২৫ ডিসেম্বরেই পৃথিবীতে দেখা দেবে মহাপ্রলয়। আর তাতেই নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে মানবগ্রহ। সর্বগ্রাসী এক বন্যা এসে ডুবিয়ে দেবে মানবসভ্যতাকে। এমনই ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করে সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন স্বঘোষিত ধর্মগুরু। ভারতের নয়, সূদূর আফ্রিকার এক ছোট্ট দেশের বাসিন্দা এই ধর্মগুরু।
২০২৫-এর ২৫ ডিসেম্বর, অর্থাৎ বড়দিনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনটাই নাকি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন ঈশ্বরের থেকে। দাবি, আধুনিক যুগের ‘নোয়া’ বা ‘নূহ্’-এর। তিনি ঘানার বাসিন্দা ইবো এনোক। নিজেকে ‘ইবো জিসাস’ নামেও পরিচয় দেন তিনি। তাঁর বয়স ৩০। তিনি দাবি করেন, মহাপ্লাবন এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে জগৎসংসার। যদিও সেই ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়েছে। প্লাবন কেন, বড় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাসও মেলেনি ওই দিন।
পৃথিবীর শেষ সম্পর্কে ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ না ফললেও নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়তে রাজি নন ইবো। উল্টে জোর গলায় দাবি তুলেছেন পৃথিবী ধ্বংস হবেই। মহাপ্রলয় অবশ্যম্ভাবী, কেবলমাত্র তার বিলম্ব ঘটেছে। কারণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের তেমনটাই ইচ্ছে।
একটি অদ্ভুত পোশাক পরে হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিয়োয় মহাপ্রলয়ের বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে দেখা গিয়েছে ঘানার এই বাসিন্দাকে। তিনি জানান, ঈশ্বর তাঁকে কাজ শেষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। মহাপ্রলয়ের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় দিয়েছেন মাত্র।
প্রাচীন বিশ্বে এক ভয়াবহ প্লাবনের উল্লেখ রয়েছে বাইবেলে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ-বিদেশের পুরাণ, কাব্য, গল্পকথা ও লোককাহিনিতে রয়েছে এর উল্লেখ। সেই প্রলয়ে ডুবে যাবে সৃষ্টি। এমন অবস্থায় সৃষ্টিকর্তাই রক্ষা করবেন তাঁর সৃষ্টিকে। ঈশ্বরপ্রেরিত কোনও মানব (নোয়া বা নূহ্) তাঁরই নির্দেশে সেই সর্বনাশা প্লাবনের হাত থেকে ধরাধামকে রক্ষা করবেন।
এই অবস্থায় সৃষ্টিকে রক্ষা করতে পারে এক বিরাট জাহাজ। যেখানে সেই রক্ষাকর্তা, তাঁর পরিবার এবং একজোড়া করে প্রাণী (স্ত্রী ও পুরুষ) ঠাঁই পাবে। এ সবই তিনি ঈশ্বরের নির্দেশ মেনেই করবেন ইবো। সেই কাহিনি অনুসরণ করে ইবো ইতিমধ্যেই আটটি নৌকো তৈরি করার কাজ এগিয়ে রাখছেন।
‘বাইবেল’-এর ‘জেনেসিস’ অংশ থেকে জানা যায়, টানা ৪০ দিন ধরে প্রবল বর্ষণে এই মহাপ্লাবনের সৃষ্টি হয়েছিল। নোয়ার নৌকোয় আশ্রয়প্রাপ্ত মানুষ ও প্রাণীকুল ছাড়া বাদবাকি সব কিছুই এই প্লাবনে রসাতলে যায়। এমনকি সুবৃহৎ পর্বতশৃঙ্গগুলিরও সলিলসমাধি ঘটে।
ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রেও বিশেষ ভাবে উল্লেখ হয়েছে মহাপ্লাবনের। ‘যজুর্বেদ’-এর ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ মহাপ্লাবন ও তা থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করতে বিষ্ণুর মৎস্যাবতার রূপ ধারণের কথা বর্ণিত রয়েছে।
