়েন করেছে বেজিং? সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োকে ঘিরে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ভারত-চিন সীমান্তের একটি ভিডিয়ো শেয়ার করেন জুনশিগুয়ানচা নামের এক নেটাগরিক। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ৩৩ সেকেন্ডের ক্লিপটি ভাইরাল হয়ে যায়। পোস্টে জুনশিগুয়ানচা লেখেন, ‘‘নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এই ভিডিয়ো পেয়েছি। এলএসিতে নজরদারি ডিভাইসের সাহায্যে আমাদের বাহিনীর উপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে চিন।’’ এর পরই সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন রকমের মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
এক্স হ্যান্ডল থেকে ভাইরাল হওয়া ৩৩ সেকেন্ডের ক্লিপে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় একটি যন্ত্রমানবকে দুর্গম পাহা়ড়ি ভূখণ্ডে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। ভিডিয়োয় কাউকে হিন্দিতে কথা বলতে শোনা গিয়েছে। তবে সেটা মনুষ্যরূপী রোবটের কণ্ঠস্বর কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ভিডিয়োটি প্রায় ৩,৪৮৮ কিলোমিটার লম্বা এলএসির কোথায় এবং কবে তোলা হয়েছে, তা-ও জানা যায়নি। এর সত্যতাও যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম।
নেটাগরিকদের একাংশ অবশ্য কথিত চিনা গুপ্তচর রোবটকে বিজ্ঞানভিত্তিক ছায়াছবির অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। কারও আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন মত রয়েছে। তাঁদের দাবি, অরুণাচল প্রদেশ বা লাদাখের কাছে নিয়মিত টহলের সময় ভারতীয় সৈনিকদের নজরে পড়ে বেজিঙের ওই যন্ত্রমানব। তবে অধিকাংশ সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী একে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নির্ভর ভিডিয়ো বলে দাবি করেছেন।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে যন্ত্রমানব নির্মাণে অভূতপূর্ণ সাফল্যের কথা জানিয়ে চিনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেতেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় হইচই। ওই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই এলএসিতে কথিত মনুষ্যরূপী গুপ্তচর রোবটের ভিডিয়ো সামনে আসায় বিষয়টিকে একেবারেই হালকা ভাবে নিচ্ছেন না এ দেশের সাবেক সেনাকর্তারাও। তাঁদের দাবি, ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’য় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে দিল্লির আরও বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ড্রাগনের সরকারি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৬ নভেম্বর যন্ত্রমানবের সফল পরীক্ষা চালায় সাংহাইয়ের সংস্থা ‘অ্যাজ়িবট’। তাদের তৈরি মনুষ্যরূপী রোবটটি চিনের জ়িয়াংসু প্রদেশের সুঝোর জ়িনজ়ি হ্রদ থেকে সাংহাইয়ের বুন্ড পর্যন্ত ১০৬ কিলোমিটার বিরামহীন ভাবে ট্রেক করতে পেরেছে বলে জানা গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, একটানা লম্বা রাস্তা পা়ড়ি দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দ্বিপদ যন্ত্রটির নামও উঠে গিয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।
‘অ্যাজ়িবট’ জানিয়েছে, তাদের তৈরি মনুষ্যরূপী যন্ত্রমানবটির উচ্চতা ১.৭৫ মিটার (৫.৭৪ ফুট) এবং ওজন প্রায় ৫৫ কিলোগ্রাম। রোবটটিতে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছে নির্মাণকারী সংস্থা। যন্ত্রমানবটিতে রয়েছে মোবাইল ফোন বা পাওয়ার ব্যাঙ্কের লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। সেখান থেকেই শক্তি নিয়ে ১০০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা হাঁটতে পেরেছে সেটি।
