বুড়ো হতে চান না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দীর্ঘ জীবন ও যৌবন ধরে রাখার জন্য ‘অমরত্বের ফর্মুলা’ নাকি আবিষ্কার করে ফেলেছেন মস্কোর সর্বময় কর্তা। বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখার অদম্য বাসনা রয়েছে তাঁর, এমনটাই দাবি করেছে একাধিক পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম। সত্যিই কি ‘অমরত্ব’ পেয়েছেন পুতিন? সম্প্রতি এই প্রশ্নে দুনিয়া জুড়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বিজয় দিবসে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে কথোপকথনের সময় ‘যৌবন ধরে রাখার’ রহস্য ফাঁস করেন পুতিন। এমনকি ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচার কৌশলের সন্ধান দেওয়ার কথাও বলতে শোনা গিয়েছিল রুশ প্রেসিডেন্টের গলায়। এর পরই গত বছর পুতিন-ঘনিষ্ঠ কয়েক জন রুশ বিজ্ঞানী বয়স কমানোর ব্যাপারে গবেষণার নির্দেশ পান বলে দাবি করে বসে কয়েকটি গণমাধ্যম।
এত কিছুর পরেও সম্প্রতি পুতিনের হাতের কয়েকটি ছবি ও ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ঘোরাফেরা করছে। তাতে দেখা গিয়েছে মস্কোর রাষ্ট্রপ্রধানের হাতের শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। ফোলা ও লালচে ভাব লক্ষ করা গিয়েছে হাতে। সেই ফোলা হাতের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই পুতিনের স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। বিশেষ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলিতে চর্চা শুরু হয়েছে, সত্যিই কি অসুস্থ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন!
নিউ ইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মস্কোয় বাস্কেটবল কোর্টে অনুগামীদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন পুতিন। সেই অনুষ্ঠানের সময় রুশ প্রেসিডেন্টকে ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরে থাকতে দেখা গিয়েছে। ওই সময় ব্যথায় তাঁর ডান হাত কুঁচকে যায়। ফুলে ওঠে শিরা। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অবশ্য ভাষণ চালিয়ে যান তিনি। অনুষ্ঠান চলাকালীন তাঁর চোখে-মুখে অস্বস্তির ভাবও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
আবার ‘ইউকে এক্সপ্রেস’ নামের একটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের দাবি, রাশিয়ায় ‘হেলদি ফাদারল্যান্ড’ আন্দোলনের প্রধান ২২ বছর বয়সি তরুণী ইয়েকাটেরিনা লেশচিনস্কায়ার সঙ্গে দেখা করতে যান পুতিন। সেই সময়ো প্রেসিডেন্টের অভিব্যক্তি অস্বস্তিকর বলে ধরা পড়েছে ভিডিয়োয়। তিনি সেখানে হাত মুঠোবন্দি করে ধরে রয়েছেন বলে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
সেই ভিডিয়ো এখন গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রে। পুতিনের মুখ দেখেও তাঁকে অসুস্থ মনে হচ্ছে বলে সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠেছে। যাঁরা সেটি দেখেছেন, তাঁদের অনেকের এ কথাও মনে হয়েছে যে, পুতিন স্নায়ুর রোগ পারকিনসন্সে আক্রান্ত। আবার অনেকে মনে করেন, পুতিনের শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসারের মতো মারণরোগও। পুতিনের ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে শত্রুদেশ ইউক্রেন।
ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রাক্তন উপদেষ্টা আন্তন গেরাশচেঙ্কো পুতিনের ভিডিয়োটি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) শেয়ার করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘পুতিনের হাতে কী হয়েছে?’’ গেরাশচেঙ্কোর সুরে সুর মিলিয়ে সমাজমাধ্যমে এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, ইউক্রেনীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দিমিত্রি গর্ডন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘পুতিনের হাত ফোলা। এক হাতে শিরা স্পষ্ট ভাবে ফুলে উঠেছে।’’
পুতিনের স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে এই ধরনের গুজব বা জল্পনা নতুন কিছু নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরে পুতিনের হাতের পাতার উপরে কালো রঙের চিহ্ন নজর এড়ায়নি শত্রুদেশের নজরদারদের। সেই দাগ কিসের, তা নিয়ে আলোচনা ও চর্চা তুঙ্গে ওঠে। সেই দাগগুলিকে আইভির সুচের (ইনট্রাভেনাস থেরাপি) দাগ বলে দাবি করা হয়।
২০২২ সালে পুতিনের একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছিল যেখানে দেখা গিয়েছিল রুশ প্রেসিডেন্টের হাত কাঁপছে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজ়ান্দার লুকাসেঙ্কোর সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করছিলেন পুতিন। সেই সময় বহু বার পুতিনের হাত কাঁপতে দেখা গিয়েছে। ভিডিয়োটি দেখে অনেকেই ধারণা করে নিয়েছিলেন পুতিন স্নায়ুর রোগে ভুগছেন।
