বেজে গিয়েছে বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ডঙ্কা! জোরকদমে প্রচার চালাচ্ছে শাসক-বিরোধী দু’পক্ষই। এ-হেন পরিস্থিতিতে প্রবল অস্বস্তিতে রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা আরজেডি। ভোটের মুখে আইআরসিটিসি দুর্নীতি মামলায় দলের ‘সুপ্রিমো’ তথা সাবেক রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছে দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ আদালত। এর প্রভাব ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পড়লে আরজেডির যে কপাল পুড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
আইআরসিটিসি অর্থাৎ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড টুরিজ়ম কর্পোরেশন। ১৯৯৯ সালে রেলের ক্যাটারিং, টিকিট এবং পর্যটন পরিচালনার জন্য জন্ম হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থার। এর ৬২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কেন্দ্রের হাতে। লালুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রেলমন্ত্রী থাকাকালীন আইআরসিটিসি-র দু’টি হেরিটেজ হোটেলের টেন্ডার একটি বেসরকারি সংস্থাকে পাইয়ে দিতে সাহায্য করেন তিনি। বিনিময়ে তিন একর জমি পায় তাঁর পরিবার। যদিও আদালতে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন আরজেডি ‘সুপ্রিমো’।
২০০৪-’০৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) সরকারের অন্যতম জোটসঙ্গী ছিল বিহারের আরজেডি। এই সময়কালে রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পান লালু। তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন আইআরসিটিসির হাতে থাকা ঝাড়খণ্ডের রাঁচী এবং ওড়িশার পুরীর দু’টি হেরিটেজ হোটেলকে লিজ়ে চালানোর বরাত পায় বিহারের সংস্থা ‘সুজাতা হোটেল’। বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা হোটেল দু’টির নাম হল ‘বিএনআর রাঁচী’ এবং ‘বিএনআর পুরী’।
২০০৫ সালে আইআরসিটিসির রাঁচী এবং পুরীর হোটেল দু’টিকে লিজ় চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় রেল। ঠিক হয়, এর জন্য চাওয়া হবে বরাতপত্র। ওই সময় বিহারের পটনায় ‘চাণক্য’ নামের হোটেল চালাচ্ছিল ‘সুজাতা’ গ্রুপ। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির মালিক ছিলেন বিজয় কোচর এবং বিনয় কোচর। কিন্তু তাদের রাঁচী ও পুরীর হোটেলের লিজ়ের জন্য আবেদনের কোনও যোগ্যতাই ছিল না। এই যোগ্যতার বিষয়টি অবশ্য আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিল রেল।
এই পরিস্থিতিতে পটনায় তিন একর জমি বিক্রি করে ‘সুজাতা হোটেল’। এর জন্য ‘ডিলাইট মার্কেটিং’ নামের একটি সংস্থার থেকে ১.৪৭ কোটি টাকা পেয়েছিল তারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জমি বিক্রি হতেই লিজ়ের বরাতে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলে ‘সুজাতা হোটেল’। শুধু তা-ই নয়, ২০০৬ সালে ‘বিএনআর রাঁচী’ এবং ‘বিএনআর পুরী’ চালানোর জন্য ১৫ বছরের লিজ়ও পেয়ে যায় পটনার ওই সংস্থা।
‘সুজাতা হোটেল’-এর থেকে তিন একর জমি কেনা ‘ডিলাইট মার্কেটিং’-এর মালিক আবার ছিলেন আরজেডি সাংসদ প্রেমচন্দ্র গুপ্ত। মাত্র আট বছরের মধ্যেই নিজের সংস্থাকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করে দেন তিনি। ২০১৪ সালে ‘লারা প্রজেক্ট এলএলপি’ নামের একটি সংস্থাকে পটনার ওই জমি ফের বিক্রি করেন প্রেমচন্দ্র। এর জন্য ৬৪ লক্ষ টাকা হাতে পান লালু পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই আরজেডি সাংসদ।
‘ডিলাইট মার্কেটিং’ পটনার জমি বিক্রি করতেই লালু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের অভিযোগ, ‘লারা প্রজেক্ট এলএলপি’ কোনও সংস্থা নয়। এখানে লারা হলেন প্রকৃতপক্ষে লালুপ্রসাদ এবং তাঁর স্ত্রী তথা বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবী। অভিযোগ, আইআরসিটিসির জোড়া হোটেলের বরাত পাইয়ে দিতে ‘সুজাতা হোটেল’-এর থেকে ঘুরপথে জমি হস্তগত করেছেন তাঁরা।
এই ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ তথা বিজেপি নেতা সুশীল মোদী। তিনি বলেন, ‘‘আইআরসিটিসির দু’টি হোটেলের লিজ়ের বরাত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম মানেনি লালু। আগেভাগেই সুজাতা হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি ও তাঁর পরিবার। সেখানেই তৈরি হয় পটনার জমির বিনিময়ে বরাত পাইয়ে দেওয়ার নীলনকশা।’’
বিজেপির অভিযোগ, ৯৪ কোটি বাজারমূল্যের জমি মাত্র ২.১১ কোটিতে হাতিয়ে নিয়েছে লালু এবং তাঁর পরিবার। এর জন্য পরিকল্পনামাফিক প্রথমে ১.৪৭ কোটিতে ওই জমি কিনে নেয় প্রেমচন্দ্র গুপ্তের ‘ডিলাইট মার্কেটিং’। পরে মাত্র ৬৪ লক্ষ টাকায় ‘লারা প্রজেক্ট এলএলপি’-র কাছে সেটা বিক্রি করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট জমিতে শপিং মল হওয়ার কথা রয়েছে।
