কথায় বলে ‘আনলাকি থার্টিন’। ১৩ সংখ্যাটা নাকি দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। পশ্চিমি সংস্কৃতিতে এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। ভারতীয়দের মধ্যেও ১৩কে অশুভ বলে মনে করার প্রবণতা নেহাত কম নয়। যদিও প্রাচ্যমতে ১৩ সংখ্যাটি মোটেই দুর্ভাগ্যের নয়। কিন্তু সত্যিই কি ১৩ দুর্ভাগ্য বয়ে আনে? ত্রয়োদশ সংখ্যাটির সঙ্গে কিন্তু বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনার যোগসাজশ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তিন জন বিশ্ববরেণ্য বাঙালির নাম।
১৩-র কথা বললে প্রথমেই আসবে ইতালির রেনেসাঁ যুগের কিংবদন্তি শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কথা। তাঁর জগদ্বিখ্যাত তৈলচিত্রগুলির অন্যতম হল ‘দ্য লাস্ট সাপার’। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে একটি সরাইখানায় শিষ্যদের নিয়ে শেষ নৈশভোজ সারছেন খ্রিস্টধর্মের প্রচারক যিশু— তুলির টানে ক্যানভাসে সেটাই ফুটিয়ে তোলেন চিত্রকর দ্য ভিঞ্চি। ছবিতে যিশু-সহ রয়েছেন মোট ১৩ জন। ইতিহাসবিদদের দাবি, ১৪৯৫ থেকে ১৪৯৮ সালের মধ্যে তিন বছরের চেষ্টায় তৈলচিত্রটি আঁকেন দ্য ভিঞ্চি।
১৩ সংখ্যাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ব্রিটেনের থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে আমেরিকা ছিল আটলান্টিকের পারের ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশ। স্বাধীনতা পেতে অবশ্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও সাতটা বছর। এই সময়ের মধ্যে ব্রিটেনের সঙ্গে চলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। শেষে ১৭৮৩ সালে প্যারিসের চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজ উপনিবেশিকতায় দাঁড়ি পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে।
১৮৪৪ সালে প্রকাশিত হয় ফরাসি সাহিত্যিক আলেকজান্ডার ডুমার কালজয়ী উপন্যাস ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। গল্পে যে ফরাসি রাজার উল্লেখ রয়েছে, তিনি ত্রয়োদশ লুই। তাঁরই দেহরক্ষী রাজভক্ত তিন মাস্কেটিয়ার্স তথা অ্যাথোস, পোর্থোস এবং অ্যারামিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে কাহিনি। ডুমার উপন্যাসটির পটভূমি ছিল ১৬২৫ সাল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বাস্তবের ত্রয়োদশ লুই ১৬১০ থেকে ১৬৪৩ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের সিংহাসনে ছিলেন।
বিশ্বের চলচ্চিত্রজগতের অন্যতম বড় নাম অ্যালফ্রেড জোসেফ হিচকক। খাঁটি ইংরেজ এই চিত্রপরিচালক তাঁর ছ’দশকের বেশি কর্মজীবনে মোট ৫০টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি পরিচালনা করেন। তবে সিনে জগতে তাঁকে সকলেই চেনেন ‘সাসপেন্স মাস্টার’ হিসাবে। হিচকক পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি ৪৬ বার অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিল। এর মধ্যে পুরস্কার জেতে ছ’বার। যদিও কখনওই সেরা পরিচালকের পুরস্কার জেতেননি তিনি। এ হেন হিচককের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালের ১৩ অগস্ট।
১৩ সংখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। সেই খবর যখন তাঁর জন্মভিটে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছোয়, তখন তিনি শান্তিনিকেতনে। পরে অবশ্য পুরস্কার নিতে ইউরোপ পাড়ি দেন কবিগুরু। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম নোবেলজয়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ঠিক ওই বছরই (পড়ুন ১৯১৩ সাল) দাদাসাহেব ফালকের হাত ধরে জন্ম হয় ভারতীয় সিনেমার। তৎকালীন বম্বেতে (অধুনা মুম্বই) মুক্তি পায় তাঁর তৈরি নির্বাক ছায়াছবি ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। সিনেমাটিতে মোট তিনটি ভাষায় আন্তঃশিরোনাম ছিল। সেগুলি হল ইংরেজি, মরাঠি এবং হিন্দি।
১৯৩০ সালে শুরু হয় ফিফা বিশ্বকাপ। তখন অবশ্য মেয়েদের ফুটবলের প্রচলন হয়নি। প্রথম বারেই এই মেগা টুর্নামেন্ট দর্শকের মন জিতে নেয়। ওই সময় বিশ্বকাপ ট্রফির নাম অবশ্য ছিল জুলে রিমে কাপ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে আয়োজন করেছিল এই প্রতিযোগিতার। অত্যাশ্চর্য বিষয় হল, সে বার বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ১৩টি দেশ। ১৩ জুলাই হয়েছিল উদ্বোধনী ম্যাচ। ফাইনালে আর্জেন্তিনাকে হারিয়ে ট্রফি ঘরে তোলে আয়োজক দেশ উরুগুয়ে।
