যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে ইউরোপের ‘রুটির ঝুড়ি’। তার আঁচে চরম বিপাকে সেই মহাদেশের ‘রুগ্ন মানুষ’। দিন দিন বাড়ছে সে দেশের খাদ্যসঙ্কট। এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত। পেট ভরাতে তার ঘরে পাঠায় টন টন গম। কিন্তু সেই উপহার গ্রহণ করা তো দূরে থাক, উল্টে নয়াদিল্লির খাবার নিয়ে সে দেশ জুড়ে শুরু হয় কুৎসা ও অপপ্রচার। গমভর্তি জাহাজ বন্দরে ভিড়তেই দেয়নি তারা। কী ভাবে সেই সমস্যার সমাধান করল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার?
ইউরোপের ‘রুটির ঝুড়ি’ অর্থাৎ ইউক্রেন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সেখানে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (পড়ুন স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে রাশিয়া। মস্কো-কিভ যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক খাদ্যসুরক্ষার দিক থেকে বিপদে পড়ে সংশ্লিষ্ট মহাদেশটির ‘রুগ্ন মানুষ’ হিসাবে পরিচিত তুরস্ক। কারণ, এত দিন পর্যন্ত আঙ্কারার গমের সিংহভাগ চাহিদা মেটাচ্ছিল ইউক্রেন। সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার পর সেই রফতানি বন্ধ করতে বাধ্য হয় কিভ। ফলে তুরস্কের ঘরোয়া বাজারে হু-হু করে বাড়তে থাকে রুটির দাম। ঊর্ধ্বমুখী হয় মু্দ্রাস্ফীতির সূচকও।
বিষয়টি নজরে আসতেই তৎপর হয় ভারত। ওই বছরের (পড়ুন ২০২২ সাল) মে মাসে আঙ্কারার উদ্দেশে ৫৫ হাজার টন উচ্চ গুণমান সম্পন্ন গম পাঠায় নয়াদিল্লি। সংশ্লিষ্ট রফতানিটির সঙ্গে জড়িয়েছিল বেসরকারি সংস্থা আইটিসি লিমিটেডের। কিন্তু, তাদের গমবোঝাই জাহাজ তুরস্কের জলসীমায় পৌঁছোতেই সেটি আটকে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় গমে ‘রুবেলা’ নামের ভাইরাস রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ানের সরকার। এতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রবল অস্বস্তির মুখে পড়ে নয়াদিল্লি।
কাশ্মীর হোক বা অন্য কোনও ইস্যু। বিশ্বমঞ্চে প্রায় সব সময়ই ভারতের বিরোধিতা করে গিয়েছে তুরস্ক। পাশাপাশি, পাকিস্তানের সঙ্গে আঙ্কারার ঘনিষ্ঠতা কূটনৈতিক মহলে কারও অজানা নয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, তার পরেও সেখানকার বাসিন্দাদের বিপদের কথা শুনে গম পাঠাতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি কেন্দ্রের মোদী সরকার। এর মাধ্যমে ইসলামাবাদের ‘বন্ধু’কে নিজেদের দিকে টানতে চেয়েছিল সাউথ ব্লক, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
নয়াদিল্লির এ-হেন ভালমানুষিতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ানের মন কিন্তু গলেনি। উল্টে ভারতীয় গমে ‘রুবেলা’ ভাইরাস রয়েছে বলে ব্যাপক প্রচার শুরু করে তাঁর সরকার। ফলে তড়িঘড়ি এই ইস্যুতে শুরু হয় খোঁজখবর। কয়েক দিনের মাথাতেই উদ্ভিদবিদেরা জানিয়ে দেন, কোনও ফসলেই বাসা বাঁধতে পারে না এই ধরনের ভাইরাস। তা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে ‘রুবেলা’র উপস্থিতির কোনও প্রমাণও নেই। বরং অতীতে ইউরোপে এর প্রকোপ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তার পরেও নয়াদিল্লির গম নিতে অস্বীকার করে আঙ্কারা।
তুরস্কের এই মনোভাবের জেরে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে আইটিসি। আঙ্কারার জলসীমা সংলগ্ন এলাকায় গমভর্তি জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকায় তাদের লোকসানের অঙ্ক প্রতি দিনই বাড়ছিল। ঠিক এই সময় দেবদূতের মতো রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব হয় নয়াদিল্লির ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচিত ইজ়রায়েলের। গুণগত মান নিয়ে কোনও প্রশ্ন না তুলে সমস্ত গম কিনে নেয় তেল আভিভ। ফলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন আইটিসি কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তী সময়ে গোটা বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন