প্রায় তিন দশক পর দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা! আণবিক হাতিয়ার নিয়ে ফের আমেরিকা বনাম রাশিয়ার পেশি প্রদর্শন দেখবে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই চিনও। গত কয়েক বছরে নিঃশব্দে সংশ্লিষ্ট গণবিধ্বংসী হাতিয়ারটির সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে ভারতও। অন্য দিকে, পরমাণু শক্তি পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে সাবেক পারস্যভূমি তথা ইরান। ফলে আগামী দিনে সংঘাত পরিস্থিতিতে আণবিক হামলার আশঙ্কা যে বাড়তে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি, মার্কিন যুদ্ধ দফতরকে (আগে নাম ছিল প্রতিরক্ষা দফতর) অবিলম্বে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৩০ অক্টোবর নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ফলাও করে সে কথা ঘোষণা করেন তিনি। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে আণবিক হাতিয়ার বহনে সক্ষম একটি ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র এবং আণবিক শক্তিচালিত টর্পেডোর সফল পরীক্ষা চালায় মস্কো। ঠিক তার পরেই ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে দু’তরফে সংঘর্ষের উস্কানি হিসাবে দেখছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতার সূত্রপাত হয় গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে। ওই সময় মস্কোর সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে পড়ে ওয়াশিংটন। কিন্তু, ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) পতন হলে সেই পেশি প্রদর্শন একরকম থেমে গিয়েছিল। ২১ শতকে তা ফের নতুন করে শুরু করলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাবেক সেনাকর্তাদের কেউ কেউ মনে করেন, আগের তুলনায় অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হতে চলেছে এ বারের প্রতিযোগিতা।
গত ২১ অক্টোবর পরমাণু অস্ত্রবহনে সক্ষম ‘৯এম৭৩০ বুরেভেস্টনিক’ (স্টর্ম পেট্রল) ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় মস্কো। ক্রেমলিনের দাবি, উৎক্ষেপণের পর ১৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ওই হাতিয়ার, যা আকাশে ছিল অন্তত ১৫ ঘণ্টা! সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি যাবতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ভেদ করে আক্রমণ শানাতে পারবে বলে দাবি করা হচ্ছে। রুশ প্রতিরক্ষা গবেষকদের এ-হেন সাফল্যের পর গোটা পশ্চিমি দুনিয়ায় হইচই পড়ে যায়।
ওই ঘটনার সাত দিনের মাথায় (পড়ুন ২৮ অক্টোবর) একটি সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে ফের বোমা ফাটান পুতিন। বলেন, ‘‘পরমাণু শক্তিচালিত সীমাহীন পাল্লার ড্রোনের পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছে মস্কো।’’ হাতিয়ারটির পোশাকি নাম ‘পোসাইডন’। একে আদপে একটি টর্পেডো বলে ব্যাখ্যা করছেন পশ্চিমি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। দু’টি অস্ত্রেরই দ্রুত উৎপাদন যে ক্রেমলিন শুরু করতে চলেছে, তা একরকম স্পষ্ট করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
সামরিক হাসপাতাল চত্বরে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে পুতিন বলেন, ‘‘পোসাইডন ড্রোনটিকে একটি ডুবোজাহাজ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের ১০০ ভাগ ছোট আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বারা চালিত হয় এই স্বয়ংক্রিয় মনুষ্যবিহীন সাবমার্সিবল (ডুবো) যান।’’ এর পাশাপাশি আরও উন্নত সারমাট ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। রুশ প্রেসিডেন্টের পরমাণু অস্ত্রসম্ভার বৃদ্ধির জেরেই কি আতঙ্কিত হয়ে গণবিধ্বংসী হাতিয়ার পরীক্ষার নির্দেশ দিলেন ট্রাম্প? উঠছে প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট অবশ্য সরাসরি এর জবাব দেননি। ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ শুধু লিখেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অস্ত্রের পরীক্ষামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে ওই নির্দেশ দিতে হয়েছে তাঁকে। পরমাণু অস্ত্রের মারাত্মক ধ্বংসাত্মক শক্তির কারণে তিনি এগুলিকে ঘৃণা করেন। কিন্তু, তাঁর কাছে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। নিজের পোস্টে এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের যুক্তি, বর্তমানে পরমাণু অস্ত্রের শক্তির দিক থেকে প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হল যথাক্রমে রাশিয়া ও চিন। কিন্তু আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মস্কো ও বেজিং যৌথ ভাবে আণবিক অস্ত্রের নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। এ বছরের জুনে কোন দেশের হাতে কত পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, তার সংখ্যা প্রকাশ করে সুইডিশ প্রতিরক্ষা নজরদারি সংস্থা ‘স্টকহলোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ বা সিপ্রি। তারা অবশ্য এ ব্যাপারে ক্রেমলিনকে এগিয়ে রেখেছে।
গত ১৬ জুন বার্ষিক গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিপ্রি। সেখানে বলা হয়, ন’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আণবিক হাতিয়ার রয়েছে রাশিয়ার কাছে। দ্বিতীয় স্থানে আছে আমেরিকা। এই দুই দেশের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ৫,৪৫৯ এবং ৫,১৭৭। ট্রাম্প অবশ্য জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম মেয়াদে (২০১৭-’২১) মজুত থাকা আণবিক হাতিয়ারের নবীকরণ এবং তার সংস্কারে সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ অবশ্য এ ব্যাপারে আর কোনও তথ্য দেননি তিনি।
সুইডিশ প্রতিরক্ষা নজরদার সংস্থাটির দাবি, ২০২৪ সাল থেকে ধাপে ধাপে পরমাণু অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি করেছে ভারত। বর্তমানে নয়াদিল্লির ঝুলিতে রয়েছে ১৮০টি আণবিক হাতিয়ার। পাকিস্তান অবশ্য এই গণবিধ্বংসী হাতিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারেনি। ইসলামাবাদের অস্ত্রাগারে আছে ১৭০টি পরমাণু অস্ত্র। অন্য দিকে সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ আণবিক হাতিয়ার তৈরি করে ফেলেছে চিন, যা চিরশত্রু এই দুই প্রতিবেশীর তুলনায় অনেকটাই বেশি।