সাংহাইয়ের ‘অ্যাজ়িবট’ সংস্থাটি দীর্ঘ দিন ধরেই রোবট তৈরি করে আসছে। কোম্পানির নামেই মনুষ্যরূপী যন্ত্রমানবটির নাম ‘অ্যাজ়িবট এ২’ রেখেছে তারা। সংশ্লিষ্ট মেশিনে রয়েছে জিপিএস (গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টম) এবং ইনফ্রারেড ডেপথ ক্যামেরা। প্রথমটি রোবটটিকে পথ দেখিয়ে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে নিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়টির সাহায্যে সূর্যের আলো স্থানান্তরিত করে শহুরে বাধাবিপত্তি চিনে নিয়েছে ‘অ্যাজ়িবট এ২’।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে বেজিঙের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজ়ে রোবট-কুকুর প্রকাশ্যে এনে সারা বিশ্বের নজর কাড়ে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। একই ধরনের যন্ত্র রয়েছে ভারতীয় সেনার বহরেও। সারমেয়রূপী যন্ত্রগুলির উপর মেশিনগান বসিয়ে তার থেকে দিব্যি গুলি ছুড়তে পারেন এ দেশের সৈনিকেরা। এ ছাড়া নভশ্চর যন্ত্রমানবী রয়েছে নয়াদিল্লির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন’ বা ইসরোর হাতে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, মনুষ্যরূপী ফৌজি যন্ত্রমানব নির্মাণের থেকে খুব একটা দূরে নেই ভারতও। যদিও কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির নিরিখে নয়াদিল্লির থেকে বেজিং এগিয়ে আছে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁরা। সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, যে কোনও জটিল প্রযুক্তিকে বাহিনীতে শামিল করতে সময় লাগে। নভেম্বরের পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট রোবটটিকে পিএলএ-র পক্ষে এলএসির মতো সংবেদনশীল এলাকায় মোতায়েন করা বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন তাঁরা।
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় পিএলএ-র সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন ভারতীয় সৈনিক। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ দেশের বাহিনীর প্রত্যাঘাতে মৃত্যু হয়েছিল ৪০-এর বেশি চিনা ফৌজির। যদিও সরকারি ভাবে কখনওই সে কথা স্বীকার করেনি বেজিং। ওই ঘটনার প্রভাবে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ড্রাগনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কেও হ্রাস টানে নয়াদিল্লি।
গালওয়ান সংঘর্ষের পর উভয় পক্ষই এলএসিতে বিপুল সংখ্যক সৈনিক ও হাতিয়ার মোতায়েন করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তাওয়াং এবং ডেপসাং এলাকা দিয়ে চিনা পিএলএ ভারতে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁদের ঘিরে ধরে মারধর করে এ দেশের বাহিনী। ফলে বাধ্য হয়ে কিছুটা পিছু হটে বেজিং। ২০২৩ সালের পর কূটনৈতিক পথে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয় দু’পক্ষ।
গত বছরের অক্টোবরে এলএসির ডেপসাং এবং ডেমচক থেকে পিছু হটে বেজিঙের লালফৌজ। সেখানে আবার নিয়মিত টহল শুরু করে ভারতীয় সেনা। এ বছরের অগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র বৈঠকে যোগ দিতে চিন সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। সেখানে সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে ফেলার আশ্বাস দেয় মান্দারিনভাষীদের সরকার।
গালওয়ান সংঘাতের পর ভারত-চিন সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ রেখেছিল কেন্দ্র। গত নভেম্বরে ফের তা চালু করে মোদী সরকার। তবে বিবাদ যে একেবারে মিটে গিয়েছে এমনটা নয়। সম্প্রতি সাংহাই বিমানবন্দরে ট্রানজ়িটের সময় অরুণাচল প্রদেশবাসী এক মহিলাকে ১৮ ঘণ্টা ধরে আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে বেজিঙের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে ফের কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়ায় দুই প্রতিবেশী।
দীর্ঘ দিন ধরেই অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে ড্রাগন। সাংহাই বিমানবন্দরে আটকে পড়া সেই ভারতীয় মহিলার অভিযোগ, সেই কারণেই কেন তিনি চিনা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেননি, সে কথা জানতে চান সেখানকার আধিকারিকরা। অবৈধ ভাবে অরুণাচল প্রদেশকে দখলে রাখা হয়েছে বলেও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শোনা গিয়েছে তাঁদের।
এ-হেন পরিস্থিতিতে এলএসিতে যন্ত্র-রোবট বা কোনও ডিভাইসে ভারতীয় সেনার গতিবিধির উপর গুপ্তচরবৃত্তির খবর নিঃসন্দেহে নয়াদিল্লির কপালে ফেলেছে চিন্তার ভাঁজ। তবে ভাইরাল ভিডিয়োটি নিয়ে এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি ভারতীয় সেনা। ফলে পাল্টা প্রস্তুতি হিসাবে সীমান্তে কী কী পদক্ষেপ করা হচ্ছে, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু দিন।
সব ছবি: সংগৃহীত।