কয়েক ঘণ্টার প্রবল বৃষ্টিতে জলরুদ্ধ কল্লোলিনী কলকাতা! বানভাসি শহরে জনজীবন প্রায় স্তব্ধ। কলকাতার ছোট-বড় বহু রাস্তার কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমরজল। ব্যাহত হয়েছে অটো, টোটো, বাস থেকে শুরু করে মেট্রো এবং রেল পরিষেবা। ব্যাপক যানজট তৈরি হচ্ছে শহরের মূল রাস্তায়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নাকাল হতে হচ্ছে শহরবাসীকে।
ছবি: পিটিআই।
সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া প্রবল বৃষ্টির কারণে তৈরি হওয়া সঙ্কট প্রাণও কেড়েছে শহরবাসীর। দুর্যোগের সকালে কলকাতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একের পর এক মৃত্যুর খবর মিলছে।
ছবি: পিটিআই।
মঙ্গলবার সকালে একবালপুরের হোসেন শাহ রোডে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় এক প্রৌঢ়ের। পাশাপাশি নেতাজিনগর এবং বেনিয়াপুকুরেও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে দু’জনের। গড়িয়াহাটেও এক জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। গড়ফাতেও এক সাইকেল আরোহীর দেহ উদ্ধার হয়েছে।
ছবি: পিটিআই।
কলকাতা এবং শহরতলিতে রাতভর নাগাড়ে বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত রেল পরিষেবা। টানা বর্ষণের জেরে শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে রেললাইনে জল জমে গিয়েছে। তার জেরে সকাল থেকে ব্যাহত ট্রেন চলাচল।
ছবি: পিটিআই।
লাইনে জল জমে থাকার কারণে চক্ররেলের আপ এবং ডাউন লাইনের পরিষেবা আপাতত বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার রেল পরিষেবা। একই ভাবে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন হাওড়া ডিভিশনের যাত্রীরাও। কলকাতার মেট্রো পরিষেবাও বিঘ্নিত হয়েছে। মেট্রোর লাইনে জল জমার কারণে ভাঙা পথে চালু রয়েছে পরিষেবা।
ছবি: পিটিআই।
রাতভর বৃষ্টিতে হাওড়া ইয়ার্ড, শিয়ালদহ দক্ষিণ ইয়ার্ড, চিৎপুর উত্তর কেবিন-সহ বেশ কিছু কারশেড জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। পাম্প করে সেই জল বার করার চেষ্টা হচ্ছে। তবে বৃষ্টি পুরোপুরি বন্ধ না হওয়ায় আশপাশের এলাকা থেকে আবার জল এসে জমছে রেললাইনে। দুর্যোগের জেরে মঙ্গলবার সকালে শিয়ালদহ থেকে বেশ কিছু দূরপাল্লার ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
ছবি: পিটিআই।
শিয়ালদহের কাছে লাইনে জল জমার কারণে মেন, বনঁগা এবং হাসনাবাদ লাইনের পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছে। এমনকি দমদম জংশন স্টেশন পর্যন্তও যেতে পারছে না ডাউন লাইনের ট্রেনগুলি। বনগাঁ থেকে শিয়ালদহগামী বেশ কিছু ট্রেন সকালের দিকে দমদম ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাতায়াত করে।
ছবি: পিটিআই।
মেন লাইনের ট্রেনগুলিও দমদম স্টেশন পৌঁছোনোর আগেই আটকে যায়। পরে সম্পূর্ণ পথে পরিষেবা চালু হলেও তা অনিয়মিত। দুর্যোগের মধ্যে রেল পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে দুর্ভোগ বেড়েছে যাত্রীদের। কখন পরিষেবা স্বাভাবিক হবে, তা রেল স্পষ্ট ভাবে না জানানোয় অনেকেই বিপাকে পড়েছেন।
ছবি: পিটিআই।
অন্য দিকে, টানা বৃষ্টিতে নাকাল হাওড়া ডিভিশনের রেলযাত্রীরাও। ভারী বৃষ্টির জেরে হাওড়াতেও বেশি রাতের দিকে বেশ কিছু জায়গায় রেললাইনে জল জমে গিয়েছে। সেখানেও পাম্প করে জল বার করার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তারকেশ্বর এবং বর্ধমান মেন লাইনের রেল পরিষেবা অনিয়মিত। তারকেশ্বর লাইনে প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় রেল পরিষেবা বন্ধ ছিল। এ ছাড়া বর্ধমান মেন লাইনেও রেল পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছে। বর্তমানে পরিষেবা চালু থাকলেও তা অনিয়মিত। প্রায় সব লাইনেই ট্রেন দেরিতে চলছে। সেই কারণে ট্রেনগুলিতে যাত্রীদের ভিড়ও উপচে পড়ছে।
ছবি: পিটিআই।
রাতভর ভারী বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত কলকাতার ‘লাইফলাইন’ মেট্রো পরিষেবাও। নাগাড়ে বৃষ্টির জেরে জল জমে গিয়েছে মেট্রোর লাইনে। কলকাতা মেট্রোর ব্লু লাইনে মহানায়ক উত্তম কুমার এবং রবীন্দ্র সদন স্টেশনের মাঝে লাইনে জল জমে গিয়েছে। তার জেরে শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে ময়দান পর্যন্ত অংশে পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে মাস্টারদা সূর্য সেন পর্যন্ত পরিষেবা চালু হয়েছে। তবে মাস্টারদা সূর্য সেন থেকে ময়দান পর্যন্ত পরিষেবা এখনও বন্ধ।