ভারতীয় বাণিজ্য সংস্থাটির কৃষি বিভাগের চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার বা সিইও রজনীকান্ত রাই। তাঁর কথায়, ‘‘ইটিজি কমোডিটিস নামের একটি ডাচ ফার্মের কাছে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন গম বিক্রি করা হয়েছিল। তুরস্কের একাধিক সংস্থায় ওই গম পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের কাঁধে। কিন্তু, ফসলের গুণগত মান নিয়ে আঙ্কারা প্রশ্ন তোলায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। এর পর পরীক্ষার জন্য ওই গম একটি সুইস গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছিল।’’
রাই জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্রের রিপোর্টে ভারতীয় গমের গুণগত মান ‘ভাল’ বলা সত্ত্বেও সেটা গ্রহণ করতে চায়নি তুরস্ক। এর পর নতুন ক্রেতার সন্ধান শুরু করে সরকার। ওই সময় যাবতীয় গম কিনে নিতে আগ্রহী হয়েছিল মিশর। কিন্তু জাহাজ মুখ ঘোরাতে না ঘোরাতেই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কায়রো। সব শেষে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করে ইজ়রায়েল। তেল আভিভের মনোভাব প্রথম থেকেই ‘ইতিবাচক’ ছিল বলে জানিয়েছেন আইটিসির সিইও।
ভারতের সঙ্গে ‘শত্রুতা’ করে গম ফিরিয়ে দেওয়ার সাজা অবশ্য হাতেনাতে পায় তুরস্ক। পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ভাবে বাড়তে থাকে আঙ্কারার খাদ্যসঙ্কট। ফলে কিছুটা মরিয়া হয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর্ডোয়ান সরকার। কিন্তু তাতে লাভ তেমন হয়নি। রুশ নৌবাহিনী রাস্তা আটকে রাখায় গমের জাহাজ কোথাও পাঠানো সম্ভব নয় বলে ভূমধ্যসাগরের কোলের দেশটিকে জানিয়ে দেয় কিভ।
এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিকল্প হিসাবে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে আঙ্কারা। সেখান থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের। কারণ, প্রথমত যুদ্ধের কারণে মস্কোর উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিম ইউরোপ। এর জেরে সেখান থেকে গম কেনা তুরস্কের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, মস্কোর থেকে গম আমদানি করতে হলে কৃষ্ণসাগর ছাড়া অন্য রাস্তা নেই। যুদ্ধের জন্য সেখানে আবার গুচ্ছ গুচ্ছ মাইন পেতে রেখেছে রুশ নৌবাহিনী। আর তাই গমের জন্য তুরস্ক যোগাযোগ করলে ক্রেমলিন জানিয়ে দেয় যে এই বাণিজ্যে জাহাজের বন্দোবস্ত আঙ্কারাকেই করতে হবে। কৃষ্ণসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় তাতে কোনও ক্ষতি হলে কোনও ভাবেই দায়ভার নেবে না রুশ সরকার।
মস্কোর এই শর্ত মেনে সেখান থেকে গম আমদানি করা ইউরোপের ‘রুগ্ন মানুষ’টির পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে অচিরেই তুরস্কের ঘরোয়া বাজারে রকেট গতিতে বাড়তে থাকে রুটির দাম। পাশাপাশি, এর্ডোয়ান প্রশাসনের বিরুদ্ধে দানা বাঁধে গণবিক্ষোভ। তা থামাতে ইস্তানবুল-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহরে সেনা পর্যন্ত নামাতে হয়েছিল। বলপ্রয়োগ করে ওই অন্দোলনের কণ্ঠরোধ করতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত সক্ষম হন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।
ভারতের প্রতি শত্রু মনোভাবের ক্ষেত্রে গম ফেরানোই কিন্তু একমাত্র ঘটনা নয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দক্ষিণ তুরস্কের বিস্তীর্ণ এলাকা। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৭.৮। কম্পনের জেরে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সেখানকার যাবতীয় বহুতল। ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েন বহু মানুষ। এতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছিল প্রায় ছ’লাখে। ভূমিকম্পের পর প্রথম দেশ হিসাবে বিপুল ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়ে আঙ্কারার পাশে দাঁড়ায় নয়াদিল্লি।
