কথায় বলে, ‘একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রিব দোসর’! ভারত ও চিনের বিরুদ্ধে এ বার সঙ্গীদের লেলিয়ে দিয়ে সেই কথাটিকেই যেন স্মরণ করাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত খনিজ তেল কেনার জন্য নয়াদিল্লি এবং বেজিঙের উপর শুল্ক চাপাতে ক্রমাগত ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ (জি-৭) এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোকে (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) চাপ দিচ্ছেন তিনি।
শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গোঁ ধরে থাকায় কিছুটা বাধ্য হয়েই এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে জি-৭ এবং নেটো। বিশ্লেষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির উপরে পাহাড়প্রমাণ চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সমাধানসূত্র বার করতে বৈঠক করেন প্রথম সংগঠনটির সাত অর্থমন্ত্রী। সেখানে অবশ্য ভারত এবং চিনের উপরে উচ্চ হারে শুল্ক চাপানোর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ওই বৈঠক যে নয়াদিল্লির রক্তচাপ বাড়িয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
জি-৭ সংগঠনটিতে রয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, জাপান এবং কানাডা। বিশ্লেষকদের দাবি, এই গোষ্ঠীর পক্ষে ট্রাম্পের কথামতো ভারতের উপরে শুল্ক চাপানো বেশ কঠিন। কারণ, ইতিমধ্যেই নয়াদিল্লির সঙ্গে ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ (ফ্রি ট্রেড অগ্রিমেন্ট বা এফটিএ) সেরে ফেলেছেন ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। পাশাপাশি, একই ধরনের সমঝোতার দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইটালি। এই তিনটি দেশ আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভারতের সঙ্গে ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ করতে প্রবল আগ্রহী ইইউ। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির সঙ্গে তাদের আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। ট্রাম্পের কথামতো শুল্কনীতি নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে জাপানেরও। কারণ, রেল-সহ এ দেশের প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, পরিকাঠামো, প্রতিরক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে বিপুল লগ্নি রয়েছে টোকিয়োর। তার তাই জোর করে শুল্ক চাপিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে নারাজ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ-হেন পরিস্থিতিতে জি-৭-ভুক্ত দেশগুলির অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক পরিচালনার দায়িত্ব পান কানাডার ফ্রাঁসোয়া-ফিলিপ শ্যাম্পেন। সম্মেলন শেষে এ ব্যাপারে বিবৃতি দেন তিনি। বলেন, ‘‘রাশিয়ার উপর চাপ বাড়ানোর জন্য সম্ভাব্য আর্থিক অবরোধমূলক পদক্ষেপগুলি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে নিষেধাজ্ঞা এবং শুল্কও রয়েছে।’’ অন্য দিকে এই ব্যাপারে পৃথক বিবৃতি দেন মার্কিন অর্থসচিব (ট্রেজ়ারি সেক্রেটারি) স্কট বেসেন্ট এবং বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। তাঁদের বক্তব্যে আমেরিকার মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
বৈঠকশেষে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম করে বিষোদ্গার করেন বেসেন্ট এবং গ্রিয়ার। তাঁদের কথায়, ‘‘একমাত্র ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মস্কোর যুদ্ধ চালানোর আর্থিক উৎস বন্ধ করা যেতে পারে। সেটা অর্থহীন হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত চাপ তৈরিতে সক্ষম হবে।’’ শেষ পর্যন্ত আমেরিকার চাপে জি-৭-ভুক্ত দেশগুলি ভারত ও চিনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক চাপালে, তার পরিমাণ কতটা হবে, সেটা অবশ্য স্পষ্ট করেননি যুক্তরাষ্ট্রের ওই দুই শীর্ষ কর্তা।
অন্য দিকে ওই বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিনা পণ্যে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের আর্জি জানিয়ে নেটো-ভুক্ত দেশগুলিকে চিঠি পাঠান ট্রাম্প। পাশাপাশি ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলিকে রুশ খনিজ তেল ‘উরাল ক্রুড’-এর আমদানি অবিলম্বে বন্ধ করতে বলেছেন তিনি। যদিও মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোটটির পক্ষে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন। কারণ, মস্কোর ‘তরল সোনা’র অন্যতম বড় ক্রেতা হল তুরস্ক, হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়া।
শুধুমাত্র খনিজ তেলই নয়, নেটো-ভুক্ত দেশগুলিকে বিপুল পরিমাণে ‘তরল প্রাকৃতিক গ্যাস’ (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস বা এলএনজি) বিক্রি করে রাশিয়া। এই এলএনজি জার্মানি-সহ পশ্চিম ইউরোপের শীতপ্রবণ দেশগুলির খুবই প্রয়োজন। বিশ্লেষকদের দাবি, এ-হেন পরিস্থিতিতে মস্কোর থেকে তেল কেনা বন্ধ করলে এলএনজি সরবরাহ থামিয়ে দিতে পারে ক্রেমলিন। জার্মানির মতো দেশের ক্ষেত্রে সেটা হবে আত্মহত্যার শামিল।
