শুল্ক সংঘাতকে কেন্দ্র করে ফের ভারত-মার্কিন চাপানউতর। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ বার ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ বা ডব্লিউটিও-য় (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন) নালিশ ঠুকল নয়াদিল্লি। এর জেরে দু’তরফের বাণিজ্যচুক্তি ‘বিশ বাঁও জলে’ পড়ার রয়েছে প্রবল আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সংগঠনটি কতটা ইতিবাচক পদক্ষেপ করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
ভারত-মার্কিন শুল্কযুদ্ধের নতুন সমস্যার নাম তামা। নয়াদিল্লির অভিযোগ, ডব্লিউটিও-র নিয়ম ভেঙে সংশ্লিষ্ট ধাতুটির আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর নিচ্ছে আমেরিকা। এর জেরে বিপুল লোকসানের মুখে পড়ছেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। আর তাই পরিস্থিতির বদল না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রীতে অতিরিক্ত শুল্ক চাপাতে বাধ্য হবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই মর্মে ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’কে ক্ষোভের কথা জানিয়েছে নয়াদিল্লি।
ওয়াশিংটন অবশ্য ভারতের এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নয়াদিল্লির থেকে আমদানি করা পণ্যে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ডব্লিউটিও-তে অবশ্য আমেরিকার এ-হেন ‘মিথ্যাচার’-এর পাল্টা জবাব দিয়েছে নয়াদিল্লি। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তাকে ঢাল করে আসল বিষয় ধামাচাপা দিতে চাইছে মার্কিন প্রশাসন। ঘরোয়া খনিজ ব্যবসায়ীদের ‘নিরাপত্তার ব্যবস্থা’ করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট অভিযোগপত্রটি ডব্লিউটিও দফতরে পাঠায় নয়াদিল্লির বাণিজ্য মন্ত্রক। সেখানে কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারত থেকে ১৮ কোটি ২৫ লক্ষ ৪০ হাজার ডলার মূল্যের তামা আমদানি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদেরই চাপানো অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্কের জন্য এতে লোকসানের অঙ্ক বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮ কোটি ৭৮ লক্ষ ২০ হাজার ডলার। এই অবস্থায় আমেরিকা পদক্ষেপ না করলে ওই মূল্যের পণ্যের উপর সমপর্যায়ের শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছে মোদী সরকার।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, কেন্দ্র শেষ পর্যন্ত ওই পদক্ষেপ করলে ভারতের বাজারে ৮.৭৮ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য বিক্রি করা আমেরিকার পক্ষে বেশ কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য তার পরেও নিজেদের অবস্থানে অনড়। ডব্লিউটিও-র নিয়মের পরোয়া করছে না তারা। আন্তর্জাতিক সংগঠনটির আইনে বলা হয়েছে, একই পণ্যে দেশভেদে আলাদা আলাদা শুল্ক চাপাতে পারবে না কোনও রাষ্ট্র। কারণ, তা হলে কখনওই মেটানো যাবে না বাণিজ্যিক ঘাটতি।
ভারতের অভিযোগের জবাব দিতে গত ৬ নভেম্বর ডব্লিউটিও-তে চিঠি পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। সেখানে ওয়াশিংটন বলেছে, ‘‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৩২ নম্বর ধারা মেনে নয়াদিল্লির থেকে আমদানি করা তামা এবং তাম্রপণ্যে শুল্ক চাপিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা একটা হুমকি তৈরি করছিল। আর তাই ডব্লিউটিওর ৮.২ নম্বর ধারার অধীনে ভারত যে সুরক্ষা বা সুবিধা পেতে চাইছে, তার কোনও ভিত্তি নেই।’’
গত ৩০ জুলাই আমদানি করা তাম্রপণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ১ অগস্ট থেকে তা প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। সংশ্লিষ্ট ধাতুটির ক্ষেত্রে কত দিন পর্যন্ত এই পরিমাণ আমদানি শুল্ক বজায় থাকবে, তা পরিষ্কার নয়। ফলে আমেরিকার বাজারে তামা বা তাম্রপণ্য সরবরাহ করতে গেলে বেশি খরচ হচ্ছে এ দেশের ব্যবসায়ীদের।
ভারত ছাড়াও চিলি, কানাডা এবং মেক্সিকো থেকে বিপুল পরিমাণে তামা আমদানি করে ওয়াশিংটন। রক্তিম বর্ণের ধাতুটিকে শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্যতম ‘কৌশলগত’ উপাদান বলা যেতে পারে। বিদ্যুৎ পরিবহণ, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকল) এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, মূলত শেষেরটিকে সামনে রেখে নয়াদিল্লির উপর শুল্কের চাপ বজায় রাখতে চাইছে আমেরিকা।
তামা ছাড়াও ইস্পাত এবং গাড়ি নির্মাণের সরঞ্জামের উপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি সেটা নিয়েও ডব্লিউটিও-তে অভিযোগ দায়ের করে রেখেছে নয়াদিল্লি। তবে অতীতে শুল্কের নেপথ্যে জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি দেওয়া কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তেমন কোনও কড়া পদক্ষেপ কখনওই নিতে পারেনি ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’। এ ক্ষেত্রেও ফের এক বার সেই ছবি দেখতে পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি ঘোষণা করেন তিনি। অর্থাৎ কোনও দেশ আমেরিকার পণ্যে যতটা কর নেবে, তার সামগ্রীতেও ঠিক তত পরিমাণ শুল্ক আরোপ করবে মার্কিন প্রশাসন। সেই হিসাবে ভারতীয় পণ্যে ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ওয়াশিংটন। পরে অবশ্য রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কেনার ‘শাস্তি’ হিসাবে শুল্কের অঙ্ক বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করে দেন ট্রাম্প।