এর পাশাপাশি ওই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে সেখানে উদ্ধারকাজে নামে ভারতীয় ফৌজ এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা এনডিআরএফ (ন্যাশনাল ডিজ়াস্টার রেসপন্স ফোর্স)। তাদের সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন দোস্ত’। এতে ৮.৪৫ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের ত্রাণসামগ্রী দক্ষিণ ইউরোপের দেশটিতে পাঠায় নয়াদিল্লি। ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত অবস্থায় বার করে আনে বহু তুর্কি নাগরিককে।
সংশ্লিষ্ট অভিযানটি চলাকালীন ভূমিকম্পবিধ্বস্ত এলাকায় একটি অস্থায়ী হাসপাতালও তৈরি করেছিল ভারতীয় ফৌজ। উদ্ধারকাজে ড্রোন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর ব্যবহার করে এনডিআরএফ। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে অবশ্য কোনও কৃতজ্ঞতা জানায়নি আঙ্কারা। উল্টে রাষ্ট্রপুঞ্জে কাশ্মীর ইস্যুতে ফের পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেয় এর্ডোয়ান সরকার।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। নির্বিচারে গুলি করে তাঁদের হত্যা করে সন্ত্রাসবাদীরা। ওই ঘটনার বদলা নিতে মে মাসে ইসলামাবাদের জঙ্গিঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে ভারতীয় ফৌজ। এই অভিযানের পোশাকি নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। একে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লির সঙ্গে চার দিনের ‘যুদ্ধে’ জড়ায় পাকিস্তান।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনীর একাধিক ছাউনি লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায় পাক ফৌজ। ওই সময় তুরস্কের তৈরি বের্যাক্টর টিবি-২ এবং সোয়ার্ম-সহ একগুচ্ছ মানববিহীন উড়ুক্কু যান ব্যবহার করে ইসলামাবাদ। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স) ব্যবহার করে সেগুলিকে অবশ্য মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয় এ দেশের বাহিনী।
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত যে কড়া জবাব দেবে সে বিষয়ে একরকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বিশ্ব। ঘটনার কয়েক দিনের মাথাতেই পাকিস্তানে অবতরণ করে তুরস্কের একাধিক সামরিক মালবাহী বিমান। সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের দাবি, এতে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার ইসলামাবাদকে পাঠিয়েছিল আঙ্কারা। যদিও সরকারি ভাবে তা মেনে নেয়নি ইউরোপের ‘রুগ্ন মানুষ’।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর অবশ্য তুরস্ককে নিয়ে ভারত সরকার এবং এখানকার জনগণের মনোভাব অনেকটাই বদলে গিয়েছে। গত ছ’মাসে এখান থেকে আঙ্কারায় বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। গত ১৫ মে তুর্কি সংস্থা সেলেবি-র কাজের অনুমোদন বাতিল করে কেন্দ্র। এ দেশের একাধিক বিমানবন্দরের ‘গ্রাউন্ড অপারেশন’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা। এ ছাড়া দক্ষিণ ইউরোপের দেশটির কট্টর ‘শত্রু’ গ্রিস এবং সাইপ্রাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির দিকে জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি।
নয়াদিল্লিভিত্তিক বাণিজ্য বিশ্লেষক এস চন্দ্রশেখরন জানিয়েছেন, তুরস্কের দিক থেকে এ দেশের গম প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টি ছিল পুরোপুরি ভূ-রাজনৈতিক। এর সঙ্গে ভাইরাস বা গুণগত মানের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ানের এই সিদ্ধান্তে দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার ৩৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। সেটা কমাতে না পারলে অচিরেই যে আঙ্কারাকে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার’ বা আইএমএফের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) শরণাপন্ন হতে হবে, তা বলাই বাহুল্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।