আর বহুমাত্রিক নয়। বরং দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এ বিভক্ত থাকুক বিশ্ব! ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা আরওকে-তে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে বৈঠকের পর এ বার সেই ইঙ্গিতই দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ইস্যুতে তাঁর করা পোস্ট সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে যায় শোরগোল। পৃথিবী দু’ভাগে ভেঙে গেলে কতটা বিপদের মুখে পড়বে ভারত, তাই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর শি-র সঙ্গে বৈঠক শেষে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘খুব শীঘ্রই মিলিত হবে জি২।’’ তাঁর ওই বক্তব্যের পর চিন নিয়ে ভিন্ন সুর শোনা গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সচিব (আগে নাম ছিল প্রতিরক্ষা সচিব) পিট হেগসেথের গলায়। বেজিংকে পুরোপুরি শত্রু হিসাবে দেগে দিতে চাননি তিনি। ফলে ট্রাম্প জমানায় আমেরিকার বিদেশনীতিতে বড় বদল আসতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ জি২ শব্দবন্ধ ব্যবহার করতেই এই নিয়ে প্রচারে নেমে পড়ে তাঁর সমর্থকদের একাংশ। সমাজমাধ্যমে অদ্ভুত ধরনের একটি বিশ্ব-মানচিত্র লাগাতার পোস্ট করছেন তাঁরা। সেখানে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ত্রিবিভক্ত দুনিয়াকে দেখানো হয়েছে। আর সেই তিনটি শক্তি হল আমেরিকা, চিন এবং রাশিয়া। এর জেরে ইউরোপীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
সমাজমাধ্যমে ঘুরতে থাকা মানচিত্রে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ওয়াশিংটনের হাতে থাকবে বলে দাবি করা হয়েছে। ডেনমার্কের স্বশাসিত ভূখণ্ড গ্রিনল্যান্ডকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন ট্রাম্প সমর্থকেরা। অর্থাৎ মানচিত্রের বাঁ দিকের সমস্ত দেশকে শাসন করবে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই লাল রঙে গোটা এলাকাটিকে চিহ্নিত করে তার উপরে লেখা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রিয় স্লোগান ‘মাগা’। এর অর্থ হল ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (আমেরিকাকে ফের মহান করুন)।
সংশ্লিষ্ট মানচিত্রে চিন নিয়ন্ত্রিত এলাকাটির নাম ‘শি-তাইপে’ দিয়েছেন ট্রাম্প সমর্থকেরা। এর আওতায় ভারতীয় উপমহাদেশ, দুই কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যাবতীয় এলাকা থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি, এর মাধ্যমে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার উপর বেজিঙের ‘প্রভুত্ব’ একরকম স্বীকার করে নিয়েছেন ট্রাম্প সমর্থকেরা।
মানচিত্রের তৃতীয় ভাগটি আরও অদ্ভুত। এর নাম ‘পুতিনস্তান’। মাগা-প্রেমীদের দাবি, আগামী দিনে সমগ্র পশ্চিম ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকা শাসন করবেন বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে নতুন করে কমিউনিস্ট শাসনও প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। আর তাই নীল রঙের ওই দেশগুলিকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি তার উপরে সমাজতান্ত্রিক দলের মূল প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ির চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন তাঁরা।
মাগা-প্রেমীরা ত্রিশক্তির কথা বললেও ট্রাম্প চাইছেন জি২ বা দুই ‘সুপার পাওয়ার’-এ বিভক্ত থাকুক বিশ্ব। আর তাই দক্ষিণ কোরিয়ায় জিনপিঙের সঙ্গে বৈঠকের সময় এক বারের জন্যও তাইওয়ানের প্রসঙ্গ তোলেননি তিনি। প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে দীর্ঘ দিন ধরেই কব্জা করার ছক কষছে বেজিং। এ ছাড়া রাশিয়ার থেকে তেল কেনা নিয়েও ড্রাগনভূমির উপর কোনও চাপ তৈরি করতে দেখা যায়নি তাঁকে।
ট্রাম্প-শি বৈঠকের পর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুরে ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশন্স’ বা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির সম্মেলনে যোগ দিয়ে চিনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডং জুনের কথা বলেন মার্কিন যুদ্ধ সচিব পিট হেগসেথ। পরে এ বিষয়ে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে বেজিং।’’
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনুমান, নতুন বিদেশনীতিতে শত্রুতার বদলে চিনকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চাইছেন ট্রাম্প। তবে তাঁকে এই অভিনব চিন্তার ‘জনক’ ভাবলে ভুল করা হবে। অতীতে বেজিঙের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক হুসেন ওবামা। বহু জায়গায় জি২-র ব্যাপারে কথা বলতে শোনা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু, তাতে লাভ তেমন হয়নি। ফলে পরবর্তী কালে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন তিনি।