ছবি: পিটিআই।
একটানা বৃষ্টিতে কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ— কলকাতার অনেক রাস্তায় বাস চলাচলও বন্ধ। ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি বাস রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে। দমদম থেকে নাগেরবাজার যাওয়ার যে রাস্তা, সেখানে জল জমার কারণে সকাল থেকে অটো, রিকশা, টোটো চলাচল বন্ধ ছিল। এ ছাড়াও কলকাতার বহু রাস্তায় পরিস্থিতি একই।
ছবি: অমিত দত্ত।
কলকাতার বিভিন্ন গলিপথও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় জল জমেছে। বহু বাড়ি ও গাড়ি জলের নীচে। কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, যে সব রাস্তায় আগে কখনও জল জমেনি, সেই রাস্তাও জলের নীচে।
ছবি: অমিত দত্ত।
বিকে পাল, বিটি রোড, কলেজ স্ট্রিট, সিআর অ্যাভিনিউ, জেএম অ্যাভিনিউয়ের মতো রাস্তায় এখন জল দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলকাতা পুরসভার সংযুক্ত এলাকা বেহালা, বড়িশা, ঠাকুরপুকুর, জোকা, মেটিয়াবুরুজ এবং গার্ডেনরিচের বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন রয়েছে। এই সব এলাকা থেকে জল বার করার চেষ্টাও শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু দীর্ঘ ক্ষণ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই জল নামতে দেরি হচ্ছে।
ছবি: অমিত দত্ত।
রাতভর নজিরবিহীন বৃষ্টির কারণে জল জমেছে শহরের প্রায় প্রত্যেকটি হাসপাতালেই। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম হাসপাতালের একাংশে এখনও জল জমে রয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরির সামনে জল জমেছিল। পাম্প চালিয়ে সেই জল বার করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পরিষেবা স্বাভাবিক রয়েছে বলে আশ্বস্ত করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ছবি: পিটিআই।
ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এক্স-রে রুমে হাঁটুসমান জল। নীলরতন সরকার (এনআরএস) হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড এবং জরুরি বিভাগে জল নেই। তবে হাসপাতালের ভিতরের রাস্তায় জল জমে রয়েছে।
ছবি: পিটিআই।
আরজি কর হাসপাতালের তিনটি প্রধান ফটকই জলমগ্ন। হাসপাতালের ভিতরে পার্কিং, ক্যান্টিন-সহ নিচু এলাকাগুলিতে জল জমে রয়েছে। পাম্প চালিয়ে জল নামানোর চেষ্টা হচ্ছে।
ছবি: পিটিআই।
শারদোৎসবের প্রাক্কালে এমন নজিরবিহীন বৃষ্টি আগে দেখেনি কলকাতা। কলকাতার বেশ কয়েকটি প্যান্ডেলের অবস্থা বেহাল। বহু প্যান্ডেলে জল ঢুকেছে। শিল্পীদের কাজও নষ্ট হয়েছে বেশ কয়েকটি জায়গায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ইতিমধ্যেই কোমর বেঁধে নেমেছে পুজো কমিটিগুলি।
ছবি: পিটিআই।
সোমবার রাত থেকে নাগাড়ে বৃষ্টির কারণে জল জমে গিয়েছে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের নিজের পাড়া চেতলাতেও। তা দেখে বিস্মিত মেয়র স্বয়ং। মঙ্গলবার সকালে পুরসভার কন্ট্রোলরুম থেকে শহরের জলযন্ত্রণার পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন তিনি।
ছবি: পিটিআই।
ফিরহাদ জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকে কলকাতায় এমন বৃষ্টি তিনি দেখেননি। জলমগ্ন কলকাতায় ইতিমধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। এ অবস্থায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শহরবাসীকে বাড়ি থেকে না-বেরোনোর পরামর্শ দিয়েছেন ফিরহাদ। তবে কলকাতার এই পরিস্থিতির জন্য তাঁর দিকেও আঙুল তুলছেন অনেকে।
ছবি: পিটিআই।
সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর ৫টা পর্যন্ত গড়িয়ায় ৩৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গত রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত চেতলায় বৃষ্টি হয়েছে ২৬২ মিলিমিটার। এ ছাড়া কালীঘাট, বালিগঞ্জ, যোধপুর পার্ক এবং তপসিয়াতেও ২৫০-৩০০ মিলিমিটারের মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে।
ছবি: পিটিআই।