নতুন সহস্রাব্দেও চালু রয়েছে নোয়ার এই নৌকো নিয়ে উন্মাদনা। তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ ‘আধুনিক নোয়া’। ইবোর বিচিত্র কর্মকাণ্ড দেখতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। আসন্ন ‘মহাপ্রলয়’ থেকে প্রাণ বাঁচানোর আশায় কয়েক হাজার মানুষ শরণাপন্ন হয়েছেন ইবোর। ঘানার এই ধর্মপ্রচারক অবশ্য কাউকেই ফেরাননি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর জাহাজে সকলেই স্বাগত।
ইবোর অনুসারীদের মধ্যে লাইবেরিয়ার এক ব্যক্তিও রয়েছেন। নৌকোয় আসন সুনিশ্চিত করতে গিয়ে তিনি ঘানার মধ্যভাগের শহর এলমিনাতে আটকে পড়েছেন। পরবর্তী কালে কী হবে তা নিয়ে নিশ্চিত নন। একটি ভিডিয়োয় তাঁকে মুহ্যমান অবস্থায় দেখা গিয়েছে।
ঘানার এই স্বঘোষিত ধর্মপ্রচারকের আরও একটি পেশা রয়েছে। তিনি পুরোদস্তুর বিষয়স্রষ্টা। ইনস্টাগ্রামে তাঁর ৫০ হাজার অনুগামী রয়েছেন। ইউটিউব চ্যানেলটিতেও কয়েক হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছেন। ইবোর মহাপ্রলয় সংক্রান্ত ঘোষণা ও ভিডিয়োগুলি দেখে সেই উন্মাদনা সংক্রামিত হয়েছে অনুরাগীদের মধ্যেও।
অগস্ট মাসে ‘কী হবে এবং কী ভাবে হবে’ শিরোনামের একটি ইউটিউব ভিডিয়ো শেয়ার করেন ইবো। ইবো দাবি তোলেন, ঈশ্বরের কাছ থেকে তিনি একটি বার্তা পেয়েছেন। একটি স্বপ্ন দেখেছেন তিনি, যেখানে ২৫ ডিসেম্বর থেকে অবিরাম বৃষ্টিপাত শুরু হবে এবং তিন বছর ধরে একটানা চলবে।
ইবোর দাবি, আর্তদের বাঁচাতে তাঁকে জাহাজ তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। বেশ কয়েকটি ভিডিয়োয় ইবোকে নৌকো তৈরির তদারক করতেও দেখা গিয়েছে। তিনি বার বার দাবি করেছিলেন যে, তিনি ইতিমধ্যেই মহাপ্রলয় থেকে তাঁর অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য জাহাজ তৈরি করেছেন।
ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই নানা সংবাদমাধ্যমে দাবি উঠেছে যে, ইবো জাহাজ তৈরির অনুদান নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ৮৯,০০০ ডলার (প্রায় ৭৯ লক্ষ টাকা) মূল্যের একটি মার্সেডিজ় গাড়ি কিনেছেন। সেই বিদেশি দামি গাড়িতে চড়ার ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। যে সব ভক্ত তাঁকে বিশ্বাস করে সর্বস্ব বিক্রি করে অনুদান দিয়েছেন তাঁরাও সেই ছবি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছেন। প্রতারিত বোধ করছেন অনেকেই।
এক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে জাহাজের কাছে এসে উপস্থিত হন। ২৫ তারিখে কোনও ঘটনা না ঘটায় তিনি রেগে যান। প্রতারিত বোধ করেন। হতাশায় একটি নৌকোর কাঠামোয় আগুন ধরিয়ে দেন বলে অভিযোগ। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন যে জাহাজটি ‘নোয়ার নৌকো’ নয়। ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন।
ইবোর দাবি, তিনি কখনও টিকিট বিক্রি করেননি বা অনুগামীদের কাছে কোনও টাকা চাননি। তবে তাঁর গাড়ি চড়ার ভিডিয়ো দেখে অনেকেই ইবোর টাকাপয়সা সংক্রান্ত দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ঘানার বেশ কয়েকটি অংশে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে অনেকেই মহাপ্লাবনের দাবিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন।
প্রায় প্রতিটি সভ্যতাতেই মহাপ্লাবনের বর্ণনা থাকায় অনেকেই মনে করেন, অতি প্রাচীন কালে সত্যিই মহাপ্লাবন ঘটেছিল। এক মহাপ্লাবনে সৃষ্টি মুছে গিয়েছিল বলে উল্লেখ। আবার কি এক মহাপ্লাবন ঘটতে পারে? ধর্মতাত্ত্বিক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে ভেবে চলেছেন।
সব ছবি:সংগৃহীত।