২০০৬ সালে এই ঘটনার তদন্তে নামে সিবিআই। পরবর্তী সময়ে পটনা, দিল্লি, রাঁচী এবং গুরুগ্রামে আরজেডি সুপ্রিমো এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত এক ডজন জায়গায় অভিযান চালায় এই কেন্দ্রীয় সংস্থা। কিন্তু, ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত লালুপ্রসাদের নামে কোনও মামলা রুজু করেনি তারা। স্বাভাবিক ভাবেই সিবিআইয়ের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধীদের দাবি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা অমিত শাহ।
২০২২ সালে আইআরসিটিসি দুর্নীতি মামলায় চার্জশিট দাখিল করে সিবিআই। এতে মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনী। চার্জশিটে লালুপ্রসাদ যাদব-সহ তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্য, ‘সুজাতা হোটেল’-এর দুই মালিক বিজয় কোচর ও বিনয় কোচর এবং আইআরসিটিসির তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর পিকে গয়ালের নাম রয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে বলে আদালতে দাবি করেছে সিবিআই।
সিবিআই সূত্রে খবর, পটনার জমি বিক্রির সময়ে ‘ডিলাইট মার্কেটিং’ লালু পরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সংস্থাকে বেছে নিয়েছিল। তাদের বাজারদরের থেকে অনেক কম মূল্য দেওয়া হয়। পরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির নাম বদল করে রাখা হয় ‘লারা প্রোজেক্টস এলএলপি’। পাশাপাশি, এর মালিকানা হস্তান্তরিত হয় লালুর পত্নী রাবড়ি এবং পুত্র তেজস্বী যাদবের নামে। ২০১০-’১৪ সালের মধ্যে গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছিল।
চার্জশিটে যাদব পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতারণা, অসৎ ভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারায় মামলা রুজু করেছে সিবিআই। অভিযোগ প্রমাণ হলে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন জেল হতে পারে। পাশাপাশি মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধানও রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনের ধারায়। চার্জশিটে উভয় পক্ষের সাক্ষীদের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর এই মামলার চার্জগঠনের সময় তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করে রাউস অ্যাভিনিউ আদালত। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘যে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে, তার বিচার প্রতারণা মামলা হিসাবে করতে হবে। এই ধরনের ষড়যন্ত্রের বিষয়টিকে কখনওই আদালতে এড়িয়ে যেতে পারে না।’’
দিল্লির আদালতে আইআরসিটিসি দুর্নীতি মামলায় চার্জ গঠনের পর এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি পোস্ট করেন লালু-পুত্র তেজস্বী। তাঁর দাবি, কয়েক দিন আগে প্রচারে এসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচনে অংশ নিতে দেবেন না বলে হুমকি দিয়েছিলেন। ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ মেটাতে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। অন্য দিকে গেরুয়া শিবিরের পাল্টা যুক্তি, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে সহানুভূতির তাস খেলতে চাইছেন তেজস্বী।
গত ৬ অক্টোবর ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফায় ১২১ আসনে ভোট হবে ৬ নভেম্বর। এতে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত মনোনয়ন জমা করতে পারবেন প্রার্থীরা। ২০ অক্টোবর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। আর মনোনয়ন পরীক্ষা হবে ১৮ অক্টোবর। ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় মোট ১২২টি আসনে চলবে ভোটগ্রহণ। এতে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত মনোনয়ন জমা করা যাবে।
বিহারের শাসক শিবির অবশ্য ইতিমধ্যেই আসন বণ্টন চূড়ান্ত করে ফেলেছে বলে শোনা গিয়েছে। ১০১টি করে কেন্দ্রে প্রার্থী দিচ্ছে বিজেপি এবং মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ)। এ ছাড়া লোক জনশক্তি পার্টি-রামবিলাস ২৯টি, রাষ্ট্রীয় লোক দল ছ’টি এবং জিতেন রাম মাজিঁর হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা ছ’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। বিরোধীদের আসন বণ্টন এখনও পুরোপুরি চূড়ান্ত হয়নি।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন লালুপ্রসাদ যাদবের বিরুদ্ধে ওঠে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির অভিযোগ। পরবর্তী কালে জমির বিনিময়ে রেলের চতুর্থ শ্রেণিতে চাকরি বিলির মামলাও দায়ের হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এর প্রভাব বাংলার পড়শি রাজ্যটির রাজনীতিতে ভালই পড়েছিল। একসময় সেখানে প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে যায় আরজেডি। কিন্তু শেষ কয়েকটি নির্বাচনে তেজস্বীর নেতৃত্বে লালুর দল ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলা যেতে পারে।
বিহার বিধানসভা ভোটের প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষাগুলিতে মুখ্যমন্ত্রীর দৌড়ে এগিয়ে আছেন তেজস্বী। এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলায় চার্জগঠন করল দিল্লির আদালত। ১৪ নভেম্বর ভোটের ফলপ্রকাশ হলেই এর প্রভাব কতটা আমজনতার উপর পড়েছে, মিলবে তার উত্তর।
সব ছবি: সংগৃহীত।