ব্রিটেনের পর এ বার ফ্রান্স। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিল আর এক পরমাণু শক্তিধর দেশ। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে ৩২টি রাষ্ট্রের ইউরোপীয় মার্কিন শক্তি জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) সঙ্গে তীব্র হচ্ছে মস্কোর মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
সম্প্রতি দেশের সমস্ত হাসপাতালগুলির জন্য একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে ফরাসি সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৬) মার্চের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে যাবতীয় হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি সৈনিকদেরও চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তিটিতে উল্লেখ রয়েছে।
ফরাসি স্বাস্থ্য মন্ত্রকের জারি করা এ-হেন নির্দেশিকার খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই। কূটনৈতিক মহলের জল্পনা, আগামী বছরের মধ্যেই নেটো বনাম রাশিয়ার যুদ্ধে রক্তাক্ত হবে ইউরোপ। মস্কো-বিরোধী জোটটির অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল ফ্রান্স। আর তাই আসন্ন লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে তার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। এ ব্যাপারে ব্রিটেন এবং জার্মানির পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন তিনি। তবে চুপ করে বসে নেই ক্রেমলিনও।
মাকরঁ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিশেষ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফরাসি ব্যঙ্গাত্মক সংবাদপত্র ‘লে ক্যানার্ড এনচাইনে’। তাদের দাবি, দেশের যাবতীয় হাসপাতালকে ১০ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে কয়েক হাজার সৈনিকের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাস টার্মিনাস, বড় রেলস্টেশন, বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরের কাছে নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করবে প্রশাসন। মূলত যুদ্ধে আহত বিদেশি সৈনিকদের সেখানে ভর্তি করা হবে।
হঠাৎ কেন এই ধরনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হল? এ বিষয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ফরাসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্যাথরিন ভাউট্রিন। তাঁর কথায়, ‘‘আসন্ন সঙ্কট এবং তার পরিণতির পূর্বাভাস থাকায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগাড় করা মোটেই সহজ নয়। তাই কৌশলগত মজুতের দিকে নজর দিচ্ছি আমরা।’’ এর পরই কোভিড অতিমারির উদাহরণ টানেন তিনি। তবে সরাসরি যুদ্ধের কথা বলেননি ক্যাথরিন।
ক্যাথরিন বলেন, ‘‘২০২০-’২১ সালে যখন কোভিড অতিমারি চলছিল, তখন আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলাম না। কিন্তু, ভুলে গেলে চলবে না যে ওই সময় আমরা কতটা অপ্রস্তুত ছিলাম। সেটা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ফলে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বহু সহ-নাগরিককে হারাতে হয়েছে। এ বার আর সেই ভুল করতে চাই না। যে কোনও অবস্থায় যাতে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে প্রশাসন।’’
চলতি বছরে ‘বেঁচে থাকার নির্দেশিকা’ শীর্ষক একটি প্রচারপুস্তিকা আমজনতার মধ্যে বিলি করে ফরাসি সরকার। ২০ পাতার ওই বইয়ে যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য জরুরি অবস্থায় কী কী করণীয়, সেই সংক্রান্ত ৬৩টি উপায়ের কথা বলা রয়েছে। এ ছাড়া সেখানে আছে জল, টিনজাত খাবার, ব্যাটারি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সব সময়ে হাতের কাছে মজুত রাখার নির্দেশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সাড়ে তিন বছর আগে সংশ্লিষ্ট প্রচারপুস্তিকাটি তৈরির কাজে হাত লাগায় মাকরঁ সরকার।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালিয়ে যাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর নির্দেশে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই নাগরিকদের সতর্ক করতে প্রচারপুস্তিকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ফরাসি প্রশাসন। যদিও ওই সংঘাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের কোনও সম্পর্ক নেই বলে বার বার দাবি করেছে প্যারিস। মাকরঁ সরকারের যুক্তি, প্রচারপুস্তিকাটিতে মস্কোর আগ্রাসনের কোনও উল্লেখ নেই। কিছু আপৎকালীন পরিস্থিতির কথা বলা রয়েছে মাত্র।
হাসপাতাল সংক্রান্ত নির্দেশিকার পাশাপাশি নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সঙ্কটের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে আর একটি প্রচারপুস্তিকা তৈরি করেছে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক জেনারেল সেক্রেটারিয়েট। সেখানে কী ভাবে পারমাণবিক আক্রমণের মোকাবিলা করতে হবে, তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, দেশের যুবসমাজকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহ্বানও রয়েছে সেখানে।
বিশ্লেষকদের দাবি, মাকরঁ সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপগুলি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় আকারের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ফ্রান্স। চলতি আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দু’শতাংশ বৃদ্ধি করেছে পশ্চিম ইউরোপের ওই দেশ। এ ছাড়া মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) তিন থেকে সাড়ে তিন শতাংশ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