এ ছাড়া নেটোর সদস্য দেশগুলির একাংশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ব্যাপারে চিনের উপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। ট্রাম্পের কথামতো বেজিঙের পণ্যে শুল্ক চাপালে বিপদে পড়তে পারে তারা। সে ক্ষেত্রে নেটো-ভুক্ত দেশগুলিতে রফতানি কমানোর ছুতো পেয়ে যাবে ড্রাগন। এতে বিভিন্ন সামগ্রীর সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার প্রবল আশঙ্কা থাকছে। আর তাতে যে শেষ পর্যন্ত নেটো-ভুক্ত দেশগুলিরই আর্থিক লোকসান হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের নিশানায় এ বার রয়েছে চিন। আর্থিক দিক থেকে মূলত বেজিংকেই ক্ষতবিক্ষত করতে চাইছেন তিনি। ড্রাগনের উত্থানকে কেন্দ্র করে পশ্চিম ইউরোপের একাধিক দেশও বেশ উদ্বিগ্ন। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কথামতো কিছু পদক্ষেপ করতে পারে তারা। তবে বাস্তবের মাটিতে সেটা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন্স) চালাচ্ছে রাশিয়া। ফলে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে পূর্ব ইউরোপ। এ বছরের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হওয়া ইস্তক ওই সংঘাত থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। সেই লক্ষ্যে পুতিন এবং ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়ার উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে অর্থনীতি বাঁচাতে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় মস্কো। প্রস্তাব লুফে নিতে এতটুকু দেরি করেনি ভারত ও চিন। ওই সময় থেকেই ক্রেমলিনের ‘তরল সোনা’ আমদানি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় এই দুই দেশ।
বর্তমানে রুশ ‘উরাল ক্রুড’ সর্বাধিক কিনছে বেজিং। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। ঠিক তার পরেই আছে নেটো-ভুক্ত তুরস্ক। ট্রাম্পের যুক্তি, মস্কোর থেকে এ ভাবে বিপুল ‘তরল সোনা’ আমদানির জেরে যুদ্ধ চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে পাচ্ছেন পুতিন। আর তাই শাস্তি হিসাবে এ দেশের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। যদিও তাতে পিছু হটতে নারাজ কেন্দ্রের মোদী সরকার। জাতীয় স্বার্থে ক্রেমলিনের অপরিশোধিত তেল কেনা বজায় থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
গত ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ করে শুল্ক নিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। এর জেরে বিকল্প বাজারের খোঁজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে নয়াদিল্লি। এ বছরের ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চিনের তিয়ানজ়িন শহরে একত্রিত হন ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও)-ভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রনেতারা। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে যোগ দিয়ে পুতিন এবং ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জ়িনপিঙের সঙ্গে পৃথক ভাবে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
এসসিও বৈঠকের পরই আমেরিকা জুড়ে শুরু হয় ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রবল সমালোচনা। হু-হু করে কমতে থাকে তাঁর জনসমর্থন। ফলে চাপে পড়ে কিছুটা সুর নরম করেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। গত ১২ সেপ্টেম্বর ‘ফক্স নিউজ়’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্ত মোটেই সহজ ছিল না। এর জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে।’’ মার্কিন কূটনীতিকদের একাংশ মনে করেন, ট্রাম্পের জন্য অচিরেই রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে ত্রিশক্তি জোট গড়ে তুলবে ভারত, যা আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
আর তাই নজর কিছুটা ঘুরিয়ে ট্রাম্প এ বার চিনকে নিশানা করতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ফক্স নিউজ়’কে তিনি বলেন, ‘‘নেটো যদি রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে এবং বেজিঙের পণ্যে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেয়, তা হলে এই প্রাণঘাতী যুদ্ধ বন্ধ হবে। কারণ রাশিয়ার উপর চিনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। শুল্ক সেই নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে পারে।’’
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পর স্লোভেনিয়া সফর থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বেজিং কখনও যুদ্ধের পরিকল্পনা করে না। লড়াইয়ে যোগদানও করে না। সংঘর্ষ কখনও কোনও সমস্যার সমাধান তো করতে পারে না। উল্টে বিধিনিষেধ ওই সমস্যাগুলিকে আরও জটিল করে তোলে।’’
উল্লেখ্য, ভারত এবং চিনের উপর শুল্ক চাপাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জি-৭ এবং নেটোর উপর চাপ সৃষ্টি করলেও নয়াদিল্লির সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলতে আগ্রহী ওয়াশিংটন। সূত্রের খবর, এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে সমঝোতায় আসতে পারে দুই দেশ। তবে তার আগে ট্রাম্পের কথায় জি-৭ এবং নেটো শুল্কযুদ্ধে নামলে বাণিজ্যচুক্তি বিশ বাঁও জলে যেতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘দ্য ফিনান্সিয়াল টাইম্স’। সেখানে বলা হয়, ভারতের উপর আরও বেশি শুল্ক চাপাতে নাকি ইইউকে গোপনে উস্কানি দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তালিকায় চিনকেও রেখেছেন তিনি। ফলে জি-৭ এবং নেটোর পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে কড়া নজর রাখছে সাউথ ব্লক।
সব ছবি: সংগৃহীত।