দুই ভাইয়ের সঙ্গে মিলে গভীর ষড়যন্ত্র। রফতানি সংক্রান্ত বিভিন্ন সরকারি নথি নকল করে শুল্কবিহীন ভাবে সোনা আমদানির ছাড়পত্র নিয়েছিলেন মোনিকা কপূর। কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যান ১৯৯৯ সালে। মোনিকাকে ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্য সিবিআই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়।
দীর্ঘ ২৫ বছর পর মোনিকার গ্রেফতারিতে সাফল্য পেল সিবিআই। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ৯ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে মোনিকাকে। প্রতারণা এবং ব্যবসায়িক কেলেঙ্কারি-সহ বেশ কিছু অভিযোগের খাঁড়া ঝুলছে মোনিকার মাথার উপর। বুধবার রাতের উড়ানে ভারতে আনা হয়েছে তাঁকে। বিমানে মোনিকার সঙ্গে ছিল সিবিআইয়ের একটি দল।
২০১০ সাল থেকে মোনিকাকে দেশে ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। অবশেষে ইউনাইটেড স্টেটস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট অফ নিউ ইয়র্কের নির্দেশে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে জালিয়াতিতে অভিযুক্ত মোনিকাকে ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হল। আর্থিক জালিয়াতির সঙ্গে সম্পর্কিত ভারতীয় দণ্ডবিধির পাঁচটি ধারায় মোনিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
১৯৯৯ সালে মোনিকা তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে ভারত থেকে পালিয়ে যান। মোনিকার দাবি ছিল, সরকারি আধিকারিকেরা তাঁর থেকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ দাবি করছেন। একই সঙ্গে তাঁর উপর রাজনৈতিক চাপও আসছিল। ২০১০ সালের এপ্রিলে তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে তিনি দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন মুলুকে আত্মগোপন করেছিলেন।
প্রত্যর্পণের বিষয়ে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার সঙ্গে সন্ধি হয়েছে ভারতের। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কের আদালত মোনিকাকে ভারতে ফেরানোর নির্দেশ দেয়। আদালতে অভিযুক্ত দাবি করেছিলেন, ভারতে ফিরলে তিনি হেনস্থার শিকার হবেন। যদিও সেই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে নিউ ইয়র্কের আদালত।
সিবিআই জানিয়েছে, পলাতক মোনিকা গয়নার ব্যবসার জন্য দুই ভাইকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে রফতানির বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র নকল করেছিলেন। শিপিং বিল থেকে ইনভয়েস এবং ব্যাঙ্কের শংসাপত্র, সমস্ত কিছু নকল করে কেন্দ্রের কাছ থেকে কোনও রকম শুল্ক ছাড়াই সোনা আমদানির ছাড়পত্র নেন।
মোনিকা কপূর ছিলেন মেসার্স মোনিকা ওভারসিজ়ের মালিক। ১৯৯৮ সালে তাঁর ভাই রাজন এবং রাজীব খন্নার সহায়তায় সেই নকল নথিগুলির সাহায্যে জালিয়াতি করে ২.৩৬ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত সোনা আমদানি করেন। এই কাজের জন্য ছ’টি পুনর্নবীকৃত লাইসেন্স ব্যবহার করা হয়েছিল। গয়না ব্যবসায় আমদানি পণ্যকে শুল্কহীন করার জন্য অসাধু উপায়ে কেন্দ্রের কাছ থেকে লাইসেন্স নেন তাঁরা।
এর পর লাইসেন্সগুলি অহমদাবাদ-ভিত্তিক একটি সংস্থা ডিপ এক্সপোর্টসের কাছে বিক্রি করে দেয় মোনিকা ওভারসিজ়। ডিপ এক্সপোর্টস শুল্কমুক্ত সোনা আমদানি করত। মোনিকাদের ওই জালিয়াতির ফলে কেন্দ্রের কোষাগার থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয় সেই সময়ে। বর্তমানে সেই ক্ষতির বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা।
১৯৯৯ সালে মোনিকার জালিয়াতি প্রকাশ্যে আসার পরই তিনি ভারত সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে আমেরিকা পাড়ি দেন। ২০০২ সালে সংশ্লিষ্ট আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং দুর্নীতি মামলার তদন্ত নতুন ভাবে শুরু করে সিবিআই। ২০০৪ সালে আদালতে চার্জশিট জমা পড়ে। তাতে মোনিকা এবং তাঁর দুই ভাইকে অভিযুক্ত হিসাবে দেখানো হয়।
মোনিকা তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ায় যোগ না দেওয়ায় তাঁকে ২০০৬ সালে অপরাধী ঘোষণা করে ভারত। রাজন এবং রাজীব ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেই দিল্লির আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। অন্য দিকে, মোনিকাকে এই মামলার মূল ষড়যন্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল একটি জামিন-অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং এর পর একটি ‘রেড কর্নার নোটিস’ জারি করা হয়।
ভারত-আমেরিকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে ২০১০ সালের অক্টোবরে মোনিকার প্রত্যর্পণের জন্য আমেরিকার কাছে আবেদন করা হয়েছিল। সেই অনুরোধের পর প্রায় ১৪ বছর ধরে নানা টালবাহানায় সেই প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়েছিল। ভারতে ফেরত পাঠানো হলে রাজনৈতিক নিপীড়নের আশঙ্কায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনের অধীনে আশ্রয় এবং সুরক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন মোনিকাও।
যদিও সেই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছে নিউ ইয়র্কের আদালত। চলতি বছরের (২০২৫) ১৯ মে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি তাঁর প্রত্যর্পণের উপর অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করেন। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী সুনীতার প্রত্যর্পণ অনুমোদন করার পর এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
মোনিকাকে ভারতে ফিরিয়ে আনার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। সিবিআই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই প্রত্যর্পণ ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। কেন্দ্রীয় সংস্থা ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য লড়াই করতে বদ্ধপরিকর।
সব ছবি: সংগৃহীত।