এক দিকে শুল্ক-সংঘাত। অন্য দিকে সাড়ে আট মাস পেরিয়েও বাণিজ্যচুক্তি না হওয়া। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে ফের নয়াদিল্লিকে বড় ধাক্কা দিল যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিনা নিয়ন্ত্রণ কমাতে কৌশলগত অংশীদারদের নিয়ে ‘প্যাক্স সিলিকা’ গঠনের কথা ঘোষণা করে আমেরিকা। সেখানে ওয়াশিংটনের ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির তালিকা থেকে বাদ পড়েছে এ দেশের নাম, যা কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘ব্যর্থতা’ বলে সুর চড়িয়েছে লোকসভার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মার্কিন নেতৃত্বে ‘প্যাক্স সিলিকা’ তৈরি হবে বলে জানিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে মূলত সিলিকন উপত্যকার সরবরাহ শৃঙ্খলকে সমৃদ্ধশালী, নিরাপদ এবং উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে ওয়াশিংটন। এর মধ্যে থাকবে বিরল খনিজ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ এবং কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) পরিকাঠামো। এর মধ্যে প্রথমটির উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব রয়েছে চিনের। আর এআইয়ের ক্ষেত্রে ধূমকেতুর মতো উঠে আসছে বেজিং।
‘প্যাক্স সিলিকা’র ঘোষণার পর একটি বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জানায়, এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে আমেরিকা। শুধু তা-ই নয়, কৃত্রিম মেধাভিত্তিক যুগে ওয়াশিংটনের অংশীদারেরা প্রবেশের সুযোগ পেতে চলেছে বলেও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীতে থাকছে জাপান, রিপাবলিক অফ কোরিয়া (দক্ষিণ কোরিয়া), সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, ইজ়রায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং অস্ট্রেলিয়া।
এদের বাদ দিলে রিপাবলিক অফ চায়না বা তাইওয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ এবং কানাডাকে নিয়ে ‘প্যাক্স সিলিকা’ গঠন করতে চলেছে আমেরিকা। এতে যোগ দিতে ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা’ বা ওইসিডির (অর্গানাইজ়েশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট) ৩৮টি সদস্য রাষ্ট্রকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে ওয়াশিংটন। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির সদস্যপদ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা এবং ইইউ-এর। কৌশলগত অংশীদারদের মধ্যে একমাত্র ভারতকেই ব্রাত্য রেখেছে মার্কিন সরকার।
আগামী দিনে ‘প্যাক্স সিলিকা’র লক্ষ্য কী হতে চলেছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি হোক বা বিরল খনিজ, অনেক ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রের উপর যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারদের প্রবল ভাবে নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে। এর মাধ্যমে সেটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে ওয়াশিংটন। তা ছাড়া এই গোষ্ঠীর দেশগুলি সম্মিলিত ভাবে রূপান্তরমূলক প্রযুক্তির বিকাশ এবং ব্যবহারের দিকে নজর দেবে।
এ প্রসঙ্গে দেওয়া বিবৃতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্তা বলেছেন, ‘‘আমাদের অংশীদারদের মধ্যে কৃত্রিম মেধার ব্যাপারে একটা ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য একটা নিরাপদ সরবরাহ শৃঙ্খল, বিশ্বস্ত প্রযুক্তি এবং কৌশলগত পরিকাঠামোর খুব প্রয়োজন আছে। সেটাই ‘প্যাক্স সিলিকা’র মাধ্যমে গড়ে তোলা যাবে।’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ, ‘প্যাক্স সিলিকা’কে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) সঙ্গে তুলনা করেছেন। সরকারি বিবৃতিতে আমেরিকা বলেছে, এই গোষ্ঠী কাউকে বিচ্ছিন্ন বা একঘরে করার জন্য তৈরি হচ্ছে না। কৃত্রিম মেধার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন অংশীদারদের প্রতিযোগিতামূলক সমৃদ্ধি চায়। তবে ভারতকে কেন এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হল না, তা স্পষ্ট করেনি ট্রাম্প প্রশাসন। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উঠেছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্যাক্স সিলিকা’য় ভারতের নাম বাদ পড়ার নেপথ্যে একগুচ্ছ কারণ রয়েছে। প্রথমত, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নয়াদিল্লি সফর করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আমেরিকার উপর চাপ তৈরি করতে আরআইসি (রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না) নামের গোষ্ঠীকে পুনরুজ্জীবিত করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন পুতিন। সেই লক্ষ্যে নয়াদিল্লি ও বেজিঙের সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে ফেলার দিকে নজর দিয়েছে মস্কো। এ দেশের এ-হেন ‘ক্রেমলিন প্রেম’ মোটেই ভাল চোখে দেখছে না ওয়াশিংটন।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়া, চিন, ব্রাজ়িল-সহ ১০টি দেশের সংগঠন ‘ব্রিকস’-এর সদস্যপদ রয়েছে ভারতের। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটি যে কোনও মুহূর্তে নতুন মুদ্রা আনতে পারে বলে আশঙ্কায় ভুগছে আমেরিকা। সে ক্ষেত্রে ধ্বংস হতে পারে ডলারের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা। যদিও সেই আশঙ্কা নেই বলে মার্কিন সরকারকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু, তার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ একেবারে দূর হয়নি।
কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির জন্য একান্ত ভাবে প্রয়োজন সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ, যা তৈরি করতে চাই বিরল খনিজ। বর্তমানে ওই গুরুত্বপূর্ণ ধাতুগুলির উপর বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। ট্রাম্পের সরকারের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে আমেরিকায় বিরল খনিজের সরবরাহ প্রায় বন্ধ রেখেছে বেজিং। অন্য দিকে ভারতকে তা পাঠাতে দ্বিধা করছে না ড্রাগন সরকার। এই ইস্যুতে ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রবল চাপের মুখে পড়ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়া থেকেই রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কিনে আসছে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তি, এতে লড়াই চালানোর প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে যাচ্ছে মস্কো। আর তাই ‘শাস্তি’ দিতে এ দেশের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, এতে কিছুটা দমে যাবে কেন্দ্র। ফলে নিজেদের শর্তে বাণিজ্যচুক্তি করতে পারবে তারা। যদিও বাস্তবে তা হয়নি।
গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চার দিনের ভারত-পাক ‘যুদ্ধের’ পর সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয় দুই দেশ। লড়াই থামতেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছেন বলে একাধিক বার বিবৃতি দেন ট্রাম্প। কিন্তু, মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি মানেনি নয়াদিল্লি। লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী সাফ জানিয়ে দেন, সংঘর্ষ থামাতে কেউ তাঁর উপর চাপ তৈরি করেনি। এতে আন্তর্জাতিক আঙিনায় অস্বস্তির মুখে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সেই ঘটনার মোক্ষম প্রতিশোধ নিতে ভারতকে তিনি ‘প্যাক্স সিলিকা’র বাইরে রাখলেন বলেও তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পরিক স্বার্থ এবং শক্তির সমীকরণের ভিত্তিতে। সেখানে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্ব থাকে বটে, তবে সেটা স্বার্থের ভিত্তিতে। আমেরিকার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। এখন তারই নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে তাই বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারকে নিশানা করতে ছাড়েননি কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ। তাঁর কথায়, ‘‘এ বছরের ১০ মে থেকে মোদী-ট্রাম্প সম্পর্কের যে রকম অবনতি হয়েছে, তাতে এটা হওয়ারই ছিল। ‘প্যাক্স সিলিকা’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে নিঃসন্দেহে লাভবান হত ভারত। ব্যর্থ বিদেশনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হারাচ্ছি আমরা।’’
অন্য দিকে ভারতকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্যাক্স সিলিকা’ তৈরি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার রাজনীতিতে বড় বদল আনতে চলেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। তাদের দাবি, চিনের মতো শক্তিকে আটকাতে নয়াদিল্লির মতো বিশ্বস্ত ‘বন্ধু’ হারানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে পারে কেন্দ্র, ওয়াশিংটনের জন্য যা দুঃস্বপ্নের।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত একটি চতুঃশক্তি জোট ‘কোয়াড’-এর সদস্যপদ রয়েছে ভারতের। ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে এর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প তাতে যোগ দিতে না আসায় বাতিল হয় বৈঠক। বিশ্লেষকদের দাবি, আমেরিকার এই ধরনের পদক্ষেপের জেরে আগামী দিনে আরও গুরুত্বহীন, এমনকি অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলতে পারে ‘কোয়াড’।
তবে ‘প্যাক্স সিলিকা’র সঙ্গে নেটোর তুলনা টানা নিয়ে সাবেক সেনাকর্তাদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। তাঁদের দাবি, ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ একটি সামরিক সংগঠন। গত শতাব্দীর ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন ঠেকাতে এর জন্ম দিয়েছিল আমেরিকা। ‘প্যাক্স সিলিকা’য় সেই ধরনের কোনও শর্ত নেই। এতে যৌথ ভাবে কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা এবং উন্নয়নমূলক কাজ এগোবে বলে জানা গিয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।