সেই বৈঠকেরই আরও একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক পোস্ট। তাতে দেখা গিয়েছিল, পুতিনের হাত কাঁপা শুরু হতেই সেই দুর্বলতা আড়াল করতে হাতটিকে বুকের কাছে জড়ো করে নেন। ভিডিয়ো দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, কেবল হাত নয়, পুতিনের মুখ অস্বাভাবিক রকমের ফুলে রয়েছে, যা সুস্থতার লক্ষণ নয়।
সেই বছরেরই শেষের দিকে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ দাবি করেছিল, বাড়িতে সিঁড়ি থেকে পড়ে যান রুশ প্রেসিডেন্ট। ওই সময়ে প্যান্টেই মলত্যাগ করে ফেলেন ৭০ বছরের পুতিন। পুতিনের পাকস্থলী ও অন্ত্রে ক্যানসার হয়েছে, এই তত্ত্বের উদ্ভব হয় সেই খবর থেকে। বিশ্ব জুড়ে জল্পনা শুরু হয়, রাশিয়ার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা গুরুতর অসুস্থ। তখনই একাধিক দাবি ওঠে, যে তিনি ক্যানসার আক্রান্ত। যদিও পুতিন কখনও তাঁর ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
২০২৩ সালে পুতিনের স্বাস্থ্যের হালহকিকত নিয়ে রাশিয়ারই একটি চ্যানেলের রিপোর্টে বলা হয়েছিল পুতিনের শরীর ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। ‘মাথায় যন্ত্রণা, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, জিভে জড়তা’ দেখা দিয়েছে বাহাত্তুরে রাষ্ট্রপ্রধানের। ‘ডান হাত এবং ডান পায়ে সাড় কমে যাচ্ছে’ রুশ প্রেসিডেন্টের। দ্রুত চিকিৎসা ও বিশ্রামের নির্দেশ দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। সেই উপদেশ অবশ্য কানে তোলেননি ক্রেমলিনের কর্তা।
যত বারই পুতিনের দুর্বল স্বাস্থ্য ও রোগের প্রসঙ্গ উঠেছে মস্কো পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছে সেই সমস্ত দাবি। রুশ সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, বেশ কিছু ইউক্রেনীয়, আমেরিকান ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এবং তথ্য বিশেষজ্ঞ প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কিছু গুজব ছড়িয়েছে। সমস্তই ভুয়ো খবর ছাড়া আর কিছুই নয় বলে প্রেসিডেন্টের অসুস্থতার খবর উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া।
পুতিনের বর্তমান বয়স ৭২। ইউরোপ থেকে আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়া থেকে আফ্রিকা, যে কোনও মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশেই ক্ষমতা রয়েছে বয়স্ক নেতাদের হাতেই। পঞ্চম বারের মতো রাশিয়ায় ক্ষমতা ধরে রাখার পর বয়সকে হারিয়ে দেওয়ার নতুন তাগিদ দেখা গিয়েছে রাশিয়ার একনায়কের মধ্যে। সমালোচকেরা বলছেন, পুতিন আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার জন্যই এই কৌশল নিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের পদে থাকার জন্য চাই শারীরিক সক্ষমতা।
বেজিঙের সাংবাদিক সম্মেলনে একজন পুতিনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মানুষের পক্ষে কি ১৫০ বছর বেঁচে থাকা সম্ভব? রুশ প্রেসিডেন্টের জবাব ছিল, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যে রকম উন্নতি হয়েছে, তাতে ওষুধ, অস্ত্রোপচার এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করে মানুষ আগের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে।
২০০০ সালে পুতিন প্রথম বার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন তিনি চার বছর করে মোট দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। পরে আবার প্রেসিডেন্ট হন তিনি। সেই মেয়াদও শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালে। বছর ৭২-এর পুতিন কিছু দিন আগে সংবিধান সংশোধন করে নিজের কার্যকালের মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন।
পুতিনই প্রথম বিশ্বনেতা নন, যাঁকে এই ধরনের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাটাছেঁড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে (২০২৫) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতেও কালো ক্ষতের চিত্র ধরা পড়েছিল অনুসন্ধানীদের ক্যামেরায়। ফলে তাঁর স্বাস্থ্য নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছিল। খবর ছড়াতেই হোয়াইট হাউস দ্রুত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল যে, ঘন ঘন করমর্দনের ফলেই এই চিহ্নগুলি তৈরি হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতে।
রুশ প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে এমন কোনও তথ্যের সত্যতা নেই বলে জানিয়েছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। হোয়াইট হাউসও পুতিনের স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে এখনও কোনও মন্তব্য করেনি।
সব ছবি: সংগৃহীত।