ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার, লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ— আরও কত ছবি! সব ক’টি ছবি দেখলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে কোনও বিখ্যাত আলোকচিত্রী তুলেছেন। লাইট, কোণ, ফ্রেমের মাপ চাক্ষুষ করার পরে যেন ছবিগুলি তোলা। তবে জানলে অবাক হবেন সেই সব ছবিই তুলেছেন এক দৃষ্টিহীন আলোকচিত্রী।
সব ছবি: সংগৃহীত।
তিনি প্রণব লাল। জন্মান্ধ তিনি। রেটিনোপ্যাথিতে ভুগছেন। জন্ম থেকেই তাঁর এই সমস্যা। অনেক চিকিৎসা করেও দেখতে পারেননি পৃথিবীর সৌন্দর্য।
তবুও থেমে থাকেননি। প্রণবের অভিধানে ‘অসম্ভব’ বলে কোনও শব্দ নেই। দিল্লির এই তরুণ পেশায় এক জন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন নিত্য দিন।
কিশোর বয়সে যখন পরিবার, বন্ধু সকলেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তখনও নিজের উপর আস্থা রেখেছিলেন প্রণব। বিশেষ কিছু করার ইচ্ছে বরাবরই ছিল তাঁর।
ছবি তুলতে চাইতেন প্রণব। পৃথিবীর প্রতিটি কোণের ছবি ক্যামেরাবন্দি করে রাখার শখ ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু কী ভাবে নিজের শখ পূরণ করবেন? দেখতেই তো পান না। কোথায় ফ্রেম, কেমন আলো রয়েছে, ক্যামেরার লেন্স থেকে কোণ মেপে কী ভাবে ছবি উঠবে কিছুই চোখে দেখা সম্ভব নয় তাঁর।
দৃষ্টিহীন হওয়ার কারণে এমনটা কার্যত অসম্ভব জেনেও মরে যায়নি ইচ্ছেশক্তি। কোন প্রযুক্তি দ্বারা তাঁর এই শখ পূরণ হতে পারে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যান।
এর পরই প্রণবের পরিচয় হয় এক অনন্য সফ্টঅয়্যারের সঙ্গে, যা দিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল ছবি তোলা সম্ভব। সফ্টঅয়্যারটির নাম ‘দ্য ভয়েস’। এটি কোনও সাধারণ সফ্টঅয়্যার নয়, এ এক বিকল্প প্রযুক্তি।
শ্রবণশক্তি ব্যবহার করে দুনিয়াকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় ‘দ্য ভয়েস’-এর সাহায্যে। ছবির প্রতিটি রেখা, উজ্জ্বলতা, উচ্চতা সব কিছুই আলাদা আলাদা সুরে বাজতে থাকে। এর সাহায্যে শব্দের মাধ্যমে ছবি তোলা যায়।
অর্থাৎ যে জায়গার ছবি তোলা হবে সেখানে কেমন পরিবেশ রয়েছে, কতটা উচ্চতা নিয়ে বিস্তৃত জায়গাটি, আলো কতটা আছে— সেই সব কিছুই বলে দেবে প্রযুক্তি। তা শুনে অনায়াসে ওই জায়গার প্রতি একটি ধারণা এসে যাবে আলোকচিত্রীর। তখন সহজেই সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি করা যাবে।
তবে এই পদ্ধতি একজন সাধারণ মানুষ খুব সহজে বুঝে ফেললেও প্রণবের কাছে এটা বেশ কঠিন ছিল। শুরুতে সফ্টঅয়্যারটি কী ভাবে কাজ করে, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি।
তবুও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। বেশ কিছু বছর গিয়েছিল শুধু সফ্টঅয়্যারটির কাজ বুঝতে। অবশেষে তিনি শিখলেন কী ভাবে শব্দকে ছবির ভাষায় অনুবাদ করতে হয়।
শুরুর দিকে ঘরের দেওয়াল, দরজা, মানুষের ছবি তুলতে থাকেন। ধীরে ধীরে সব কিছু শব্দের সঙ্গে স্পষ্ট হতে শুরু করে। যত সময় যেতে থাকে বুঝতে থাকেন ফ্রেমিং, আলো, দৃষ্টিকোণ।
এক জন দক্ষ আলোকচিত্রী হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন হয়, সে সবই হাতের মুঠোয় চলে এল প্রণবের। আজ প্রণব সাইবার নিরাপত্তা আধিকারিকের চেয়েও নামী এক আলোকচিত্রী।
বিশ্ব জুড়ে নানা জায়গার ছবি লেন্সবন্দি করেছেন। শুরুতে কেউ বিশ্বাস করেননি প্রণবকে। সকলেরই মনে হত অন্য কেউ ছবিগুলি তুলে দিয়েছেন। কিন্তু যত সময় গিয়েছে, প্রণব প্রমাণ করেছেন এ দুনিয়ায় অসম্ভব বলে কিছু নেই।
ইচ্ছেশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমই যে সাফল্য এনে দিতে পারে, তার প্রমাণ প্রণব। একটি সাক্ষাৎকারে প্রণব বলেছেন, “আমি স্পর্শ না করেই আমার সামনে থাকা বস্তুটির আকার, সীমানা এবং পরিধি বুঝতে পারি। আমার কাছে ক্যামেরা কোন ব্র্যান্ডের বা তা কী ধরনের তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যত ক্ষণ তা অটো-ফোকাসে থাকবে, আমি ছবি তুলব।’’
প্রণবের ক্যামেরায় লেন্সবন্দি হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তের পাহাড়, সমুদ্র, রাস্তার ছবি। এমনকি তিনি আইসল্যান্ডে বিখ্যাত মেরুপ্রভার ছবি তুলেও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
স্বপ্নপূরণের তাগিদে বহু প্রতিকূলতা পেরোতে হয়েছে তাঁকে। নতুন শহরে পথ চলতে নানা বাধা এসেছে, বিমানবন্দরে বেশ কয়েক বার হেনস্থার শিকার হয়েছেন। তবুও এগিয়ে গিয়েছেন।
আজ প্রণব একজন নামজাদা আলোকচিত্রী। ঝুলিতে রয়েছে বেশ কিছু পুরস্কার। আন্তর্জাতিক স্তরে নানা সেমিনারে তাঁর কাজ প্রদর্শিত হয়। প্রণব প্রমাণ করেছেন কোনও প্রতিবন্ধকতাই জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না। চেষ্টা থাকলে সব সম্ভব।