ট্রাম্পের অবশ্য দাবি, তাঁর হাত ধরে সাফল্য পাবে জি২। কারণ, তাইওয়ান আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি নাকি তাঁকে দিয়েছেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি। এই ইস্যুতে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি বেজিং। ফলে নতুন বিদেশনীতির জেরে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলির ‘বন্ধুত্ব’ হারাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই ড্রাগনের রয়েছে সীমান্ত বিবাদ। ফলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় অস্থিরতা তৈরির ঝুঁকি বাড়ল বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ট্রাম্পের নতুন বিদেশ নীতির জেরে দ্রুত সামরিক শক্তিবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে পারে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। পাশাপাশি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে বড় বদল আসার আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে মাগা-প্রেমীদের তৈরি নতুন মানচিত্রের জেরে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে আমেরিকাকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে অবিশ্বাস। ফলে জি২-র জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে পারে।
২০১৭-’২১ সাল পর্যন্ত প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন চিনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ান ট্রাম্প। ওই সময় জি২ নিয়ে ওবামার বড় সমালোচক ছিলেন তিনি। কিন্তু, দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর সেখান থেকে সরে আসতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে শি জিনপিংকে আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। যদিও সেখানে হাজির ছিলেন না ড্রাগন রাষ্ট্রপতি। তবে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন তিনি।
এ বছরের জুনে জি৭-ভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকের আয়োজন করে কানাডা। সেখানে যোগ দিয়ে চিন সম্পর্কে বিস্ফোরক দাবি করে বসেন ট্রাম্প। বলেন, সংশ্লিষ্ট সংগঠনটিতে বেজিংকে সদস্যপদ দিতে কোনও আপত্তি নেই তাঁর। একসময় জি৭-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল রাশিয়া। কিন্তু, ২০১৪ সালে সামরিক অভিযান পাঠিয়ে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ মস্কো ছিনিয়ে নিলে পূর্ব ইউরোপের দেশটিকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ আবার জি২ তৈরি বা মাগা সমর্থকদের ত্রিবিভক্ত বিশ্ব মানচিত্রকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, সম্পূর্ণ ভাবে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উপর কর্তৃত্ব করা ওয়াশিংটনের পক্ষে অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে একের পর এক দেশ দখল করতে হবে ট্রাম্পকে। এর মধ্যে থাকবে কিউবা এবং ব্রাজ়িল। সোভিয়েত আমল থেকে এই দুই দেশের উপর রাশিয়ার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
একই কথা চিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বেজিঙের প্রভুত্ব ভারত, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি সহজে মেনে নেবে এই ধারণা কষ্টকল্পিত। এ ছাড়া মাগা সমর্থকদের ‘পুতিনস্তান’ পুরোপুরি কাল্পনিক। তাঁদের কেউ কেউ আবার এ ব্যাপারে আর একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করছে। সেটা হল ‘চিমেরিকা’। অর্থাৎ, চিন এবং আমেরিকার শাসন। এই নিয়ে উইকিপিডিয়ায় একটি পাতাও তৈরি করেছেন তাঁরা।
মাগা সমর্থকদের তৈরি করা বিশ্ব মানচিত্র অনুযায়ী, আগামী দিনে ইজ়রায়েলের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম এশিয়ার খনিজ তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলির দখলও চলে যাবে তাঁর হাতে। পাশাপাশি পাবেন পরমাণু শক্তিধর ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতো ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের নিয়ন্ত্রণ, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। আর তাই ওই মানচিত্রকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কেউই।
তবে মার্কিন-চিন সম্পর্কে জটিলতা কাটলে রক্তচাপ বাড়তে পারে ভারতের। যদিও কূটনীতিকদের মনে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁদের যুক্তি, আমেরিকা চাইছে ‘বিস্তারবাদী’ নীতি থেকে সরে আসুক বেজিং। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে লিখিত বা মৌখিক কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি ড্রাগন। ফলে ট্রাম্পের স্বপ্ন মাঠে মারা যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকছে।
যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্টের জি২ চিন্তাভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছে চিন। বেজিঙের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা যৌথ ভাবে দায়িত্ব পালন করব। বিশ্বের কল্যাণের জন্য মহান এবং সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তার জন্য একসঙ্গে পথ চলার ক্ষেত্রে আমাদের আপত্তি নেই।’’
গত শতাব্দীতে ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময় ভূ-রাজনৈতিক ভাবে দ্বিধাবিভক্ত ছিল পৃথিবী। এর এক দিকে ছিল সোভিয়েত ব্লক এবং অপর দিকে আমেরিকার জোট। এ-হেন জটিল পরিস্থিতিতে কোনও দিকে না গিয়ে ‘জোট নিরপেক্ষ’ গোষ্ঠী তৈরি করেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। তাতে ছিল মিশর এবং যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশ। ফলে ট্রাম্পের জি২-র চিন্তাভাবনা যে নয়াদিল্লি প্রত্যাখ্যান করবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সব ছবি: সংগৃহীত।