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর লস আলামোসে বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায় মার্কিন সামরিক গবেষকদল। এর নাম দেওয়া হয় ‘ট্রিনিটি টেস্ট’। সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাটি ছিল ওয়াশিংটনের গোপন ম্যানহাটন প্রকল্পের চূড়ান্ত পরিণতি। এর শীর্ষপদে ছিলেন বিজ্ঞানী রবার্ট জে ওপেনহাইমার। তাঁকে আণবিক বোমার জনক বলা হয়ে থাকে। এর পর ওই বছরের ৬ এবং ৯ অগস্ট জাপানের হিরোসিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলে আমেরিকা। এতে মৃত্যু হয় কয়েক লক্ষ মানুষের। এর মাধ্যমে শেষ হয়েছিল টানা ছ’বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-’৪৫)।
মার্কিন পরমাণু পরীক্ষার মাত্র চার বছরের মাথায় (পড়ুন ১৯৪৯) কাজ়াখস্তানে আণবিক বোমার সফল পরীক্ষা করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর পরই দু’তরফে তীব্র হয় ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ১৯৫২ সালে প্রথম থার্মোনিউক্লিয়ার বা হাইড্রোজ়েন বোমা নির্মাণের কথা দুনিয়াকে জানায় ওয়াশিংটন। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে এর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের নভেম্বরের মধ্যে একই রকমের পরীক্ষা করে সারা দুনিয়াকে চমকে দেন সোভিয়েত প্রতিরক্ষা গবেষকেরাও।
১৯৫৭ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় একটি সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম হয় ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’ বা আইএইএ-র (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি)। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বেসামরিক ক্ষেত্রে আণবিক শক্তির ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির গঠনের পরেও দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এর হাতিয়ারের প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। উল্টে ওই বছরই প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম-এর (ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) সফল পরীক্ষা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় মস্কো।
১৯৫৮-’৬০ সালের মধ্যে ঘন ঘন পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে থাকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই সময়সীমার মধ্যে আণবিক শক্তি অর্জন করে আরও দুই ইউরোপীয় দেশ। তারা হল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এর কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিবেশী কিউবায় মস্কোর পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র বিপুল সংখ্যায় মোতায়েন থাকার খবর ফাঁস করে মার্কিন গুপ্তচর বাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। এতে দু’তরফে ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইতিহাসে এটি ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট’ হিসাবে পরিচিত।
ওই সময়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে মস্কোর ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন থাকার খবর পেয়ে প্রমাদ গোনেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজ়েরাল্ড কেনেডি। তাঁর নির্দেশে দ্রুত কিউবা ঘিরে ফেলে আমেরিকার নৌসেনা। পাশাপাশি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর মারাত্মক কূটনৈতিক চাপ তৈরি করে ওয়াশিংটন। এর জেরে শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেয় ক্রেমলিন। সালটা ছিল ১৯৬২। এর এক বছরের মাথায় টেক্সাসের ডালাসে রহস্যজনক ভাবে গুলিতে খুন হন কেনেডি। প্রেসিডেন্টকে হত্যার অভিযোগে লি হার্ভে অসওয়াল নামের এক প্রাক্তন নৌসেনাকে গ্রেফতার করেছিল স্থানীয় প্রশাসন।
কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের পর পরমাণু পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু নিষেধাজ্ঞা চালু করতে রাজি হয় সোভিয়েত এবং মার্কিন সরকার। দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক হয়, বায়ুমণ্ডল, মহাকাশ এবং সমুদ্রের গভীরে আণবিক বিস্ফোরণ করবে না কোনও পক্ষ। তার পরেও গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে পরমাণু শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে চিন। ১৯৭৪ সালে প্রথম বার ভূগর্ভস্থ আণবিক পরীক্ষা চালায় ভারত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে হওয়া এর পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধ’।
১৯৯৮ সালে রাজস্থানের পোখরানে ফের এক বার পরমাণু বোমা ফাটায় নয়াদিল্লি। এর জেরে থার্মোনিউক্লিয়ার আণবিক শক্তি অর্জন করে এ দেশের বাহিনী। ওই বছরই আণবিক হাতিয়ার তৈরি করে ফেলে প্রতিবেশী পাকিস্তানও। ১৯৬৮ সালে অবশ্য ‘পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি’ বা এনপিটির (ননপ্রলিফারেশন অফ নিউক্লিয়ার ট্রিটি) মাধ্যমে এই উত্তেজনা থামানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু, তাতে ‘সুপার পাওয়ার’ দেশগুলির মধ্যে আণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা কমেছে এমন নয়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত এবং পাকিস্তান ছাড়াও এই গণবিধ্বংসী হাতিয়ার রয়েছে ইজ়রায়েল এবং উত্তর কোরিয়ার কাছে। সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটি নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হলে জার্মানি, ইটালি, তুরস্ক বা জাপানের মতো দেশ তা পাওয়ার জন্য ঝাঁপাতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নয়াদিল্লিকেও সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
সব ছবি: সংগৃহীত।