পারস্পরিক শুল্কনীতি ঘোষণার পর বাণিজ্যচুক্তির জন্য ভারতকে চাপ দিতে শুরু করে আমেরিকা। এর মাধ্যমে এ দেশের বাজারে বিনা শুল্কে কৃষি এবং ডেয়ারি পণ্য বিক্রির স্বত্ব চেয়ে বসে ওয়াশিংটন। তৎক্ষণাৎ তা খারিজ করে দেয় কেন্দ্রের মোদী সরকার। কারণ এতে ঝুঁকির মুখে পড়তেন ঘরোয়া চাষি, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্তরা। নয়াদিল্লির এই সিদ্ধান্তে গোড়াতেই ধাক্কা খায় বাণিজ্যচুক্তি।
কৃষি এবং ডেয়ারি পণ্য নিয়ে ভারত অনমনীয় মনোভাব দেখানোয় একসময়ে দু’তরফে আলোচনা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর আসতেই ফের তা নতুন উদ্যমে চালু হয়। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি আগামী বছর ভারত সফরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি এ দেশে আসার আগেই বাণিজ্যচুক্তির চূড়ান্ত নীলনকশা স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
গত ৬ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘‘রাশিয়ার থেকে তেল কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। উনি আমার বন্ধু। আমরা কথা বলছি। মোদী কিন্তু দারুণ মানুষ। উনি চান, আমি ভারতে যাই। আমি সেটা নিয়ে ভাবছি। আমি যাব।’’ যদিও সেই সফর কবে হবে, তা স্পষ্ট করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
সূত্রের খবর, ভারত-মার্কিন বাণিজ্যিক টানাপড়েনের মধ্যে সম্পর্ককে ফের মসৃণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন ভারতে আমেরিকার হবু রাষ্ট্রদূত সার্জিয়ো গোর। সম্প্রতি, নয়াদিল্লিতে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বরফ গলানোর মরিয়া চেষ্টা ছিল তাঁর। তাতে কি পুরোপুরি জল ঢালবে শুল্কবিবাদ? উঠছে প্রশ্ন।
তামা রফতানিতে জটিলতার মধ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে এই ধাতুটির আমদানি বাড়িয়েছে ভারত। কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে তামার চাহিদা কম-বেশি ১৬ লক্ষ টন। এর সিংহভাগই ব্যবহার হয় মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরিবহণে। চলতি আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) এখনও পর্যন্ত প্রায় ১২ লক্ষ টন তামা আমদানি করেছে নয়াদিল্লি।
এ দেশে হাতেগোনা তামার খনি আছে, এমনটা নয়। কিন্তু, সেই তামার গুণগত মান খারাপ হওয়ার জন্য এ ব্যাপারে বিদেশি নির্ভরশীলতা বাড়ছে নয়াদিল্লির। ফলে কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে মোদী সরকারের। ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করে ভারত। এর পোশাকি নাম ‘ইন্ডিয়া-ইউএই কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সিইপিএ। বর্তমানে সেই সমঝোতার আওতায় তামা আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৯৯৬ সাল থেকে ঘরের মাটিতে তামা উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে থাকে ভারত। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড। এ ছাড়াও আছে হিন্ডালকো ইন্ডাস্ট্রিজ়, বেদান্ত লিমিটেড এবং শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা কচ্ছ কপার লিমিটেড। কিন্তু এর মধ্যে তামা পরিশোধনকারী বেদান্ত লিমিটেডের কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদা ও সরবরাহ শৃঙ্খলে আসে অস্থিরতা।
২০২৫ আর্থিক বছরে তামার চাহিদা সাড়ে আট লক্ষ টন থাকবে বলে মনে করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে সেটা ১২ লক্ষ টন ছাপিয়ে যায়। ফলে তামা পরিশোধনকারী সংস্থাগুলি তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রককে লেখা চিঠিতে বেশ কিছু বিষয়ের দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে ‘ইন্ডিয়ান প্রাইমারি কপার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন’ বা আইপিসিপিএ।
বণিক গোষ্ঠীটির দাবি, চাহিদা মেটাতে আমিরশাহি থেকে লাগাতার তামার রড আমদানি করায় খনন এবং পরিশোধন থেকে মুখ ফেরাচ্ছে অধিকাংশ ঘরোয়া সংস্থা। উপসাগরীয় আরব দেশটির থেকে তামা আমদানির দু’টি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, চুক্তি থাকার কারণে এতে শুল্কের মাত্রা কম। দ্বিতীয়ত, রডের আকারে পাওয়া যাচ্ছে আমিরশাহির তামা। ফলে পরিশোধনের প্রশ্ন নেই।
আইপিসিপিএ-র অবশ্য দাবি, এতে আখেরে লোকসান হচ্ছে ভারতেরই। কারণ, এর জেরে তামা শোধনের বরাত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ঘরোয়া সংস্থাগুলি। খনি বা শোধনাগার কিছু না থাকা সত্ত্বেও মুনাফার সুযোগ পাচ্ছে আমিরশাহি। দক্ষিণ আমেরিকার চিলি, বলিভিয়া বা পেরুর মতো দেশগুলিতে সর্বাধিক তামা পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াক নয়াদিল্লি, চাইছেন বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।