প্রায় ৫০ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগের কথা। সে সময় মানুষ তো দূরের কথা, পৃথিবীতে ডায়নোসরও আসেনি। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাই ছিল সমুদ্রের জলে ভরা। শুধুমাত্র গুটি কয়েক প্রাণীরই আনাগোনা ছিল তখন। বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে সেই সময়ের এক বিরল প্রজাতির খোঁজ।
তিনটি চোখ, দু’টি মাথার সামনের দিকে, আর একটি মাঝখানে মাথার উপরে। আকারে বেশ ছোট, একেবারে মানুষের আঙুলের মতো। শরীরের দু’পাশে পাখা, যা ঝাপটে সে জলের মধ্যে পাখির মতো উড়ে বেড়াত।
সামনের দিকে ছিল হাতের মতো এক জোড়া অঙ্গ, যা নিমেষে শিকার করার ক্ষমতা রাখত। গোলাকার মুখের চারপাশে ধারালো প্লেট বসানো— যেন বিশাল একটা ব্লেডের মতো ধারালো জিনিস। শিকার মুখে ঢুকলেই এর সাহায্যে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত।
এমনই এক প্রজাতির ৬০টিরও বেশি জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তিনচোখো এই বিরল প্রাণীর ছবি দেখে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়।
বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতির নাম দিয়েছেন ‘মোসুরা ফেন্টোনি’। এটি সমুদ্র-প্রজাপতি বা ‘সি মথ’ নামেও পরিচিত। সমুদ্রের জলে প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়ে বেড়াত এরা। এই কারণেই এদের এমন নাম।
এটি রেডিয়োডন্টস গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। রেডিয়োডন্টস আসলে আর্থ্রোপড জীবজগতের প্রাচীন শাখা। অর্থাৎ, সহজ ভাবে বলতে গেলে শাখাযুক্ত পা ও বাইরের শক্ত খোলসযুক্ত প্রাণীরাই হল আর্থ্রোপড।
আজকের কাঁকড়া, চিংড়ি, পোকা, মাছিও কিন্তু আর্থ্রোপড শাখারই অংশ। তাই বিজ্ঞানীদের মতে, ‘মোসুরা ফেন্টোনি’ আসলে কাঁকড়া-চিংড়ির মতো আর্থ্রোপড শাখার প্রাণীদের পূর্বসূরি।
এই প্রজাতিটিকে আবিষ্কার করেছেন কানাডার ম্যানিটোবা মিউজ়িয়াম ও রয়্যাল অন্টারিও মিউজ়িয়ামের জীবাশ্মবিদেরা। সেখানে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করছিলেন জোসেফ মোয়সিউক এবং জিন-বার্নার্ড ক্যারন।
২০২৫ সালের মে মাসে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন তাঁরা। রয়্যাল সোসাইটি ওপেন সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয় তাঁদের গবেষণাপত্র। সেখান থেকেই খোঁজ মেলে সমুদ্র-প্রজাপতির।
গবেষণাটির প্রধান ছিলেন ম্যানিটোবা মিউজ়িয়ামের প্যালিয়োনটোলজি ও জিয়োলজি কিউরেটর মোয়সিউক। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বর্তমান জীবজগতের ৮০ শতাংশের বেশি প্রাণী আর্থ্রোপড।
বিজ্ঞানীরা ওই জীবাশ্মগুলিকে বেশ ভাল ভাবে সংরক্ষিত করে রেখেছেন। তাঁরা লক্ষ করেছেন, ‘মোসুরা ফেন্টোনি’র এমন কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আগে কোনও রেডিয়োডন্টে দেখা যায়নি।
এরা শ্বাস নিত দেহের পিছনের অংশ দিয়ে। ঠিক যেমন চিংড়ি ও কাঁকড়া নিয়ে থাকে। দেহের পিছনের অংশ পেটের মতো দেখতে ছিল। সেখানে মোট ১৬টি ভাগ ছিল।
দেহের এমনই বর্ণনা গবেষণাপত্রে দিয়েছেন মোয়সিউক। তিনি জানিয়েছেন, ঠিক যেমন উইপোকা, কাঁকড়া অথবা সাধারণ পোকামাকড় দেহের পিছনের অংশ দিয়ে শ্বাস নেয়, এরাও তাই করত। এ রকম আরও কিছু বৈশিষ্ট্যই প্রমাণ করে ‘মোসুরা ফেন্টোনি’ এখনকার কিছু প্রজাতির পূর্বসূরি।
ক্যারন তাঁর গবেষণার মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কোটি কোটি বছর আগে যখন পৃথিবীতে কোনও প্রাণীরই তেমন খোঁজ ছিল না, তখনও সমুদ্র-প্রজাপতির মতো প্রাণীরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে সক্ষম ছিল।
বড় কিছু শিকার করার ক্ষমতা ছিল না এই প্রজাতির। তবে, নিজের পাঞ্জা দিয়ে খোলসযুক্ত ছোট জলজ প্রাণী শিকার করত তারা। একই ভাবে উল্টো দিকে বড় প্রাণীর শিকারে পরিণত হওয়ার ভয়ও থাকত বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
আমেরিকান মিউজ়িয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির প্যালিয়োনটোলজি বিভাগের গবেষক রাসেল ডিসি বিকনেলও এই বিষয়ের উপর গবেষণা করেছেন। সেখানে তিনি আরও অনেক তথ্য তুলে ধরেছিলেন।
এক প্রতিবেদনে বিকনেল বলেছেন, ‘‘মোসুরা ফেন্টোনির মতো আরও অনেক প্রাচীন প্রাণী ছিল। বিশেষ করে সক্রিয় সামুদ্রিক শিকারি, যেগুলির থেকে আমরা প্রাচীন সামুদ্রিক পরিবেশের আরও অনেক তথ্য পাই।’’
তবে আরও একটি বিষয় গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মনে করেন ‘মোসুরা ফেন্টোনি’ শুরুতে কেঁচোর মতো দেখতে ছিল। ধীরে ধীরে তাদের দেহের আকৃতি বিবর্তিত হয়।
ডায়নোসর-সহ আরও অনেক প্রাণীই আজ বিলুপ্ত। তাদের নিয়ে এখনও বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভয়ঙ্করদর্শন বিরল ‘মোসুরা ফেন্টোনি’র মতো প্রজাতি আদতে কতটা শক্তিশালী ছিল, কী ভাবে তারা বিলুপ্ত হল সেই সব নিয়ে এখনও নানা গবেষণা চলছে।
সব ছবি: সংগৃহীত এবং এআই।