গত অগস্টে একটি সাক্ষাৎকারে নাম না করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন মাকরঁ। বলেন, ‘‘ইউরোপের দরজায় একটা রাক্ষস দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে সে একটার পর একটা জমি গিলে চলেছে। সেই যন্ত্রণা জর্জিয়া এবং ইউক্রেনবাসীরা ভালই টের পাচ্ছেন।’’ এর পরই ফরাসি প্রেসিডেন্টকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেয় মস্কো। যদিও ক্রেমলিনের ওই কড়া প্রতিক্রিয়া গায়ে মাখেননি মাকরঁ।
অন্য দিকে, ফ্রান্সের মতো রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ব্রিটেনও। সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম এক ডজন যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। সাবেক ব্রিটিশ সেনাপ্রধান জেনারেল প্যাট্রিক স্যান্ডার্সের দাবি, ২০৩০ সাল নাগাদ মস্কোর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াবে আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্র। তার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে বলেছেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়া থেকেই কিভকে হাতিয়ার সরবরাহ করে এসেছে আমেরিকা। এ বছরের গোড়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর তাতে কিছুটা হ্রাস টানে যুক্তরাষ্ট্র। অগস্টে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, পোল্যান্ড-সহ ইউরোপীয় রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে ঠিক হয়, নেটোকে বিপুল অঙ্কের হাতিয়ার বিক্রি করবে ওয়াশিংটন, যার পুরো অর্থ দেবে পশ্চিম ইউরোপ।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, ইউরোপের যুদ্ধে সরাসরি জড়াতে চাইছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে হাতিয়ার বিক্রি করে লড়াইয়ে উস্কানি দেওয়ার ক্ষেত্রে একেবারেই পিছিয়ে নেই ট্রাম্প। এতে সংঘর্ষের যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে মোটা মুনাফার সুযোগ পাবে যুক্তরাষ্ট্র। এ ভাবেই রুশ পরমাণু হামলার আশঙ্কা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে ওয়াশিংটন।
পশ্চিমি দেশগুলির এই জোটের বিরুদ্ধে নতুন অক্ষ তৈরিতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছেন পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধে ইতিমধ্যেই সরাসরি সৈনিক এবং গোলা-বারুদ দিয়ে রাশিয়াকে সাহায্য করেছে ‘ডেমোক্রেটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকে (পড়ুন উত্তর কোরিয়া)। এ ছাড়াও মস্কোর পাশে আছে চিন ও ইরানের মতো রাষ্ট্র।
পাশাপাশি, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট নেটোতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। আর তাই তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছে পুতিন প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর মতো অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আঙ্কারাকে সরবরাহ করেছে মস্কো। ফলে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’টিকে নিয়ে নেটোভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের মনে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপের রাশিয়া আক্রমণের প্রস্তুতির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৮১২ সালের ২৪ জুন মস্কো আক্রমণ করেন কিংবদন্তি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। তাঁর সঙ্গে ছিল অজেয় ‘গ্র্যান্ড আর্মি’। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের দেশটি থেকে খালি হাতেই প্যারিসে ফিরতে হয় তাঁকে। ওই যুদ্ধে তাঁর ‘গ্র্যান্ড আর্মি’ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যা পরবর্তী কালে নেপোলিয়ানের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নেপোলিয়ানের রুশ অভিযানের ১২৯ বছরের মাথায় অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসেন নাৎসি জার্মানির ‘ফুয়েরার’ অ্যাডল্ফ হিটলার। ১৯৪১ সালের ২২ জুন শুরু হওয়া সেই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন বারবারোসা’। কিন্তু, সে বারও পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল বিদ্যুৎগতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করা জার্মান কমান্ডারদের। এর পর হিটলারের পতন হতে বেশি সময় লাগেনি।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে গেলে আসন্ন সংঘাতের সব হিসাবে উল্টে যেতে পারে। গত ১৫ অগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় এ ব্যাপারে পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ট্রাম্প। কিছু দিনের মধ্যেই ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কিকে নিয়ে মস্কোয় ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করার কথা ছিল তাঁর। যদিও তা ভেস্তে গিয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে ভারতের পক্ষে পরিস্থিতি যে জটিল হবে, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, দু’টি দেশের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে নয়াদিল্লির। আর তাই ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কো-অপারেটিভ অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ ব্যাপারে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বলেছেন, ‘‘দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে রাশিয়া এবং ইউক্রেন পদক্ষেপ করবে বলে আমি আশাবাদী।’’
সব ছবি: সংগৃহীত।