পুরুষদের ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজ়িলের উত্থান ১৯৫৮ সালে। সে বার জুলে রিমে কাপের আয়োজক দেশ ছিল সুইডেন। প্রতিযোগিতায় আবির্ভাব ঘটে ফুটবল সম্রাট পেলের। ট্রফি নিয়েই দেশে ফেরেন তিনি। কিন্তু, প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক গোল করে রেকর্ড ছিল ফরাসি স্ট্রাইকার জাস্ট ফন্টেইনের। বিপক্ষের জালে মোট ১৩ বার বল জড়িয়ে দেন তিনি। এখনও পর্যন্ত আর কোনও খেলোয়াড় একটি বিশ্বকাপে এতগুলি গোল করতে পারেননি।
১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট অধিনায়ক ছিলেন একজন পার্সি খেলোয়াড়। নাম নরিম্যান জামশেদজি কন্ট্রাক্টর। তবে তিনি পরিচিত ছিলেন নরি কন্ট্রাক্টর নামে। মোট ১২টি টেস্টের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে আটটিতে ড্র করে ভারত। বাকি চারটির মধ্যে দু’টিতে জয় আর দু’টিতে হার। এ হেন নরি ছিলেন ভারতীয় টেস্ট দলের ত্রয়োদশ অধিনায়ক।
১৯৬২ সালে বার্বাডোজ়ের সঙ্গে ম্যাচ খেলার সময় চার্লি গ্রিফিথের বলে মাথায় আঘাত পান নরি। অচৈতন্য অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সাবেক ভারত অধিনায়কের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিয়ে তাঁর প্রাণ বাঁচান ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের কিংবদন্তি অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেল। সুস্থ হলেও আর কোনও দিনই মাঠে ফিরতে পারেননি নরি।
তবে ত্রয়োদশ ভারত অধিনায়কের আঘাত বদলে দেয় ক্রিকেটের অনেক নিয়ম। বোলারদের বাউন্সার দেওয়ার ক্ষেত্রে আসে বিধিনিষেধ। নরি যখন খেলতেন তখন ছিল না হেলমেট। পরবর্তী দশকগুলিতে সেই নিয়ে গবেষণায় লেগে পড়েন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা। ফলে আমূল বদলে যায় ব্যাট-বলের লড়াই।
স্বাধীন ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক ছিলেন সুকুমার সেন। ১৯৫১-৫২ এবং ১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচন দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন তিনি। এক কথায় এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) এই প্রাক্তনী সুদানের সাধারণ নির্বাচনও পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৬৩ সালের ১৩ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্রিটিশ যুগের আমলা তথা আইসিএস সুকুমার।
১৩-র অশুভ প্রকোপ সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয়েছে পাকিস্তানকে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের হাতে পর্যুদস্ত হয় ইসলামাবাদ। দেশটির পূর্ব দিকের অংশ ভেঙে তৈরি হয় নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। পাশাপাশি ৯৩ হাজার সৈনিক নয়াদিল্লির বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছিল এই যুদ্ধ, অর্থাৎ স্থায়িত্ব ছিল ১৩ দিন।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে মহাকরণ অভিযান করেন তৎকালীন যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জনবিক্ষোভ সামাল দিতে গুলি চালায় পুলিশ। তাতে প্রাণ হারান ১৩ জন। ওই ঘটনাকে মনে রেখে প্রতি বছর শহিদ দিবস পালন করেন সে দিনের আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৯৬ সালে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি পান বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু মাত্র ১৩ দিনের মাথায় পতন হয় সেই সরকারের। এর পর ১৯৯৮ সালে ফের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন বাজপেয়ী। সে বারও ১৩ মাসের বেশি সরকার চালাতে পারেননি তিনি। ১৯৯৯ সালে ফের জনতার রায়ে ক্ষমতায় ফেরেন অটল। এ বার অবশ্য ২০০৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর সরকার চালাতে পেরেছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পর থেকে মোট ১৫ জন রাষ্ট্রপতি পেয়েছে ভারত। তার মধ্যে ত্রয়োদশ ব্যক্তি ছিলেন একজন বঙ্গসন্তান। নাম, প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে অর্থ, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বও সামলেছিলেন। ছিলেন সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার নেতাও।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১৩ বছর ধরে চলা সিরিয়ার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। মাত্র ১২ দিনে রাজধানী দামাস্কাস দখল করে দুই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনী। ফলে দেশ ছেড়ে চম্পট দেন প্রেসিডেন্ট বাশার-অল-আসাদ। প্রাণ বাঁচাতে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
সব ছবি: সংগৃহীত।